ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আপীল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ

কামারুজ্জামানের ফাঁসি ॥ আরও একধাপ এগোল

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কামারুজ্জামানের ফাঁসি ॥ আরও একধাপ এগোল

আরাফাত মুন্না ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সুপ্রীমকোর্টের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামানের বর্বরতা নাৎসি বাহিনীর চেয়েও নৃশংস ছিল। তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না বলেও রায়ে বলা হয়েছে। রায়ে আরও বলা হয়েছে, তারা যেসব অপরাধ করেছে এবং সে সব অপরাধের যে বিষক্রিয়া শুধু একাত্তর প্রজন্মের লোকদের জন্যই নয় বরং একাত্তরপরবর্তী সমস্ত প্রজন্মের জন্যও রেখে গেছে চরম বিষাক্ত আবহাওয়া, সুতরাং তাদের শাস্তি হওয়া উচিত, তাদের অপরাধের সঙ্গে যা সামঞ্জস্যকর তাই। অর্থাৎ মৃত্যুদ-। বুধবার শুনানি গ্রহণকারী চার বিচারপতির স্বাক্ষরের পর দুপুর একটা ৫৫ মিনিটে সুপ্রীমকোর্টে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ৫৭৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বেঞ্চের নেতৃত্ব প্রদানকারী বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) মৃত্যুদ-ের পক্ষে মূল রায়টি লিখেছেন। ৫৭৭ পৃষ্ঠার রায়ের মধ্যে তিনি লিখেছেন ১৮৭ পৃষ্ঠা। মৃত্যুদ-ের রায়ের পক্ষে আরও ২৬ পৃষ্ঠা যোগ করেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। মৃত্যুদ-ের রায়ের পক্ষে বিচারপতি এএইচএম শাসুদ্দিন চৌধুরী মানিক লিখেছেন ৯৬ পৃষ্ঠা। এছাড়া ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহ্াব মিয়া যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়ে রায় লিখেছেন ২৬৮ পৃষ্ঠা। অন্যদিকে, রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পর রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের জন্য ১৫ দিনের সময় থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, রায় পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানার আদেশ জেলে পাঠালে সরকারের পক্ষে মৃত্যুদ- কার্যকরের দিন ঠিক করতে কোন অসুবিধা নেই। তবে যদি তার পক্ষ থেকে রিভিউ দায়ের করা হয়, তাহলে মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, রিভিউ খারিজ হলে সামনে আসবে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়। আসামি যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবে না বলে জানায়, তবে রিভিউ খারিজের দিনই দ- কার্যকর করা যাবে। এদিকে সুপ্রীমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে। এই অনুলিপির ওপর ভিত্তি করেই ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। গত বছরের ৩ নবেম্বর সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি) নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপীল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখেন। রায়ে আদালত বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে কামারুজ্জামানকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হলো। অর্থাৎ চার বিচারপতির মধ্যে তিনজনই কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহালের পক্ষে রায় দেন এবং বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিয়া অপরাধ প্রমাণের বিষয়ে একমত হলেও মৃত্যুদ-ের বিরোধিতা করেন। তিনি কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ের শুরুতে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানীদের শোষণ-নিপীড়নের ইতিহাস বর্ণনা করেন। পরে তিনি লিখেছেন, এটা স্বীকৃত সত্য যে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং হত্যার মতো অপরাধে জড়িত ছিল তারা ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের পর গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকে। কেউ কেউ জামায়াতে প্রাণশক্তি সঞ্চার করে। কেউ কেউ যোগ দেয় অন্যান্য দলে। এরপর থেকে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চলে আসছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতরা স্বাভাবিক রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকে। এমনকি তাদের কেউ কেউ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর মতো উচ্চপদেও আসীন হয়। ক্ষমতায় গিয়ে তারা শুধু আইনী তথ্যাদিই ধবংস করেনি তারা মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসেও বিকৃতি