ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অভিমত ॥ পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ

দেশে হরতাল-অবরোধে প্রতিদিন আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। মানুষের আর্তনাদে বার্ন ইউনিটের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কাতরাচ্ছে নিরীহ মানুষ। প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন এলাকায় হরতাল চলছে, আবার দেশব্যাপীও হরতাল চলছে, ইচ্ছেমতো কোন কিছু বিবেচনা না করে হরতাল দেয়া হচ্ছে। বিদ্যুত, গ্যাসের দাম এখনও বাড়ানো হয়নি, তবুও এই নিয়ে হরতাল দেয়া হলো। পরে আবার বলা হলো দাম বাড়ানোর ষড়যন্ত্রের জন্য হরতাল। কি পরিমান উদাসীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে, বিবেক-বিবেচনাহীন হলে এমন ঘোষণা আসতে পারে। এ যেন বালখিল্যতার চরম! গত ২ ফেব্রুয়ারি থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সরকার পরীক্ষা শুরু করতে পারেনি। এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৬ শিক্ষার্থী। আমাদের এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের ভবিষ্যত জড়িয়ে রয়েছে। কারণ তারাই একদিন বড় হয়ে দেশের নেতৃত্ব দেবে। এমন হতে পারে একদিনে পরীক্ষার্থীদের দুটি বিষয়ে পরীক্ষা দেয়া লাগতে পারে। অথচ এজন্য শিক্ষা বোর্ড বা কর্তৃপক্ষসহ অভিভাবকদের কোন দায় নেই, কিন্তু তারা বাধ্য হচ্ছেন পরীক্ষা পেছাতে। বার বার পরীক্ষার সূচী পরিবর্তনের জন্য পরীক্ষার্থীরা রয়েছে উৎকণ্ঠায়, পড়ায় তারা মনোযোগী হতে পারছে না। অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এই অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, অভিভাবকদের শঙ্কা, পরীক্ষার সময় নির্ধারণ নিয়ে অনিশ্চয়তা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এটা খুবই স্বাভাবিক। বার বার রুটিন পরিবর্তন কোমলমতি এই পরীক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং তাদের ফলাফলে তা প্রকাশ পেতে পারে। অথচ এর জন্য তারা কোনভাবেই দায়ী নয়। বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধের কারণে রাষ্ট্র তাদের স্বাভাবিক পরিবেশ প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ সুষ্ঠুভাবে সময়মতো পরীক্ষা দেয়ার অধিকার তাদের রয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষার ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারছে না পরীক্ষার্থীরা। পরীক্ষায় অনিশ্চয়তায় ভুগছেন পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই, যা সত্যি কাম্য নয়। বিভিন্ন মহল, সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষকসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বার বার অনুরোধ জানানোর পরও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট পরীক্ষার সময় অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করেনি। বরং বিএনপি-জামায়াত জোট এসএসসি পরীক্ষাকে তাদের আন্দোলনের নতুন টার্গেটে পরিণত করেছে। পরীক্ষায় বিঘœ ঘটিয়ে তারা সকলকে জিম্মি করতে চায়। সরকারকে চাপে ফেলতে চায়। বাস্তবতা হলো পরীক্ষায় বিঘœ ঘটিয়ে সরকারকে পদত্যাগ করাতে পারবে না, বরং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে বিএনপি ও এর ২০ দলীয় জোট নিজেদের শিক্ষাবিরোধী হিসেবে উপস্থাপন করছে। বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের কাছে মানুষের মানবিক আবেদনের কোন মূল্য নেই। বরং তাদের ব্যবহার ও বক্তব্য অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অমানবিক। বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘কিসের পরীক্ষা, কিসের কী? প্রয়োজনে পরীক্ষা পিছিয়ে দেন।’ যা ১ ফেব্রুয়ারি সকল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই যদি তাদের মানসিকতা তবে গণতন্ত্রের জন্য তাদের আন্দোলন মানায় না, বরং তারা যা করছেন তা সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তবতা হচ্ছে এই, প্রায় ১৫ লাখ এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীর মধ্যে অবশ্যই বিএনপির নেতাকর্মীদের সন্তানরাও রয়েছে, তারাও ভুক্তভোগী হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মী-সমর্থকরা এই মানুষ পোড়ানো, পরীক্ষায় বিঘœ ঘটানো সমর্থন করছে না। এ নিয়ে অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে। শুধু একটি উদাহরণই এখানে যথেষ্টÑ বিএনপির ডাকা অবরোধে পেট্রোলবোমা হামলায় নিহত হয়েছেন বিএনপির এক নেতার পিতা। নিজ পিতাকে হারিয়ে হতাশ বীতশ্রদ্ধ নীলফামারী সদরের লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দলের সভাপতি আবদুল মতিন। পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন তার পিতা আবদুল মালেক। বাবাকে হারানোর পর আবদুল মতিন বলেন, ‘আমি আর বিএনপির রাজনীতি করব না, যে দল করি সেই দলের ডাকা অবরোধ আমার বাবার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এমন সহিংসতার রাজনীতি আমি চাই না। যারা এমন সহিংসতা করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ (সূত্র : বিডিনিউজ২৪.