ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বইয়ের সঙ্গে একগুচ্ছ গোলাপ, ভালবাসার রঙ মাখা দিন

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বইয়ের সঙ্গে একগুচ্ছ গোলাপ, ভালবাসার রঙ মাখা দিন

মোরসালিন মিজান ॥ ফাগুনের প্রথম দিনে দারুণ জমে উঠেছিল মেলা। তার পর শনিবার ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন ডে। প্রেম নিবেদনের, ভালবাসাবাসি উদ্যাপনের চমৎকার এই দিনে যথারীতি মুখরিত ছিল বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান। অমর একুশে গ্রন্থমেলার উভয় ভেন্যুতে পাঠকের ছিল উপচেপড়া ভিড়। বসন্ত বরণের দিনে শুক্রবার মেলার রং হয়েছিল বাসন্তী। হলুদ গাঁদার রঙে সেজেছিল চত্বর। রাত পোহাতেই বদলে যায় সব। মেলার ১৪তম দিনে প্রাধান্য পায় ভালবাসার রং। গোলাপের লালে সেজে আসে তরুণ-তরুণীরা। অপেক্ষাকৃত বড়রাও মনে সবুজ আর পোশাকে লাল রং ধারণ করেন। শনিবার শিশু প্রহর থাকায় সকাল ১১টায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। দুপুরের আগে সরব হয়ে ওঠে একাডেমি অংশের শিশু কর্নার। শিশু প্রহর উপলক্ষে এখানে এসেছিল ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। বাবা-মা অভিভাবকরা তাদের নিয়ে মেলায় আসেন। সকালে লোকসমাগম কম থাকায় বাচ্চারা মজা করে বই দেখেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অর্নি মোটামুটি সব স্টল ঘুরে দেখে ফেলেছিল। কেমন লাগছে? জানতে চাইলে তার জবাবÑ এ কয়দিন তো শুধু টেলিভিশনে দেখেছি বইমেলা। আজকে প্রথম এসেছি। তাই খুব ভাল লাগছে। কয়েকটি কার্টুনের বই কিনেছি। তারপর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন কিনবে বলে জানায় সে। বেসরকারী একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা আরিফুর রহমান এসেছিলেন তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে। বললেন, সন্তানকে বইমেলার সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে আসা। বাচ্চাও বেশ আগ্রহ নিয়ে সিসিমপুরের চরিত্রগুলো দেখছিল। দুপুরের দিকে বেশ রোদ থাকায় সাধারণ পাঠকও বাংলা একাডেমি চত্বরে অনেকটা আশ্রয় নিতে আসেন। বিশাল বটবৃক্ষের নিচে বসে গল্প করে সময় কাটান তাঁরা। কবিতার সঙ্গে প্রেম বিকেলের দিকে ভিড় বাড়ে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। মেলার এ অংশে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বইয়ের সঙ্গে ভালবাসা দিবসের আবেগ অনুভূতি যোগ হয়। অনেকের হাতেই দেখা যায় বই আর একগুচ্ছ গোলাপ। সত্যি দেখার মতো দৃশ্য! বিভিন্ন স্টলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভালবাসার দিনেও বেশি বিক্রি হয়েছে উপন্যাস। তবে কবিতার চাহিদা বিশেষ চোখে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এবার খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহাসহ কয়েকজনের নতুন বই এসেছে। রয়েল পাবলিশার্স থেকে এসেছে সৈয়দ হকের ‘বিরতিহীন উৎসব’। অনন্যা থেকে এসেছে মহাদেব সাহার ‘ভুলে যাওয়ার চেয়ে ভালো কিছু নেই’। একই কবির মাওলা ব্রাদার্স থেকে এসেছে ‘কে জড়ালো এই যন্ত্রজালে’ ও বিচ্ছেদ ব’লো না, একসাথে লক্ষ লক্ষ বজ্রপাত হবে। কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আনিসুল হকের কাব্যগ্রন্থ ‘ভালবাসার কবিতা’। অনিন্দ্য থেকে এসেছে মাহবুব আজীজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঠিক সন্ধ্যার আগে’। স্টলে স্টলে এসব বইয়ের প্রদর্শনী চোখে পড়েছে। বিক্রিও হয়েছে ভাল। আর সব সময়ের মতোই বিক্রি হয়েছে হেলাল হাফিজ ও নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই। হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ এদিনও মেলা অধিকার করে রেখেছিল। দুই বছর আগে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিভাস থেকে আসে বর্ধিত সংস্করণ ‘কবিতা একাত্তর’। বইয়ের প্রকাশক রামশংকর দেবনাথ জানান, ভালবাসা দিবসে অন্য অনেক বইয়ের চেয়ে এ বইটি বেশি কিনেছেন পাঠক। বিশেষ দিবস হওয়ায় প্রিয়জনকে অনেকেই বই উপহার দিয়েছেন। নতুন কেনা বইয়ের গায়ে মিষ্টি কথা লিখে ভালবাসার মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন। সোহানা নামের এক তরুণী মেলার এক কোণে বেঞ্চে বসে বইয়ের গায়ে কি যেন লিখছিলেন। জানতে চাইলে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ওকে লিখছি। এর পর আর বোঝার বাকি থাকে না কি সেখানে লেখা হচ্ছে! কেউ কেউ আবার কবিতার বই খুলে প্রিয় লাইনগুলো আবৃত্তির চেষ্টা করছিলেন। সব মিলিয়ে অন্যরকম একটি দিন। ১৪৭টি নতুন বই ॥ বাংলা একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগের দেয়া তথ্যমতে, শনিবার ভালবাসা দিবসে নতুন বই এসেছে ১৪৭টি। এর মধ্যে রয়েছে ২৯টি গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস ৩৬, প্রবন্ধ ৩, কবিতা ৩৬, গবেষণা ২, ছড়া ৫, জীবনী ৩, ভ্রমণ ৪, ইতিহাস ১, স্বাস্থ্য বিষয়ক ৪, ধর্মীয় ১, অনুবাদ ২ এবং অন্যান্য বিষয়ে ১৬টি। এছাড়া নজরুল মঞ্চে ১২টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মেলায় চতুর্দশ দিন পর্যন্ত মোট নতুন বই এসেছে ১ হাজার ৯২৯টি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ শনিবার সকালে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোরদের সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় সাধারণ জ্ঞান বিভাগে ১ম হয়েছেনÑ দীপান্বিতা বিশ্বাস শৈলী, ২য়-হোসাইন এবং ৩য় হয়েছেন আকিবা আফরোজ। খ-শাখায় উপস্থিত বক্তৃতা বিভাগে প্রথম হয়েছেন ফারিয়া তাসনিম, দ্বিতীয়-নামিরা রহমান অন্তনা এবং তৃতীয় হয়েছেন আনাম আবরার। এতে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খায়রুল আলম সবুজ, অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও শাহিদা খাতুন। প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন একাডেমির উপপরিচালক মুর্শিদুদ্দিন আহম্মদ। বিকেলে মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রায়হান রাইন। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম ও অধ্যাপক জিয়া রহমান। সভাপতিত্ব করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রাবন্ধিক বলেন, সরদার ফজলুল করিমের দর্শনে আমরা এই সত্য পাই যেÑ জীবন জয়ী হবে, মানুষ স্বপ্ন দেখে বলেই। আমরা স্বপ্নের দিকেই এগিয়ে যাই। সরদার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে আমাদের সংকটকে খুব স্পষ্ট দেখতে পেতেন। আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটের মূলে তিনি আবিষ্কার করেছেন শ্রেণীচরিত্রহীন মধ্যবিত্তকে। তিনি মনে করেন আমাদের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান এই মধ্যবিত্তের হাতে নেই, আছে নিপীড়িত মানুষের হাতে। সেই নিপীড়িত মানুষ যে সঙ্কট সমাধানে এগিয়ে আসবে, নতুন নেতৃত্ব তৈরির শর্তগুলো সৃষ্টি হবে, এমন রাজনীতির সক্রিয় উপস্থিতিই সরদার ফজলুল করিমের স্বপ্নকে সফল করতে পারে। আলোচকবৃন্দ বলেন, সরদার ফজলুল করিম মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন লড়াই করে গেছেন। তিনি জ্ঞানের চর্চাকে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। একদিকে যেমন দর্শনের বিশ্বখ্যাত পুস্তকসমূহ বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালী পাঠকের সঙ্গে বিশ্বমনীষার যোগ ঘটিয়েছেন অন্যদিকে সাংগঠনিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরদার ফজলুল করিম দর্শন ও তত্ত্বের পরিসরের সঙ্গে অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের পরিচয় ঘটিয়েছেন। কিন্তু এই কাজে ব্যাপৃত থেকে সমাজবিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবীতে পরিণত হননি। মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষে তিনি সাম্যবাদী রাজনৈতিক তৎপরতায় নিজে সক্রিয় ছিলেন, তরুণ প্রজন্মকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন সমাজের মানবিক রূপান্তরের স্বপ্নে। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিদিনের সংগ্রামে ও স্বপ্নে সরদার ফজলুল করিম চির-ভাস্বর হয়ে থাকবেন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সুলতানা হায়দারের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করে সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন। একক কণ্ঠে গান শোনান খুরশিদ আলম, আঞ্জুমান আরা শিমুল, নবীন কিশোর, হাসান মাসুদ, সুমনা হক, খালেদ মুন্না, সোমা হক, মাহবুব আর বিপাশা ও এসএম মেজবাউদ্দীন। আজকের আয়োজন ॥ আজ রবিবার মেলার পঞ্চদশ দিনে বিকেল চারটায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় অধ্যাপক সালাহ্উদ্দীন আহ্মদ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোচনায় অংশ নেবেন শামসুল হোসাইন, মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান, নিশাত জাহান রানা ও মৃত্তিকা সহিতা। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক মাহ্মুদ শাহ কোরেশী।
×