ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লাড ব্যাংকের রক্তে জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ব্লাড ব্যাংকের রক্তে জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত

নিখিল মানখিন ॥ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলো বা ব্লাড ব্যাংকগুলোতে সংগৃহীত প্রায় সাড়ে ছেচল্লিশ হাজার ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের কারণে একজনের জটিল রোগ আরেকজনের শরীরে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। রক্তদান একটি মহৎ সেবা। কিন্তু অনিরাপদ রক্তই আবার মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেশের শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র অনুমোদনহীন। রক্ত সংগ্রহের সময় বাধ্যতামূলক পাঁচটি পরিসঞ্চালন সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয় না শতকরা ৫০ ভাগ কেন্দ্রে। হেলথ বুলেটিন-২০১৪ অনুযায়ী এ তথ্য জানা গেছে। হেলথ বুলেটিন-২০১৪ এ বলা হয়েছে, গত ২০১৩ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৪ ইউনিট রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪০ ইউনিটে এইচআইভি পজিটিভ, ৩৬ হাজার ২৯১ ইউনিটে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, ৪ হাজার ৭০৬ ইউনিটে হেপাটাইটিস সি পজিটিভ, ৩ হাজার ৯৫০ ইউনিটে সিফিলিস ও ১ হাজার ৩৪৪ ইউনিট রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা পড়ে। তবে বেসরকারী হিসেবে দূষিত রক্তের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বুলেটিনে বলা হয়, গত ২০১৩ সালে পরীক্ষা করা রক্তের মধ্যে ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত রক্তের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৯১ ইউনিট, যা ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। ২০১৪ সালেও প্রায় ৪৫ হাজার ইউনিট রক্তে বিভিন্ন জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে, যা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান সরকার চিকিৎসার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রক্তের প্রয়োজনে জীবাণুমুক্ত নিরাপদ রক্তই রোগীকে নতুন জীবন দিতে পারে। অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এ সব জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকা এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত গ্রহণ করা। সারা বিশ্বে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন গড়ে তোলা দরকার। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, প্রতি চার মাস অন্তর একজন সুস্থ ব্যক্তি রক্ত দান করতে পারে। স্বেচ্ছায় রক্তদান সর্বোত্তম সেবা। স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে বারডেমের পক্ষ থেকে একটি কোটপিন দেয়া হয়। ভলান্টারি ডোনার কার্ড দেয়া হয়, যা রক্ত দানের ছয়মাস পর থেকে যেকোন রক্তের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডোনারের জন্য সেবা প্রদানে বাধ্য থাকে। ডা. আবদুল্লাহ বলেন, রক্তদানের আগে ডোনারদের এ্যালকোহল পান বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। রক্তদানের আধ ঘণ্টা পূর্বে চা কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। খাবার গ্রহণ করে আসতে হবে। সুস্থ ব্যক্তি আদর্শ রক্তদাতা। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হাঁপানি, জ্বর ইত্যাদি থাকলে রক্ত দান থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি আরও জানান, রক্তদানের পর ডোনারকে তরল জাতীয় খাবার (যেমন জুস) গ্রহণ করা দরকার। প্রচুর(প্রায় তিন লিটার) পানি/পানীয় পান করা উচিত। নিতে হবে বিশ্রাম। ভারি কাজ, গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আর দুধ জাতীয় খাদ্য রক্ত দানের এক ঘণ্টা পর খেতে পারেন। দেশের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর ওপর দু’ বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর করুণ অবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র। এ সব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো অবাণিজ্যিক বেসরকারী উদ্যোগ। গবেষণায় তালিকাভুক্ত ২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৭টির কাছে রক্তের বিভিন্ন উপাদান পৃথকীকরণের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচীতে(এসবিটিপি) তালিকাভুক্ত নয় এমন সব প্রতিষ্ঠানে রক্ত পরিসঞ্চালনের সুবিধা নেই। বাণিজ্যিক ও অ-বাণিজ্যিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কর্মীর সংখ্যা সরকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শতকরা ৬২ ভাগ কম রয়েছে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে রক্তদাতা নির্বাচন ও উপযোগিতা নিশ্চিতকরণ, রক্ত সংগ্রহ, পরীক্ষা, দাতা-গ্রহীতা মেলানো, পরিসঞ্চালন ও রক্ত মজুদ করা, কর্মী প্রশিক্ষণ, শরীর ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত করণীয়, উপকরণ ব্যবহার ও তার পরিচর্যা- এসব বিবষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখার কথা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোতে এবং কয়েকটি সরকারী কেন্দ্রেও এই নির্দেশনার কপি পাওয়া যায়নি। শুধু কর্মীরা নন, কেন্দ্রগুলোর প্রধানরাও রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ক বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। শতকরা ৪৭ ভাগ কেন্দ্রে কোন পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত পরিসঞ্চালনের কাজ চলে। একটি সরকারী কেন্দ্রেরও নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন (বিটিএস) বিষয়ে কোন লাইসেন্স নেই। এ ধরনের লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে সরকারী এবং অ-বাণিজ্যিক রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের শতকরা ৬৫ ভাগ। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
×