ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারুন হাবীব

সন্ত্রাস, সহিংসতা ও জাতীয় নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ২১:৪৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সন্ত্রাস, সহিংসতা ও জাতীয় নিরাপত্তা

সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামÑমুক্তিযুদ্ধ ’৭১ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মৌল চেতনাসমৃদ্ধ একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানÑ যার সঙ্গে দলীয় রাজনীতিচর্চার কোন সম্পৃক্ততা নেই। প্রতিষ্ঠানটি মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী ঘৃণ্য অপরাধীদের বিচারের দাবিতে অনেক বছর ধরে অব্যাহত আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে। আমরা আনন্দিত যে, সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামসহ অন্যান্য সংগঠনের আন্দোলনের ফলে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আরাধ্য কাজ শুরু হয়েছেÑ যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হচ্ছে যে, দীর্ঘ বিলম্বিত ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়া সত্ত্বেও তা জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। এ যাবত ১৫টি মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু একজন মাত্র যুদ্ধাপরাধীর দ- কার্যকর করা হয়েছে। বাকিরা কেউ মৃত্যুবরণ করেছে, কেউ কেউ আবার বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় চূড়ান্ত দ- লাভ করেনি আজও। সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামÑমুক্তিযুদ্ধ ’৭১ মনে করে যে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর এসব মানবতাবিরোধী অপরাধী যেন আইনী দীর্ঘসূত্রতার জালে চূড়ান্ত দ-প্রাপ্তি থেকে কখনই নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম না হয়, সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মহল, বিশেষত রাষ্ট্র বা ‘প্রসিকিউশন’-এর প্রখর নজরদারি প্রয়োজন। মামলাগুলোর দ্রুত ও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্যে সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম মাননীয় সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে একটি আলাদা বেঞ্চ গঠনের দাবি জানাচ্ছে। আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকটির আয়োজন করা হয়েছে দেশের বিদ্যমান সহিংস রাজনীতি ও অব্যাহত নৈরাজ্যের প্রেক্ষাপটে। আমরা মনে করি, একটি নির্বাচনী বিতর্ককে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে সারাদেশে একমাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত যে সহিংসতা ও অমানবিক নিষ্ঠুরতা চালানো হচ্ছেÑ তা গণতন্ত্রের চর্চা নয়, বরং চরম নৈরাজ্যকর একটি আন্দোলন। বলাই বাহুল্য, সহিংস এই আন্দোলন দেশের পবিত্র সংবিধান ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে সরাসরি আত্মঘাতী এক অপতৎপরতা, যা জাতীয় স্বার্থেই অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। দেশের সকল গণতান্ত্রিক মহল রাষ্ট্রের সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করবে, আইনানুগ সকল দলগোষ্ঠীর সাংবিধানিক ও গণতন্ত্রিক অধিকার রক্ষিত হবেÑ এই আমাদের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। আমরা আরও মনে করি, যে কোন রাজনৈতিক সঙ্কট রাজনীতির পথেই সুরাহা করতে হবে। কিন্তু যখন দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত বর্বরতম, নিষ্ঠুরতম পন্থায় হতাহত হয়, রাজনীতির নামে যখন সাধারণ জনজীবন লাগাতারভাবে বিপন্ন, পর্যুদস্ত ও রক্তাক্ত হয়, অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তা যখন চরমভাবে বিপন্ন হয়, তখন জাতীয় বিবেক হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ এ সংগঠনটি নিশ্চুপ ভূমিকা রাখতে পারে না। চলমান সহিংসতা নিয়ে আমরা ইতোমধেই বিবৃতি প্রচার করেছি এবং শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনসহ অন্যান্য কর্মসূচী পালন করেছি। এসব কর্মসূচীতে সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম পরিষ্কার ভাষায় জানিয়েছে যে, অব্যাহত সহিংস অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচী দিয়ে দেশের জননিরাপত্তা আতঙ্কজনকভাবে বিপন্ন করা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ, বিশেষত রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন সাধারণ পথচারী প্রতিনিয়ত নির্মম পন্থায় হতাহত হচ্ছে। পেট্রোলবোমার আগুনে নিরপরাধ নারী-শিশু, ছাত্রছাত্রী ও খেটে খাওয়া মানুষ প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক বীভৎসতায় অঙ্গার হচ্ছে, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত! ঝটিকা আক্রমণ চালানো হচ্ছে পুলিশ বাহিনীর ওপরও। চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে বাসযাত্রীর ওপর, মালামাল পরিবহনের ট্রাক, ট্রেনসহ প্রতিটি গণপরিবহনে । আমরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছি, এ ধরনের বর্বরতা কখনই গণতান্ত্রিক অধিকার হতে পারে না। