ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহা

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং শহীদ ড. শামসুজ্জোহা

শহীদ ড. শামসুজ্জোহা বাঙালীর বীরত্বময় গৌরবগাথা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন, তাঁর রক্তের পথ ধরেই পতন ঘটেছে লৌহমানব সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের, এসেছে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে বাঙালীর বিজয়, মুক্ত হয়েছেন বাঙালীর অবিসংবাদিত মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর সহযোগীরা আগরতলা ষড়যন্ত্র অভিহিত মামলা থেকে এবং লক্ষ ছাত্র-জনতার ভালবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ মুজিব ভূষিত হন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। জোহা ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলা স্কুলে পড়াশোনা করে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সালে বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। জোহা ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে জোহা বেকারত্ব ঘুচিয়ে পাকিস্তান ড়ৎফহধহপব (অস্ত্র) কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক পদের জন্য শিক্ষানবিস হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ওই বছরই ১৪ ডিসেম্বর গ্রেট ব্রিটেনের সাউথ ওয়েলসে রাজকীয় ড়ৎফহধহপব কারখানায় বিস্ফোরকদ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য যোগদান করেন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত জোহা যুক্তরাজ্যের ওসঢ়বৎরধষ ঈড়ষষবমব ড়ভ ঝপরবহপব ধহফ ঞবপযহড়ষড়মু তে পড়াশোনা করেন এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ই.ঝপ (ঝঢ়বপরধষ) ও ওসঢ়বৎরধষ ঈড়ষষবমব-এর অংংড়পরধঃবংযরঢ় ড়ভ ঃযব জড়ুধষ ঈড়ষষবমব ড়ভ ঝপরবহপব (অজঈঝ) লাভ করেন। পরে ১৯৫৯ সালের ৪ আগস্ট পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ্ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ড়ৎফহধহপব কারখানার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অফিসার এবং পরে ২৩ ফেব্রুয়ারি রসায়ন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনের ওসঢ়বৎরধষ ঈড়ষষবমব-এ উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য একটি স্কলারশিপ পান এবং ১৯৬১ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে থেকে তাঁর গবেষণা কাজের মাধ্যমে পিএইচডি ও ডিইসি ডিগ্রী লাভ করে ফিরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত জোহা শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং এরপর নিযুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে। ৬ দফা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল এক নোটিফিকেশনে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বাঙালীর নয়নের মণি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর সহযোগী ৩৫ সেনা কমকর্তা ও সিএসপি অফিসারকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার উদ্যোগ নেয়া হয় একটি প্রহসনের বিচারের জন্য। ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ শিরোনামে মামলাটি দায়ের হলেও পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পিত প্রচারণায় মামলাটি পরিচিতি পায় ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে। এই মামলার মূল লক্ষ্য ছিল, যে কোন মূল্যে শেখ মুজিবুর রহমানসহ কযেকজনের ফাঁসি নিশ্চিত করা, যাতে বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে রাজনৈতিক অঙ্গন ও ছাত্রসমাজ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচী নিয়ে আন্দোলন অবশেষে বাঁধভাঙ্গা গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে কারফিউসহ সকল দমননীতি উপেক্ষা করে হাজার হাজার বাঙালী ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে এবং আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দেয় সমগ্র পূর্ববাংলায়। এমনি অবস্থায় ১৯৬৯-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে সেনানিবাসে আটক অবস্থায় পাকিস্তানী সেনার এক সদস্য ঠাণ্ডা মাথায় গুলি চালালে রাত ১০টার দিকে গুরুতর আহত সার্জেন্ট জহুরুল হক সিএমএইচে শাহাদাতবরণ করেন। এই ঘটনার পর ঢাকার রাজপথে লাখো জনতার বিস্ফোরণ ঘটে এবং আন্দোলনের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আনাচে-কানাচে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ড. জোহার দায়িত্বে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান চলাকালীন সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যার খবরটি পৌঁছলে সঙ্গে সঙ্গে জোহার নির্দেশে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার বিচার চেয়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি চেয়ে ছাত্ররা ওই দিনই সমগ্র ক্যাম্পাস মিছিলে প্রকম্পিত করে। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রছাত্রীদের বিশাল একটি মিছিল শহরের দিকে রওনা হলে প্রথমে মিছিল থেকে তদানীন্তন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও মুসলিম লীগ নেতা আয়েন উদ্দিনের বাসায় আক্রমণ চালানো হয়। অতঃপর মিছিল সাহেববাজার প্রদক্ষিণ শেষে রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ প্রফেসর আব্দুল হাই-এর বাসায় আক্রমণ চালায়। হাই সাহেবের বাসার সামনের রাস্তায় পুলিশের ছাত্রদের ওপর অবাঙালী অতিরিক্ত এক পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করলে ১০-১২ ছাত্র গুরুতর আহত হয়। আহত ছাত্রদের চিকিৎসা দেয়ার পরিবর্তে বোয়ালিয়া থানায় আনা হলে বিপন্ন-আহত ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য প্রক্টর ড. জোহা তাঁর ভক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে বোয়ালিয়া থানায় হাজির হন এবং ছাত্রদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাতে থাকেন। ফলে পুলিশ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে আহতদের পুলিশভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ড. জোহা সেদিন নিজে পাঁজাকোলা করে আহত ছাত্রদের ভ্যানে তুলে দেন এবং এ সময় তাঁর গায়ের সাদা পোশাক ছাত্রদের রক্তে লাল হয়ে যায়। ওই দিনই সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে তৎকালীন শহীদ মিনারের পাদদেশে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র-শিক্ষক প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা বলেন, ‘সিরাজদ্দৌলাকে অন্ধকূপ হত্যার মিথ্যা দুর্নাম দেয়া হয়েছিল। আজ অন্ধকূপ দেখে এসেছি। ছোট্ট একটা গাড়িতে ১২-১৪ রক্তাক্তদেহী ছাত্রকে ঠাসাঠাসি করে তোলা হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার ছেলের রক্তের দাগ আমার গায়ে লেগেছে, সেজন্য আমি গর্বিত। আমিও যদি একটু এমনি রক্ত দিতে পারতাম....’। সভায় ড. জোহা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এরপর আর যদি গুলি করা হয়, কোন ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে।’ এরপর রাত ৯টার দিকে জিন্নাহ হলের (বর্তমানে শেরেবাংলা হল) সামনে নাটোর রোডে পাবলিসিটি অফিসের একটি জীপগাড়ি থেকে পুলিশ পরদিন সকালে ১৪৪ ধারা জারির কথা মাইকে প্রচার করছিল। উত্তেজিত ছাত্ররা পুলিশের কাছ থেকে মাইকটি কেড়ে নিয়ে জীপে আগুন দিলে পুলিশ পালিয়ে যায়। এদিকে গুজব ছড়ানো হয়, জিন্নাহ হলের ছাত্ররা মাইকসহ একজন পুলিশকে ধরে হলে নিয়ে গেছে। ফলে রাত থেকেই ক্যাম্পাসে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি পূর্বরাত্রির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটে প্রায় হাজার দুয়েক ছাত্রছাত্রী বিভিন্ন হল থেকে এসে সমবেত হয় এবং চারজন করে লাইনে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছিল। পুলিশ ও ইপিআর মিছিলে বাধা দেয়, সেনাবাহিনীর জোয়ানরাও মিছিল ঠেকাতে ছাত্রদের দিকে রাইফেল তাক করে প্রস্তুত। ছাত্ররা যে কোন মূল্যে মিছিল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তাঁরা কর্মরত সেনা অফিসারের সঙ্গে তুমুল বিতর্কে লিপ্ত হন। ড. জোহা সামরিক কর্মকর্তাকে বার বার বলছিলেন, ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা এখনই চলে যাবে ক্যাম্পাসের দিকে।’ কিন্তু অবাঙালী সামরিক অফিসারটিকে প্রথম থেকেই উত্তেজিত মনে হচ্ছিল এবং তিনি বার বার জোয়ানদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলছিলেন। ড. জোহা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অনেক কষ্টে এক সময় ছাত্রদের বুঝিয়ে গেটের ভেতরে পাঠাতে সক্ষম হলেন এবং ছাত্রদের অধিকাংশই তখন গেটের ভেতর হকি গ্রাউন্ডে চলে এসেছে। পরিস্থিতি যখন শান্ত হওয়ার পথে তখনই হঠাৎ করে গুড়ুম গুড়ুম গুলির শব্দ। মুহূর্তের মধ্যেই আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে। প্রথমে ছাত্ররা বুঝতে পারছিল না ড. জোহা ও তাঁর সহকর্মীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। দুপুর ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে খবর আসে ড. জোহাকে প্রথমে কাছ থেকে গুলি ও পরে বেয়নেট চার্জে ক্ষতবিক্ষত করা হয় এবং তিনি মরণাপন্ন অবস্থায় রাজশাহী পৌরসভার একটি পুলিশভ্যানে প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে পড়ে আছেন। পরে ডিসি সাহেবসহ কিছু সিভিল অফিসার সেখানে এলে তাঁদের নির্দেশে ড. জোহাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়ে ছাত্র-জনতা ভিড় জমায় হাসপাতালে। ইতোমধ্যেই অনেক দেরির কারণে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটায় অপারেশন থিয়েটারে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন ড. দত্ত। দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে ড. জোহা ইন্তেকাল করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখান। এর পরের ইতিহাসতো সকলের জানা। ড. শামসুজ্জোহার রক্তস্নাত পথ ধরে গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]
×