ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুবহানের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সুবহানের ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সংগঠক আবদুস সুবহানকে মৃত্যুদ- দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। আসামির বিরুদ্ধে আনা ৮ ধরনের নয়টি মানবতাবিরোধী অভিযোগের মধ্যে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের ছয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ১, ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের আদেশ প্রদান করে ট্রাইব্যুনাল। ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগ আমৃত্যু কারাদ- ও ৩ নম্বর অভিযোগে ৫ বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় ৫, ৮ ও ৯ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন আবদুস সুবহান। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই ঐতিহাসিক মামলায় রায় প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। বিচারিক কার্যক্রম শেষে চলতি বছরের ৪ ডিসেম্বও রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রাখা হয়েছিল। রায় প্রদানের সময় চীফ প্রসিউকিউটর গোলাম আরিফ টিপুসহ অন্যান্য প্রসিকিউটরবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী শিশির মনিরসহ অন্যান্য আইনজীবী ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর এটি নবম রায়। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-২ আরও আটটি মামলার রায় প্রদান করেছে। এ পর্যন্ত দুইটি ট্রাইব্যুনাল মোট ১৬টি রায় প্রদান করেছে। যার মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাতটি রায় প্রদান করেছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনাল-১ বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণার জন্য জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা পলাতক আবদুল জব্বারের মামলা সিএভি রাখা হয়েছে। যে কোনদিন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ ও ২ এ আরও নয়টি মামলা বিচারিক কার্যক্রম চলছে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান যখন ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত সার পড়া শুরু করলেন তখন বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে কাঠগড়ায় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় সুবহানকে। তার পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা। গায়ে খাকি হাফ সোয়েটারের সঙ্গে মাথায় টুপিও ছিল। এদিকে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সুবহান ইসলামী দর্শনে রাজনীতি করতেন। কিন্তু তিনি নিরীহ মুসল্লিদের মসজিদ থেকে টেনে এনে হত্যা করেছেন। আর শাস্তি কমানোর ক্ষেত্রে বয়স কখনও গ্রাউন্ড হতে পারে না। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, তিনি ইসলামের আদর্শ থেকে বের হয়ে আদর্শের পরিপন্থী কাজ করেছেন। একাত্তরে তিনি জামায়াতের পক্ষে কাজ করেছেন। জামায়াত একটি অপরাধী সংগঠন। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে পাকিস্তানী সেনাদের সঙ্গে নিয়ে সুবহান পাবনায় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট শুরু করেন বলে এ মামলার পর্যবেক্ষণে এসেছে। এদিকে রায়ে প্রসিকিউশন পক্ষ, সেক্টর কমান্ডার ফোরাম ও গণজাগরণ মঞ্চ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আসামি পক্ষ এ রায়ে ক্ষুব্ধ, তারা উচ্চ আদালতে আপীল করবে। আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘সরকার ক্ষমতায় এসে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করেছিল। যাদেরকে সাজা দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রথমে তদন্ত করা হয়েছিল। তদন্তে যখন প্রমাণিত হয় তারা একাত্তরে হত্যাকা-ে জড়িত ছিল তখনই তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়। এই রায়ের ফলে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তাদের ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধ হয়েছে।’ সকাল সোয়া ১১টার দিকে এ জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা শুরু করেন বিচারকরা। ১৬৫ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার পড়া হয়। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হক পুরো রায়ের সারাংশ পড়ে শোনান। পরে তিনি আসামির বিরুদ্ধে দ- ও ঘোষণা করেন। রায় উপলক্ষে ট্রাইব্যুনালের বাইরে ও ভেতরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। জামায়াত ক্রিমিনাল সংগঠন ॥ আবদুস সুবহানের রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে আবারও একটি ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সুজন বলেন, ট্রাইব্যুনাল বলেছে সকল অপরাধের সঙ্গে আবদুস সুবহানের সংশ্লিষ্টতা ও উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার সময় তিনি পাবনা জেলা জামায়াতের আমির ছিলেন। তিনি পিস কমিটির নেতা ছিলেন। মুজাহিদ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নৃশংসতা চালিয়েছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। তিনি নিজে তরবারি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করেছেন। প্রসিকিউশনের দেয়া সাক্ষ্যে এসব অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল তার পর্যবেক্ষণে জামায়াতকে ফের একটি ক্রিমিনাল সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছেন। দ-ে আমরা খুশি ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কর্তৃক জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুস সুবহানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফেরোজ বলেছেন, আজ আমাদের বিজয় হয়েছে, এটা প্রসিকিউশনের বড় অর্জন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সুবহানকে শাস্তি দিতে পেরেছি। সুবহান ইসলামকে ব্যবহার করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মসজিদ থেকে মুসল্লিদের ধরে এনে হত্যা করেছেন। ট্রাইব্যুনাল বয়স বিবেচনায় না নিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে। বাবা নির্দোষ ॥ ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুস সুবহানের ছেলে নেছার আহমদ নান্নু তার বাবাকে নির্দোষ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা সম্পূর্ণ নির্দোষ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।’ বুধবার দুপুর ১২টায় ট্রাইব্যুনালে রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন। সুবহানের ছেলে বলেন, আমরা এ রায়ে অসন্তুষ্ট। রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপীল করব। যাদের বিরুদ্ধে রায় হয়েছে ॥ ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর যাদের দ- দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতের সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আযাদ (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা (আমৃত্যু কারাদ- (আপীলে মৃত্যুদ-,পরবর্তীতে রায় কার্যকর), জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (মৃত্যুদ-) আপীলে আমৃত্যু কারাদ-, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান (মৃত্যুদ-) আপীল বিভাগেও মৃত্যুদ- বহাল। বুধবার পূর্ণাঙ্গ রায় বেরিয়েছে, জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম (৯০ বছরের কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (মৃত্যুদ-), বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (মৃত্যুদ-), বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম (আমৃত্যু কারাদ-) অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ, বদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মাঈনুদ্দিন এবং মোঃ আশরাফুজ্জামান খান (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী (মৃত্যুদ-), জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাশেম আলী (মৃত্যুদ-), বিএনপি নেতা নগরকান্দা পৌর মেয়র জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার (মৃত্যুদ-), আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোঃ মোবারক হোসেন (মৃত্যুদ-), জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (মৃত্যুদ-), জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম (মৃত্যুদ-)। মামলার কার্যক্রম ॥ ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সকালে আবদুস সুবহানকে গ্রেফতার করা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউশন পক্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আবদুস সুবহানকে আটক দেখানোর আদেশ চায় আদালতের কাছে। ২৬ সেপ্টেম্বর পাবনা কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয় সুবহানকে। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউশনের আবেদন আমলে নিয়ে সুবহানকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে সুবহানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে তদন্ত সংস্থা। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রসহ ৮ ধরনের ৯টি মানবতাবিরোধী অপরাধে সুবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে ট্রাইব্যুনাল-১। ২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর ও ২৪ নবেম্বর অভিযোগ গঠনের বিপক্ষে ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আসামিপক্ষে শুনানি করেন সুবহানের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও আইনজীবী এ্যাডভোকেট এসএম শাহজাহান। অন্যদিকে ৯ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করে প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন। গত ২৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-১ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করে। গত ১ এপ্রিল সুবহানের বিরুদ্ধে সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমন। গত ৭ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুবহানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুই তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও মো. নূর হোসাইনসহ রাষ্ট্রপক্ষের ৩১ সাক্ষী। যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন ॥ সুবহানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুই তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও মো. নূর হোসাইনসহ প্রসিকিউশনপক্ষের ৩১ জন সাক্ষী। তাদের মধ্যে অভিযোগভিত্তিক ঘটনার ২৭ সাক্ষী হলেন- সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী আ ত ম শাহিদুজ্জামান নাসিম, শহীদপুত্র মুক্তিযোদ্ধা তহুরুল আলম মোল্লা, মো. আবু আসাদ, রুস্তম আলী, মো. ইসরাইল, কোরবান আলী, শহীদ জায়া জাহানারা বেগম, আশরাফ উদ্দিন মিয়া, মো. রিয়াজ উদ্দিন ম-ল, সানোয়ারা খাতুন, মো. ফজলুর রহমান ফান্টু, আবদুর রহমান সরদার, শহীদ পরিবারের সদস্য মো. আবদুল মতিন, মোঃ আজিজুল সরদার, মমতাজ উদ্দিন মন্টু, আক্কাছ শেখ, শহীদপুত্র আলী রানা শেখ, আবদুল আজিজ, নিজাম উদ্দিন খান, হোসেন সরদার, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদপুত্র মো. শহিদুল্লাহ শহিদ, এসএম সামছুল আলম, মোঃ খোরশেদ আলম, শহীদপুত্র মো. সামছুল আলম, আবদুল বাতেন, মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল হক এবং এস কে শহীদুলাহ। আর জব্দ তালিকার দুই সাক্ষী হচ্ছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার গ্রন্থাগারিক আনিসুর রহমান ও বাংলা একাডেমির সহকারী গ্রন্থাগারিক এজাবউদ্দিন মিয়া। অন্যদিকে সুবহানের পক্ষে ৩ জন সাক্ষী সাফাই সাক্ষ্য দেবেন বলে ট্রাইব্যুনাল নির্ধারণ করে দিলেও কোন সাফাই সাক্ষী হাজির করেনি আসামিপক্ষ। যত অভিযোগ ॥ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আবদুস সুবহানের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রসহ ৮ ধরনের নয়টি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ অভিযোগ-১ : একাত্তরে সহযোগী জামায়াত নেতা ও বিহারিদের নিয়ে পাবনার ঈশ্বরদীতে জামে মসজিদে আশ্রয় নেয়া স্বাধীনতাকামী মানুষদের অপহরণ করে হত্যা করেন সুবহান। অভিযোগ-২ : ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সুবহানের নেতৃত্বে ও উপস্থিতিতে ঈশ্বরদীর যুক্তিতলা গ্রামে হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে তিনজনকে গুরুতরভাবে আহত এবং পাঁচজন নিরস্ত্র লোককে হত্যা করা হয়। অভিযোগ-৩ : ১৯৭১ সালের ১৬ মে ঈশ্বরদীর অরণখোলা গরুরহাট থেকে দুইজনকে অপহরণ করে পাবনার ঈশ্বরদীতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করেন সুবহান। অভিযোগ-৪ : ২ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঈশ্বরদীর সাহাপুর গ্রামে অসংখ্য বাড়ি-ঘরে লুটপাট ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে। অভিযোগ-৫ : ১১ মে সুবহানের নেতৃত্বে ও উপস্থিতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পাবনা সদর থানার কুলনিয়া ও দোগাছি গ্রামে হামলা চালিয়ে সাতজন নিরীহ-নিরস্ত্র, স্বাধীনতাকামী লোককে হত্যা এবং কয়েকটি বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়। অভিযোগ-৬ : ১২ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি বিরাট বহর সুজানগরের কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে তিন-চারশ’ মানুষকে হত্যা এবং বিভিন্ন বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালায় ও পুড়িয়ে দেয়। অভিযোগ-৭ : ২০ মে সুবহানের নেতৃত্বে পাবনা সদর থানার ভাড়ারা গ্রামে ১৮ জনকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। শহীদদের মধ্যে একজনকে ওই গ্রামের একটি স্কুলে হত্যা করা হয়। বাকি ১৭ জনকে সদর থানার নূরপুর বিদ্যুতকেন্দ্রে নিয়ে নির্যাতনের পরে আটঘরিয়া থানার দেবোত্তর বাজারের পাশে বাঁশবাগানে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযোগ-৮ : ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে আতাইকুলা থানার (সাবেক পাবনা সদর থানা) দুবলিয়া বাজার থেকে দুইজন স্বাধীনতাকামী লোককে অপহরণ করে কুচিয়ামাড়া গ্রামে একটি মন্দিরের ভেতরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করেন সুবহান। অভিযোগ-৯ : ৩০ অক্টোবর রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে ঈশ্বরদীর বেতবাড়িয়া গ্রামে হামলা চালিয়ে কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেন এবং চারজনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেন। কে এই সুবহান ॥ আসামির নাম আবদুস সুবহান ওরফে আবুল বসর মোহাম্মদ সুবহান মিয়া ওরফে মাওলানা সুহান। বয়স ৭৫ বছর। পিতার নাম- মৃত শেখ মোঃ নঈম উদ্দিন, মাতাÑ মৃত নুরানী বেগম । স্থায়ী ঠিকানা- সাং- হাজী মহসীন রোড, গোপালপুর পাথরতলা, থানা সদর, জেলা পাবনা। এবং উত্তর মাছিমপুর, প্রশান্তি ভবনের পশ্চিমে , মহাসড়কের উত্তরে থানা সদর, জেলা পাবনা। বর্তমান ঠিকানা বাসা নংÑ ৭/বি ‘মহুয়া’ ৭ম তলা, ম্যাগনোলিয়া এ্যাপার্টমেন্ট, ৮৯ সেনপাড়া পর্বতা, থানা মিরপুর, ঢাকা। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পাবনা জেলার সুজানগর থানার কাদুয়ার তৈলকন্ডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ে রয়েছে। শিক্ষাজীবন শুরু হয় সুজানগর থানার রামচন্দ্রপুর মন্তব্যে। পরে মানিকহাট ও মাছপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি উলট মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৪৭ সালে জুনিয়র পাস করেন। শিবপুর মাদ্রাসা থেকে ১৯৫০ সালে আলিম, সিরাজগঞ্জ মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে ফাজিল এবং ১৯৫৪ সালে কামিল পাস করেন। ১৯৫২ সালে হেড মাওলানা হিসেবে তিনি পাবনা আলিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করেন। এর পর তিনি গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউট ও আরিফপুর উলট সিনিয়র মাদ্রাসায় সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। মাওলানা আবদুস সুবহান ছাত্র জীবন থেকে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে তালেবায়ে আরাবিয়ার পাবনা জেলার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন পাবনা জেলার জামায়াতে ইসলামের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন। পরে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এমএনএ নির্বাচনে (পাবনা-৬) আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আমজাদ হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি (জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আবদুস সুবহান) পরাজিত হন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তান শাসকের দোসর ছিলেন এবং পাবনা জেলার প্রথম শান্তি কমিটির সেক্রেটারি এবং দ্বিতীয় শান্তি কমিটির সহসভাপতি এবং রাজাকার বাহিনীর মূল সংগঠক ও নেতা ছিলেন। এই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান সেনা শাসকের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তা কর্তৃক ঘোষিত শূন্য আসনের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বি^তায় এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালে পাবনা সদর আসনে এমপি নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদের জামায়াতের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে পাবনা সদর আসন থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদের নায়েবে আমির।
×