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা কোন গণতান্ত্রিক সমাজেই গ্রহণযোগ্য হয় না। চরম বিস্ময়ের সঙ্গে আরও লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, এসব সহিংসতার পৃষ্ঠপোষকরা বরাবর নির্বিকার, তাদের কাছে ভয়াবহ এই মানবিক বিপর্যয়ের বিন্দুমাত্র মূল্য নেই! তারা টঙ্গীর ‘বিশ্ব এজতেমা’, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মানুষ ধর্মীয় কারণে প্রতি বছর যোগ দিতে আসেন, সে উপলক্ষেও তাদের সহিংস কর্মসূচী স্থগিত করার কারণ খুঁজে পাননি! গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়েও তারা সহিংস হরতাল, অবরোধ কর্মসূচী অব্যাহত রেখে লাখ লাখ শিশুর শিক্ষাজীবনও অনিশ্চিত করে চলেছেন! স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের রাজনীতি হবে গণমানুষের সমৃদ্ধি, উন্নত ও মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ এবং জনকল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত। নিছক ক্ষমতার পালাবদলের জন্যে কোন নিষ্ঠুর কার্যক্রম, জনমনে ভীতি সৃষ্টি বা ধ্বংসাত্মক কাজ চালানোর অধিকার কারও থাকতে পারে না। চলমান এই নৃশংসতা, আমরা মনে করি, দৃশ্যতই, একটি নিকৃষ্ট সন্ত্রাসবাদ এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, যাকে কোন রাজনীতি বা গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে ডাকবার সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, প্রায় সকল সুবিবেচক মহলের লাগাতার আবেদন-নিবেদনের পরও সহিংসতা থামানো হয়নি। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটগুলো পেট্রোলবোমায় দগ্ধ মানুষের আহাজারিতে ভরে উঠেছে। কোন রাজনীতিবিদ নন, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মৃত্যুবরণ করছে, পঙ্গুত্ববরণ করছে একের পর এক। ভয়ঙ্কর এক মানবিক বিপর্যয় চাপানো হয়েছে দেশে! দেশের সমস্ত উৎপাদনমুখী শিল্প ও কলকারখানা চরমভাবে বিপন্ন করা হয়েছে। জনজীবনের অনিরাপত্তা ও বিপন্নতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্টারগণ যৌথভাবে বিবৃতি প্রচার করে দেশবাসীকে জানাতে বাধ্য হয়েছেন যে, তাঁরা আর এই ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয়ের রিপোর্ট লিখতে পারছেন না! সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম মনে করে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অব্যাহত সন্ত্রাস ও সহিংসতা জননিরাপত্তাকে যেমন বিপন্ন করেছে, তেমনি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নেও একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতির সুযোগে, আমরা মনে করি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী দেশী-বিদেশী চক্র এবং উগ্র-সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীগুলো নতুন করে জঙ্গীবাদের বীজ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেÑ যা কখনোই মেনে নেয়া যাবে না। মোটকথা, দৃশ্যতই দেখা যাচ্ছে যে, অব্যাহত নৈরাজ্য বা অস্থিতিশীলতার আড়ালে জাতির মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রের পথে ধাবিত করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। একদিকে তারা জাতির দীর্ঘ প্রত্যাশিত যুদ্ধাপরাধ বিচারকে ভ-ুল করতে চায়, মুক্তিযুদ্ধে তাদের ঐতিহাসিক পরাজয়ের শোধ নিতে চায়, একই সঙ্গে চায় বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়। না, কোন দেশপ্রেমিক নাগরিকই এ অবস্থা মেনে নিতে পারেন না। এর থেকে উত্তরণ জরুরী। সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ বা আপোস নয়, কারণ তা সন্ত্রাসকেই বাড়িয়ে তোলে। কাজেই যে কোন মূল্যে জঙ্গী বা সন্ত্রাসী কর্মকা- রুখতে হবে। যারা বাংলাদেশের মাটিতে ‘সিভিল ওয়ার’ শুরুর পাঁয়তারা করছে, তাদের চিহ্নিত ও প্রতিহত করতে হবে। ফোরাম মনে করে, সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। জননিরাপত্তা রক্ষায় সরকারকে সকল আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এ দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সাংবিধানিকভাবে ন্যায়নিষ্ঠ, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন হতে হবে । সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, রাজনীতির নামে যারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, সন্ত্রাসবাদী ছাড়া তাদের দ্বিতীয় কোন পরিচয় নেই। এ বর্বরতার দায় রাজনৈতিক অধিকারের নামে এড়ানো যাবে না। সে কারণেই ফোরাম মনে করে, অপরাধীদের চিহ্নিত, কার্যকরভাবে দমন ও তাদের দ্রুত বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম দেশে প্রকৃত ও কার্যকর গণতন্ত্র দেখতে চায় এবং বিশ্বাস করে যে, রাজনৈতিক সঙ্কট শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পথেই সমাধান করতে হবে, সহিংসতা বা নৈরাজ্যের পথে নয়। আমরা ঘোষণা করছি যে, অবিলম্বে যদি সন্ত্রাস ও বর্বরতা বন্ধ করা না হয়, জননিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম একাত্তরের রণাঙ্গনের সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী প্রতিটি শ্রেণীপেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলমান নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সারাদেশে সর্বাত্মক গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলবে। এই গণপ্রতিরোধে আমরা সকল দেশপ্রেমিক মহলের সহযোগিতা কামনা করি। আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকটি চলমান জাতীয় সঙ্কটের একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে সহায়ক হবে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত ও জনপ্রতিরোধ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেÑ সর্বান্তকরণে আমরা সে আশাই রাখছি। (সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামÑমুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর গোলটেবিলে পঠিত মূল প্রবন্ধ) ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৫ লেখক : ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামÑমুক্তিযুদ্ধ ’৭১
×