ঘটায়। রায়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেছেন, অভিযুক্ত কামারুজ্জামান একাত্তরে বর্বর হত্যাকা-ে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। তার এ সব হত্যাকা- অন্য কোন হত্যাকা-ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যে হত্যাকা- চালিয়েছে এটা তার চেয়েও নৃশংস ছিল। রায়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত কামারুজ্জামান একাত্তরে আলবদর বাহিনীর নেতৃত্বে থেকে সোহাগপুর গ্রামের পুরুষদের হত্যা এবং বিধবাদের ধর্ষণ করেছে এবং তাতে সহায়তা করেছে। এ ধরনের বীভৎস ও অমানবিক কর্মকা-ের জন্য সে কোনভাবেই সহানুভূতি পেতে পারে না। রায়ে তিনি আরও বলেন, তার এ ধরনের কর্মকা-ের মানুষ এবং পশুর মধ্যে কোন পার্থক্য আমরা খুঁজে পাইনি। তিনি আরও বলেন, ট্রাইব্যুনাল ও আপীল বিভাগে কামারুজ্জামানের পক্ষে এমন কোন যুক্তিই পাওয়া যায়নি যে, তার প্রতি অনুকম্পা দেখানো যায়। বিচারপতি এসকে সিনহা আরও বলেন, এ মামলায় তার অপরাধের যে মাত্রা ও ভয়াবহতা, তাতে মৃত্যুদ-ই তার প্রাপ্য। এসব কারণেই ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদ- দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রায়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, মৌখিক ও প্রামাণ্য সাক্ষ্য বিবেচনা করে প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে, যে সোহাগপুরে আলবদর বাহিনী ও গণবিরোধী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সোহাগপুরে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। এছাড়া কামারুজ্জামান ছিল আলবদর বাহিনীর সক্রিয় নেতা। রায়ে তিনি আরও বলেন, প্রসিকিউশন আরও প্রমাণ করতে পেরেছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কামারুজ্জামানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। এছাড়া একাত্তরে শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায় আলবদর বহিনীর মূল নেতা ছিল কামারুজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ জনগণ, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা, নির্যাতন এবং অপরাধের জন্য সে দায়ী ছিল। এটাও প্রমাণিত হয়েছে। বিচারপতি হাসান ফয়েজ রায়ে বলেন, মানুষের মর্যাদা ও সমাজের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান এবং তার সহযোগীরা বর্বরোচিত, বীভৎস ও ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠিত করেছে। তার অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া। ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম বিচারপতি লর্ড ডেনিংয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রায়ে বলেন, অপরাধ যেখানে গুরুতর এবং যেসব অপরাধ গোটা সমাজকে বিধ্বস্ত করে, সে সব অপরাধের চরম সাজাই হওয়া উচিত। রায়ে তিনি আরও বলেন, সংঘটিত অপরাধ, ব্যবহৃত অস্ত্র, অপরাধের নৃশংসতা, হত্যাকা-ের সংখ্যা, ধর্ষিত নারী, বিধবা ও তাদের সন্তানদের অসহনীয় ব্যথা ও দুর্বিষহতা বিবেচনা করে আমরা কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- ছাড়া অন্য কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারি না। রায়ে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, এসব মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিষয়ে আমাদের দয়া অথবা অনুকম্পা প্রদর্শনের কোনই সুযোগ নেই। তিনি বলেন, তারা যে সব অপরাধ করেছে এবং সে সব অপরাধের যে বিষক্রিয়া শুধু একাত্তর প্রজন্মের লোকদের জন্যই নয় বরং একাত্তরপরবর্তী সমস্ত প্রজন্মের জন্যও রেখে গেছে চরম বিষাক্ত আবহাওয়া, সুতরাং তাদের শাস্তি হওয়া উচিত, তাদের অপরাধের সঙ্গে যা সামাঞ্জস্যকর তাই। অর্থাৎ মৃত্যুদ-। রায়ে তিনি আরও বলেন, এই অপরাধীকে ফাঁসির কাষ্টে না ঝুলালে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে না। রায়ে তিনি বলেন, শুনানিতে প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় কামারুজ্জামানের সুপিরিয়র রেসপনসিবলিটির কথা বলা হয়েছে। আমাদের কাছেও এটা প্রতীয়মান হয়েছে, সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির জন্যও এই অপরাধী দায়ী। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের একটি উক্তি উল্লেখ করে রায়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, শুধু এ সমস্ত অপরাধীদের সাজা না দেয়াটাই অন্যায় হবে না, তারা যে সব অপরাধ করেছে সেসব অপরাধকেও নির্মূল করতে হবে। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জাস্টিস জ্যাকসনের একটি উক্তি উল্লেখ করে বিচারপতি মানিক বলেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যে আমরা আজ যে সমস্ত দলিলাদির ওপর বিচার করছি, এ সব দালিলাদির ওপর ইতিহাস একদিন আমাদের বিচার করবে। রায়ে যুদ্ধাপরাধী আইন বিশেষজ্ঞ স্যার জ্যাফরি রাবার্টসন কিউসির উক্তি উল্লেখ করে বিচারপতি মানিক বলেন, যেহেতু এসব অপরাধীদের অপরাধ সারাবিশ্বের সমস্ত বিবেকবান মানুষদের বিবেককে দংশিত করে সুতরাং তাদের শাস্তি হওয়া উচিত প্রতিশোধমূলক নিয়মানুযায়ী। বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক রায়ে আরও বলেন, এটা আমাদের ইতিহাসের এক চরম দুঃখজনক ঘটনা। যে এ সব মানবরূপী দানবদের গত কয়েক দশকেও বিচার হয়নি এবং এর জন্য একান্তভাবে তারাই দায়ী যারা, ১৯৭৫ সনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করে দেশকে আবার পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। রায়ে তিনি আরও বলেন, যাই হোক, অবশেষে হলেও তাদের বিচার হয়েছে। যার দ্বারা জাতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এখন তাদের চরম শাস্তি অপেক্ষারত। কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদানকারী বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহ্াব মিয়া রায়ে বলেন, কাদের মোল্লার রায়ে বলা কথাটির আবারও পুনরাবৃত্তি করতে চাই। মানুষ এবং এ ভূমির সন্তান হিসেবে পাকিস্তানী বাহিনী, তাদের সহযোগী ও অন্যান্যরা যে নৃশংস বর্বরতা চালিয়েছিল তাতে আমিও আঘাতপ্রাপ্ত ও আমারও আবেগপ্রবণ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে ভয়ভীতি, অনুরাগ-বিরাগের উর্ধে ওঠে আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে আমি শপথাবদ্ধ। এর আগে ২০১৩ সালের ৯ মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ট্রইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান আপীল করেন। আপীল বিভাগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রায়টি সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ) রেখেছিল সুপ্রীমকোর্ট। এরপর গত ৩ নবেম্বর আপীল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে ট্রইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ-ই বহাল রাখে। মাত্র কয়েক মিনিটে দেয়া আপীল বিভাগের এ সংক্ষিপ্ত রায়ে আসামি কামারুজ্জামানের আপীল আংশিক মঞ্জুর করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে বেঞ্চের চার বিচারপতিই কামারুজ্জামনকে দোষী সাব্যস্ত করলেও এক বিচারপতি তাকে মৃত্যুদ- না দিয়ে ভিন্ন সাজা দেন। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে মৃত্যুদ-ের রায় আসে। আপীল বিভাগের দেয়া দ-গুলো ॥ তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা এক নম্বর অভিযোগ একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার দায়ে ট্রইব্যুনাল যাবজ্জীবন দ- দিলেও আপীল বিভাগ খালাস দিয়েছে। দ্বিতীয় অভিযোগে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে অমানবিক নির্যাতনের দায়ে ট্রইব্যুনালের দেয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রয়েছে। তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গ্রামে (বর্তমানে বিধবাপল্লীতে) গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রয়েছে। চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যদ-ের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদ- আপীল বিভাগও তার রায়ে বহাল রেখেছে। এখন এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়া গেলে এ রায়ের রিভিউ আবেদন করতে পারবে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ উভয়ই। তবে পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে এই রিভিউ আবেদন করতে হবে। এরপর রিভিউ নিষ্পত্তি হলেই রায়ের অনুলিপি পাঠানো হবে ট্রাইব্যুনালে। এরপর ট্রাইব্যুনাল ওই রায়ের ওপর ভিত্তি করেই কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবে। এর আগে যেমনটি করা হয়েছিল জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে। গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আপীল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদ- দেন। প্রায় আড়াই মাসেরও বেশি সময় পর ৫ ডিসেম্বর আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রায়ে কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেয়ার পক্ষে একমত ছিলেন না বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। রায়ের কপি প্রকাশের পর ৮ ডিসেম্বর সেটি ট্রইব্যুনালে