ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপে ঘটনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট

ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে রামুতে আবারও নাশকতার অপচেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে রামুতে আবারও নাশকতার অপচেষ্টা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব ছড়িয়ে কক্সবাজার জেলার রামু শহরে ২০১২ সালে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় ও পাড়াগুলোতে সাম্প্রদায়িক যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় সেই আদলে আবারও এর পুনরাবৃত্তির অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকে আবারও পবিত্র কোরান অবমাননার বানোয়াট একটি ছবি প্রদর্শন করে উগ্র ধর্মান্ধদের রাস্তায় নামানোর নীলনক্সা তৈরি হয়েছিল। সোমবার রাতে ফেসবুকে পবিত্র কোরান অবমাননার বানোয়াট একটি ছবি ডাউনলোড করে আবারও প্রচার চালিয়েছে ষড়যন্ত্রকারীরা। কিন্তু প্রশাসনের কঠোর মনোভাব কড়াকড়ি টহল জোরদার করায় সুবিধাবাদী দুর্বৃত্তরা সে ফায়দা হাসিলে ব্যর্থ হয়েছে। সোমবার রাতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের টহল তৎপরতা বৃদ্ধি ছাড়াও বৌদ্ধদের প্রতিটি বিহার, হিন্দুদের মন্দিরে গিয়ে ভিক্ষু ও পুরোহিতদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা জানিয়েছেন, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জনৈক উত্তম বড়ুয়ার নামে ফেসবুকে ডাউনলোড করা পবিত্র কোরান অবমাননার বানোয়াট সেই ছবিটি আবার কৌশলে প্রচার করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টির একটি পরিকল্পনা চলেছে। তবে বিষয়টি প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসন ব্যাপকভাবে নজরদারি ও কড়াকড়ি আরোপ করে। এতে করে ঘটনার অবনতি ঘটেনি। বর্তমানে রামুতে বৌদ্ধ বিহারগুলোতে গ্রাম পুলিশের পাশাপাশি আনসার নিয়োগ করা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে পুলিশ, বিজিবির টহল। তবে নতুন করে এ ষড়যন্ত্রের কারণে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে গত বারের ঘটনায় বৌদ্ধবিহারে অগ্নিসংযোগ মামলার সাক্ষীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাক্ষীদের কয়েকজন বলেছেন, বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ ও পাহাড়গুলোতে হামলার ঘটনায় চার্জশীটভুক্ত আসামিদের পক্ষে অব্যাহত হুমকি-ধামকির কারণে এমনিতেই নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, চার্জশীটভুক্ত আসামিদের কয়েকজনকে স্থানীয় এমপির সুপারিশে সরকার দলীয় নেতাকর্মীর তালিকায় স্থান দেয়ার ঘটনায় এ সব আসামিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। স্থানীয় এমপির প্রতিনিধি বলে দাবি করে এ সব দুর্বৃত্তরা মামলার ব্যাপারে মোটেও ভীতু নয়। সরেজমিন পর্যবেক্ষণে জানা গেছে, অযৌক্তিক অবরোধ হরতালে সাধারণ মানুষের সাড়া না পেয়ে ২০ দলীয় জোট ও এদের সহযোগী জঙ্গীরা রামুতে নতুন করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়িয়ে দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। দেশব্যাপী পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা ও চিরতরে পঙ্গু করে দেয়ার চলমান ঘটনায় বৃহত্তর চট্টগ্রাম যেখানে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ পরিবেশের অবস্থানে রয়েছে সেক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীরা সেই রামুকে আবারও নতুন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে প্রশাসন অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বৌদ্ধ বিহারগুলোতে যা ঘটেছিল, তা একাত্তরের হানাদার বাহিনীর দোসরদের কর্মকা-কেও হার মানিয়েছিল। রামুতে ওই সময় ঘটে যাওয়া বৌদ্ধ বিহার ও বড়ুয়া পল্লীতে হামলার ঘটনা ছিল নজিরবিহীন। ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অকুস্থল পরিদর্শনে এসে ব্যথিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সর্বস্তরের নারী-পুরুষদের দুঃখ-বেদনা প্রশমিত করতে তৎপর হন। হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন হারিয়ে চিন্তিত ভিক্ষুরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যা চেয়েছিলেন পরবর্তীতে তার বাস্তবায়ন হওয়ায় তারা উদ্বেলিত ও আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রী রামু ও উখিয়ায় ১২ দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করে দিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ান। এতে রামু তথা কক্সবাজারের পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরবর্তীতে নাশকতাকারী ধ্বংসলীলায় সরাসরি সম্পৃক্তদের অনেকে মামলার সাক্ষীদের শাসিয়ে বলছেÑ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব শেষ করে দিয়েছিলাম। সময় এলে দেখে নেব স্বাক্ষী হওয়ার মজা। এদের ভয়ে মামলার সাক্ষীদের মধ্যে কেউ কেউ এলাকা ছেড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল সরোয়ার কাজল জনকণ্ঠকে বলেন, ফেসবুকে এ জাতীয় খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ বড়ুয়া সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাক্ষাত করে তাদের অভয় দেয়া হয়েছে। দুর্বৃত্তরা যেন নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য স্থানীয় লোকজন নিয়ে প্রতিটি বিহার-মন্দিরে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। ২০১২ সালে সৃষ্ট ঘটনার পর বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি ও দেশ-বিদেশে সংখ্যালঘুদের ক্ষেপিয়ে তুলতে রোহিঙ্গা জঙ্গী ও বিএনপি-জামায়াতীরা রম্যভূমি খ্যাত রামু বৌদ্ধ বিহারগুলো ও বড়ুয়াপল্লীতে নারকীয় তা-ব চালায় বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সরকারীভাবে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহারগুলোকে। পুনঃনির্মিত ওসব বৌদ্ধ বিহার জীবনের পরম ও চরম পাওয়া বলে মনে করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতা নীতিশ বড়ুয়া জানান, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন সোমবার রাতভর সবগুলো বিহার-মন্দির পাহারায় রেখেছিল। রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মাঝে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ভরা কালো রাতের সূচনা হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও আন্তরিক পদক্ষেপের ফলে অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়েছে বলেও জানিয়েছেন অনেক বৌদ্ধ নেতা। দীর্ঘস্থায়ী উপাসনালয় (বিহার) পেয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সরকারের ওপর অত্যন্ত আনন্দিত, ঐ সহিংস হামলার পরবর্তী প্রায় আড়াই বছর পর আবারও ধর্মপ্রিয় লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলার পেছনে কারা জড়িত রয়েছে, এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উর্ধতন কর্র্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। প্রশাসনের পক্ষে জেলা পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিভিন্ন কর্মকর্তা পরিস্থিতি সর্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বলে জানানো হয়েছে।
×