কম, ২৭ জানুয়ারি ২০১৫) কিন্তু অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলোÑ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট কিন্তু ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা অবরোধ আওতামুক্ত রেখেছিল। যদিও তখন সময় পরিবর্তন করে অনেক কষ্ট করে পরীক্ষা দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের এবং সবাই অবরোধের কারণে ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারেনি। ‘ও’ এবং ’এ’ লেভেল পরীক্ষা অবরোধ আওতামুক্ত রেখে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয় বিএনপি ও ২০ দলীয় জোট। ইদানীং অনেকে বলাবলি করছেন, ১৯৯৬ সালেও এসএসসি পরীক্ষা পেছানো হয়েছিল। ’৯৬-এর বাস্তবতা আর ২০১৫-এর বাস্তবতা এক নয়। তখন পরীক্ষা পিছানো কেন হয়েছিল আর কতদিন পেছানো হয় সে তথ্য এখানে উল্লেখ করা অবশ্য বাঞ্ছনীয়Ñ ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন হয় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় সারাদেশে অসহযোগ আন্দোলন। দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়। ২৩ মার্চে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নেতৃত্বে ‘জনতার মঞ্চ’ হয় এবং সরকার পদত্যাগ করা পর্যন্ত অবস্থানের ঘোষণা হয়। আন্দোলনের ফলে ২৬ মার্চ বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে পাস করতে বাধ্য হয় এবং ৩০ মার্চ গণদাবির মুখে বিএনপি সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। সে সময় ২৮ মার্চ এসএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল, তা শুরু হয় ৭ এপ্রিল তারিখে অর্থাৎ মাত্র ১১ দিন পরীক্ষা পেছানো হয়। ১৯৯৬ সালের সে আন্দোলনে জনমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনের দাবির মুখে বিএনপি ও খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। সে সময় আজকের মতো সহিংসতা হয়নি। পেট্রোল দিয়ে মানুষ পোড়ানো হয়নি, যা এখন প্রতিদিন হচ্ছে। সে সময় আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে আন্দোলন করেছে আর বর্তমানে বিএনপি রাতের অন্ধকারে চোরাপোপ্তা হামলা করছে। নিরীহ ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। অন্তঃসত্ত্বা মাকে হত্যা করছে। ’৯৬ সালের আন্দোলন বর্তমানের মতো এত নৃশংস ছিল না। অবরোধের মাঝেই খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মালয়েশিয়াতে মৃত্যুবরণ করে। অবরোধের মধ্যেই তার লাশ ঢাকায় আনা হয় এবং অবরোধ ভেঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীরা তার জানাজায় অংশ নেয়। উল্লেখ্য যে, অবরোধে বিএনপি নেতৃবৃন্দ মাঠে বা রাজপথে অনুপস্থিত থাকলেও কোকোর জানাজায় তারা অবরোধ ভেঙ্গে অংশ নিয়েছে, অনেকে পলাতক আসামি হয়েও জানাজায় অংশ নেয়। তার মানে হলো বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজপথে আন্দোলনে নেই, যা প্রমাণিত। কিন্তু রাতের আঁধারে বাসে-ট্রাকে-ট্রেনে-লঞ্চে আগুন দিয়ে দেশে অরাজকতা করছে, মানুষ হত্যা করছে। এই আগুন দেয়া, মানুষ হত্যা কোন গণতান্ত্রিক কর্মকা- হতে পারে না, আবার মানুষ নিহতের পর বিবৃতি দিয়ে মায়াকান্না কাঁদছে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও তার দুই মেয়ে ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়াতে ফেরত গেছে। ২ ফেব্রুয়ারি যেদিন এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা সেদিন রাতে কোকোর স্ত্রী দুই মেয়েসহ মালয়েশিয়াতে চলে যায়। পারিবারিক ও দলীয় সূত্র থেকে জানা যায়, দুই মেয়ের পরীক্ষা থাকায় তারা চলে যায়Ñ যা সকল গণমাধ্যমে ৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে এবং মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে কোকোর দুই মেয়ে তাদের দাদি বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে যায়। কোকোর লাশ বাংলাদেশে আনা ও তার সন্তানদের বিদেশ ফেরত যেতে সরকার কোন বাধা দেয়নি, কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। তবে কেন দেশের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা শান্তিতে পরীক্ষা দিতে পারবে না? যদি খালেদা জিয়া তার নাতনিদের পরীক্ষার জন্য শোকাতুর অবস্থায়ও বিদেশ পাঠাতে পারেন তবে প্রায় ১৫ লাখ পরীক্ষার্থী কি দোষ করল? তারা কেন নির্বিঘেœ এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না? বেগম জিয়া ও তার দলের রাজনীতি করার যেমন অধিকার রয়েছে,ঠিক তেমনি আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত হতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার অধিকার রয়েছে। লেখক : পরিচালক, সিআরআই ও রাজনৈতিক কর্মী
×