ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খুনীদের সঙ্গে সংলাপ নয় ॥ বান কি মুনকে চিঠি দেবে সরকার

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খুনীদের সঙ্গে সংলাপ নয় ॥ বান কি মুনকে চিঠি দেবে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নিকট জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের পাঠানো চিঠির জবাব দেবে সরকার। এ বিষয়ে অবিলম্বে চিঠি দিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবকে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট পাঠানো চিঠিতে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে উদ্যোগ প্রত্যাশা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়েছেন। এছাড়া বিএনপিকে ইঙ্গিত করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান খুনীদের সঙ্গে কোন সংলাপ করবে না সরকার। চলমান অবরোধ-হরতালের প্রেক্ষাপটে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তাঁর উপ-মুখপাত্র ফারহান হক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সংলাপের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ অবসানের আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বান কি মুন সাম্প্রতিক বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। দেশের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার স্বার্থে চলমান অস্থিরতার অবসান ঘটানো জরুরী বলে মত দিয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসানে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে আলোচনা শুরুর লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রয়োজন হলে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সহায়তা নিতে পারে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন মহাসচিব। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি এ বছরই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) মেয়াদ শেষে নতুন উন্নয়ন এজেন্ডা গ্রহণের কথা থাকায় ২০১৫ সালকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব। ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা-ে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের চিঠির বিষয়ে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের চিঠি আমরা পেয়েছি। তবে তা দেরিতে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। আজ (বুধবার) থেকে দুদিন আগে আমরা এ চিঠি পেয়েছি। জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠির দ্রুত জবাব বিস্তারিত দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। বিষয়টি আমরা কিছুদিন ধরেই শুনছিলাম। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে দুই সপ্তাহ দেরিতে চিঠিটি আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘে নিযুক্ত আমাদের প্রতিনিধিকে মহাসচিবের চিঠি দেরিতে আসার কারণ খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, চিঠিতে বর্তমান সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বানকি মুন। পরবর্তী নির্বাচনের আগে যাতে এ ধরনের সহিংসতা যাতে আর না ঘটে, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে আশা করেন তিনি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘ মহাসচিব চিঠিতে জানিয়েছেন, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি তারানকোকে বাংলাদেশে সহায়তা দরকার হলে এ্যাসাইন করা হবে। এছাড়া বর্তমান সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের আগে যেন সহিংসতা না ঘটে সে বিষয়ে মহাসচিব আশা প্রকাশ করেছেন। শাহরিয়ার আলম বলেন, ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই চিঠির বিষয়বস্তু আমার জানা নেই। জাতিসংঘের মহাসচিবের চিঠিতে বর্তমান সহিংসতাকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের মুখপাত্র জানিয়েছেন, অদূর ভবিষ্যতে তারানকোর বাংলাদেশে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে প্রয়োজন হলে কোন এক সময়ে তিনি বাংলাদেশ সফর করতে পারেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই চিঠি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন চাপ মনে করেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার আলম বলেন, এই চিঠি কোন চাপ নয়। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়েছে। এ সময় তাদের সামনে বর্তমান ভয়াবহ সহিংসতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি, তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছেন, আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। কোন রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নয়। সংলাপের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, সংলাপের কোন সম্ভাবনা দেখছি না। খুনীদের সঙ্গে কোন সংলাপ করতে চাই না। তিনি বলেন, আমরা সন্ত্রাস নির্মূল করতে চাই। ৫ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পেরে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সারাদেশে লাগাতার অবরোধ ডাকেন, ফিরে আসে আগুন-বোমার নাশকতা। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া প্রতিদিনই অবরোধের সঙ্গে হরতাল করছে ২০ দলীয় জোট। হরতাল-অবরোধের এই দেড় মাসে পেট্রোলবোমা ও ককটেল হামলায় সারাদেশে নিহত হয়েছেন অন্তত ৯০ জন, আহত হয়েছেন ৫৫৬ জন। নাশকতার কয়েকটি ঘটনায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলাও হয়েছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষকেই সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ সদর দফতরে মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণহানিতে সংস্থার পক্ষ থেকে উদ্বেগের কথা জানান। ওই সময় তিনি জানান, মহাসচিব বান কি মুন সাবেক সহকারী মহাসচিব (রাজনীতি বিষয়ক) অস্কার ফার্নান্দেজ-তারানকোকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে চলমান হরতাল অবরোধে সহিংসতায় প্রাণহানির পেক্ষাপটে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উত্তরণ প্রত্যাশা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে চিঠি দেন জাতিসংঘ মহাসচিব। এদিকে মাহফুজুর রহমান নিউইয়র্ক থেকে জানান, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ চাইলে জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করতে পারে, তবে মহাসচিব বান কি মুন মনে করেন সাংবিধানিকভাবেই বর্তমান সঙ্কটের সমাধান করবে দেশটি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া তার চিঠিতে বান কি মুন এমন কথাই বলেছেন বলে জানা গেছে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ মিশন সূত্রে। একই সময়ে বিরোধীদল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার প্রতিও সঙ্কট উত্তরণে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব সংস্থাটির প্রধান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিশনের একটি সূত্র বলেছে এক সপ্তাহ আগেই বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে সরাসরি চিঠি দিয়ে তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেন। কিন্তু জাতিসংঘ বাংলাদেশ মিশন বিষয়টি তাদের এখতিয়ারে নয় বলেই মিডিয়াকে জানায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে যে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের গতিধারা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়ে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে তাঁর ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে মহাসচিব বান কি মুন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে দেয়া চিঠির উল্লেখ করে তাঁর (খালেদা জিয়া)-কে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানিয়েছেন বলেছে সূত্রটি। এদিকে মহাসচিব বান কি মুন বাংলাদেশের চলমান সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করে অচলাবস্থা নিরসনে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে। আর দায়িত্ব পেয়েই মিঃ তারানকো জাতিসংঘ বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আব্দুল মোমেনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তার পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু দেশ থেকে সবুজ সঙ্কেত না পাওয়ায় ড. মোমেন গতকাল (নিউইয়র্ক মঙ্গলবার) পর্যন্ত মিঃ তারানকোকে পূর্বনির্ধারিত সময় সোমবারও সাক্ষাত দেননি। এ বিষয়ে ড. মোমেনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দেশ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও নির্দেশনা পেলেই মিঃ তারানকোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে তার। ইতোমধ্যেই কিছু তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি, আজকালের মধ্যেই বাকিটুকু পেয়ে যাব বলে আশা করছি। ড. মোমেন আরও বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মিঃ তারানকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলেও গতকাল (নিউইয়র্ক সময় মঙ্গলবার দুপুরে) জাতিসংঘ সদর দফতরে তাদের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য কথা হয়েছে এবং তিনি তাকে (মিঃ তারানকোকে) বলেছেন শীঘ্রই তাঁর সঙ্গে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলবেন।
×