পাঠানো হয়। এরপর ট্রইব্যুনাল সে দিনই কাদের মোল্লার মৃত্যুপরোয়ানা জারি করে আদেশটি ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। রায়ের কপি হাতে পেয়েই তার ফাঁসি কার্যকর করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। এক্ষেত্রে তখন জেল কোড অনুযায়ী রায়ের কপি হাতে পাওয়ার ২১ দিনের আগে নয় ও ২৮ দিনের পরে নয় যে বিধান রয়েছে তা অনুসরণ না করেই ফাঁসি কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের জন্য জেল কোডে প্রদত্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করতে আসামিপক্ষের উদ্যোগের প্রেক্ষাপটে চেম্বার জজ ১০ ডিসেম্বরে ফাঁসির আদেশ স্থগিত করেছিলেন। কাদের মোল্লার পক্ষে রিভিউসংক্রান্ত দুটি আবেদন দায়ের করা হয়েছিল আপীল বিভাগে। এর একটি ছিল রিভিউ গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না এবং অন্যটি ছিল তার মূল রিভিউ আবেদন। এই দুই আবেদনেরই শুনানি করে ১২ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি কেবল ঘোষণা দেন যে, বোথ দ্য ক্রিমিনাল রিভিউ পিটিশনস আর ডিসমিসড। রিভিউ আবেদন খারিজের দিন রাতেই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৫ দিন অপেক্ষা করবে না রাষ্ট্রপক্ষ ॥ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদনের জন্য ১৫ দিনের সময় থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, কেউ যদি রিভিউ না করে, তাহলে রাষ্ট্র কি বসে থাকবে? কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তিনি এ কথা বলেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কামারুজ্জামানের মামলার ব্যাপারে আমাদের এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটল। রায় পাওয়ার পর ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানার আদেশ জেলে পাঠালে সরকারের পক্ষে মৃত্যুদ- কার্যকরের দিন ঠিক করতে কোন অসুবিধা নেই। তবে যদি তার পক্ষ থেকে রিভিউ দায়ের করা হয়, তাহলে মৃত্যু পরোয়ানার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে। মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউয়ের ১৫ দিনের হিসাব আজ (বুধবার) থেকেই শুরু হবে। এই ১৫ দিন রাষ্ট্রকে অপেক্ষা করতে হবে বলে আপীল বিভাগ রিভিউয়ের রায়ে বলেন নাই। তবে রিভিউ আবেদন দায়ের করলে দ-াদেশের কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আজকের (বুধবার) ভেতরে পূর্ণাঙ্গ রায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রেরণ করা হবে। এরপর ট্রাইব্যুনাল কারাগারে মৃত্যু পরোয়ানা পাঠাবেন। সেটা ট্রাইব্যুনাল আজও করতে পারেন, কালও করতে পারেন। জেলখানায় পরোয়ানা গেলে তাকে প্রাণভিক্ষা করবেন কিনা, রিভিউ করবেন কিনা, এগুলো জানিয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়ে মাহবুবে আলম বলেন, প্রাণভিক্ষার অধিকারটা সব সময় দেয়া হয়। রিভিউয়ের আগেও তিনি চাইতে পারেন। তবে স্বাভাবিকভাবে আইনী প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্রাণভিক্ষা চাওয়ার নিয়ম। তবে আসামী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে না চাইলে, রিভিউ খারিজের দিনই দ- কার্যকর করা যাবে। এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী শিশির মনির জানিয়েছেন, রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর মক্কেলের (কামারুজ্জামান) সঙ্গে আলাপ করে রিভিউয়ের বিষয়ে জানাবেন তাঁরা। দ- কার্যকর প্রক্রিয়া ॥ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের দিন থেকে রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করার জন্য ১৫ দিনের সময় পাচ্ছেন আসামিপক্ষ। এ দিন গণনা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ সত্যায়িত অনুলিপি গ্রহণের পরই। এখন পূর্ণাঙ্গ রায়টি আপীল বিভাগ থেকে বিচারিক আদালতে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) পাঠানো হবে। এরপর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। তারপর এ পরোয়ানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাগারে যাবে। পরবর্তীতে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কামারুজ্জামানকে অবহিত করবে। এরপর দ-প্রাপ্ত কামারুজ্জামান ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। ক্ষমা না চাইলে ফাঁসি কার্যকরে আর কোন বাধা থাকবে না। আর যদি রিভিউ আবেদন করে তাহলে সে জন্য ১৫ দিন সময় পাবে আসামিপক্ষ। রিভিউ নিষ্পত্তির পর নিয়ম অনুসারে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন হবে।
×