ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্তমান সঙ্কট এবং আমাদের সুশীল বন্ধুরা

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বর্তমান সঙ্কট এবং  আমাদের সুশীল বন্ধুরা

সম্প্রতি দেশের অতি পরিচিত কিছু মানুষ যাদের আমাদের সমাজে সুশীল হিসেবে অভিহিত করা হয়, তাঁরা এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ড. কামাল হোসেন, যাঁকে আমার মতো অনেকেই শ্রদ্ধা করতেন। সার্বিক দিক দিয়ে তিনি যে তাঁর পূর্বেকার হিতৈষীদের থেকে কতদূরে সরে গেছেন সেটা তিনি বুঝতে পারছেন কিনা জানি না। কয়েক বছর আগে তিনি যখন কানাডাতে এসেছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে একান্তে কয়েক ঘণ্টা কথা হয়েছিল আমার। একপর্যায়ে তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনাকে মানুষ ভোট না দিলেও আপনি যখন কথা বলেন মানুষে সেটা বিশ্বাস করে।’ কিন্তু আজকে তিনি মানুষের সে বিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছেন কিনা সন্দেহ। ওই সুশীল সমাবেশে কয়েকজন সমাজের প্রতি সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন, তাঁরা অনেক সুন্দর কথা বলেছেন। যাঁদের মধ্যে একজন বর্তমান দেশের অবস্থা বলতে যেয়ে বললেন, ‘নৈতিক অধঃপতন ও বুদ্ধির বিকৃতি না ঘটলে কোন মানুষ অন্য কাউকে পেট্রোলবোমা মেরে জ্বালিয়ে দিতে পারে না।’ এ বক্তব্য দিয়ে তিনি আজকের বীভৎস বাংলাদেশের বিবেকের প্রতিধ্বনি করেছেন। কিন্তু সমস্বরে প্রথম ওই সভায় প্রধান বক্তব্য হওয়া উচিত ছিল কিভাবে এ দানবরূপী রাজনীতিকদের পেট্রোলবোমা মেরে সাধারণ মানুষকে হত্যার মহোৎসব থেকে নিবৃত করা। তথ্যমন্ত্রী বন্ধুবর হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘কতিপয় বুদ্ধিজীবী সংলাপ নিয়ে যতটা সরব, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার বিরুদ্ধে ঠিক ততটাই নীরব। দেশ ও মানুষের জন্য ওই বুদ্ধিজীবীদের সামান্য মায়া থাকলে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা বন্ধ করতে বলতেন।’ অথচ এদের একজন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দিলেন, ভাবখানা নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির ইন্ধন রয়েছে এবং তিনি আদেশ দিলেই হত্যার এ মহোৎসব বন্ধ হয়ে যাবে। ওই সুশীল সভায় এমন দুই-একজন ব্যক্তি ছিলেন যাঁরা আওয়ামী লীগের প্রতি চরম বিদ্বেষের কারণে বিএনপির প্রতি এতটাই একচোখা তাদের বলা যায়, ‘পোপের থেকেও বড় ক্যাথোলিক’, তাদের একজন হলেন সুজন নামক একটি সংস্থার আজীবন সম্পাদক। ভদ্রলোক কোন চাকরিবাকরি না করেও কিভাবে জীবন চালাচ্ছেন সেটা আমার মতো সাধারণ মানুষের জানা থাকার কথা নয়। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার’ শেষ করার দাবিটিও আনলেন অন্যান্য দাবি-দাওয়ার মাঝখানে। অথচ তিনিই ছিলেন আদালত অবমাননার দায়ে ব্রিটিশ নাগরিক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের দণ্ড হওয়ার পর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দেয়া ৫০ নাগরিকের মধ্যে যে ১৪ জন ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, তাঁদেরই একজন। এ নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়া ব্যক্তিরা অবশ্য প্রতিদিন টেলিভিশনে এসে দেশবাসীকে ন্যায়-অন্যায়ের সবক দান করেন। তাদের এসব সবক আসলে দেশের মানুষের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা! এদের মধ্যে রয়েছেন আর দুই সুশীলÑ একজন হলেন এক ‘প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ এবং অন্যজন হলেন আইনের এক ‘প্রখ্যাত অধ্যাপক’। শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার উপদেশ বিএনপিকে দিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা শুরু থেকে, বিভিন্ন টকশো এবং লেখাতে। সুজন সম্পাদক সাহেব দিন কয়েক আগে প্রথম আলোতে এক নিবন্ধ লিখেছেন কি এবং কতভাবে খালেদা জিয়ার নাগরিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। নিরীহ মানুষকে কিভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে সেটা খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁর ভালবাসার কারণে তাঁর লেখায় স্থান পায়নি। তিনি লিখেছেন, ‘৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সরকার বলপ্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার এবং গত ৩ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়াকে ইট-বালুর ট্রাক দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। তার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির পক্ষ থেকে দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধের ডাক দেয়া হয়, যা ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে বিভিন্ন নাগরিক সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বিচ্ছিন্ন করার রাজনীতিতে লিপ্ত হয়ে ক্ষমতাসীনরা নিজেরাই যেন ক্রমাগতভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।’ যে নেত্রী দেশের ১৬ কোটি মানুষের নাগরিক অধিকার থেকে তাদের জীবনধারণের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, ২ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধকে বোমার আগুনে পুড়িয়ে মারছেন, তাঁর নাগরিক অধিকার নিয়ে এ সুশীল মহোদয়ের হৃদয় উথলে উঠেছে। আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে কোন রাজনীতিবিদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া এই কি প্রথম? তার বিপরীতে ওই সব রাজনীতিবিদের সমর্থকরা কি সাধারণ মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছেন, পুড়িয়ে মারা তো অনেক দূরের কথা। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমার বিনীত অনুরোধ থাকবে এ ধরনের ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিরা যেন বঙ্গভবনে প্রবেশ করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তাদের সম্মান বৃদ্ধির সুযোগ না পায়। ইতোমধ্যে এক সাংবাদিক সম্মেলনে শামসুল হুদা ১১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেছেন। সে লিস্টে ‘প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ’ এবং ‘সুজনের’ আজীবন সম্পাদক ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। উপরে উল্লিখিত এ দু’জনের নিরপেক্ষতার কিঞ্চিৎ উদাহরণের বাইরে এদের টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে দেশবাসীকে ওয়াজ-নসিহতের কিছুটাও কেউ শুনে বা পড়ে থাকলে আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই দ্বিমত পোষণ করবেন না যেÑ এদের তুলনায় ফখরুল আলমগীর এবং রুহুল কবির রিজভী অনেক বেশি ‘নিরপেক্ষ’। এই দু’জন ‘নিরপেক্ষ’ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে শামসুল হুদা সমস্ত গ্রুপের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করলেন। বিগত নির্বাচনের আগে এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের সাধারণ মানুষকে পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারার মতো সবচেয়ে নৃশংস ‘আন্দোলন’ যখন চলছিল তখন এরা সবাই দেশে গণঅভ্যুত্থান হওয়ার কাহিনী শ্রোতাদের শুনিয়ে যাচ্ছিলেন এবং শেখ হাসিনার পতন যে আসন্ন সে দৈববাণী করছিলেন, নির্বাচন হওয়া তো অনেক দূরের কথা। নির্বাচন যখন হয়ে গেল, সেটা যেভাবেই হোক না কেন, তখন এরা বলা শুরু করলেন, ‘এ সরকার অবৈধ। বিরোধী দলের সবচেয়ে বড় যা সাফল্য আওয়ামী লীগের দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না, তা তাঁরা হাতেকলমে প্রমাণ করতে পেরেছেন।’ কি শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঙ্গনে সরকারের প্রত্যাশার ওপরে পারফর্মেন্স এবং গত এক বছরের মধ্যে পররাষ্ট্র নীতিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য যে কোন অতীত সরকারের সফলতাকে ম্লান করে দিয়েছে। ভারতের নির্বাচনে সরকার বদল হওয়ায় বিএনপি যে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল, সেটাতেও ভাটা পড়ে যায় ভারতীয় গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার কারণে। বাঙালীর স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। একাত্তরের সেই রক্তঝরা দিনে আমরা কেউ কি ভেবেছিলাম বিএনপির মতো একটি পুনর্জন্ম নেয়া মুসলিম লীগ দল আওয়ামী লীগের বিকল্প হবে বিজয়ী বাংলাদেশে। ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর যখন শেখ হাসিনা টেলিফোন করেছিলেন বিএনপি নেত্রীকে তার আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘আসুন আমরা বসি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ যে কোন দফতর নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ সেদিন বিএনপি এ প্রস্তাবের যতটুকু বিরোধিতা করেছিল তার থেকেও বেশি বিরোধিতা করেছিল ওই দলপন্থী ‘সুশীলবৃন্দ’। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমাদের ‘প্রখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ’। অথচ তাঁর বিপরীতে তিনি কয়েক দিন আগে প্রথম আলো পত্রিকায় লিখেছেনÑ ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থেকেই তাঁর সরকারের অধীনে মধ্যবর্তী নির্বাচনই এখন একমাত্র পথ। অন্য পথও হয়ত আছে। অধম এই মুহূর্তে তার হদিস পাচ্ছে না। মধ্যবর্তী নির্বাচন পরিচালনাকারী সরকারের কলেবর অবশ্যই ছোট হতে হবে, তাতে দু-চারজন মন্ত্রী থাকবেন বিএনপির পছন্দ অনুযায়ী। বিএনপি হয়ত চাইবে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন।’ আর একজন সুশীল যিনি এক সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভক্ত ছিলেন, এখন তিনি শহীদ জননী, যার শাসনামলে দেশদ্রোহী মামলার অভিযোগ মাথায় নিয়েই এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন তার অকৃত্রিম ভক্ত। তিনি খালেদা জিয়াকে মানুষ পুড়িয়ে মারার অভিযোগে হুকুমের আসামি করার উত্তরে বলেছেন, ‘লগি বৈঠার হত্যার জন্য কাকে হুকুমের আসামি করা হবে?’ এ আইনের অধ্যাপক হয়ত ভুলে গেছেন, লগি বৈঠার সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছিল বন্দুকধারীদের, যাদের মুখে সেøাগান ছিলÑ ‘বাঁচলে গাজী, মরলে শহীদ।’ সে যুদ্ধে যারা মারা গেছেন তারা কেউ সাধারণ নাগরিক ছিলেন না; তারা ছিলেন রাজনৈতিক দলের সৈনিক। সে সৈনিকদের মৃত্যুর সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পেট্রোলবোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারা কি এক কথা? একটি রাজনৈতিক দল যখন একটি রাজনৈতিক ভুল এবং বিশেষ করে সেটা যদি মারাত্মক ভুল হয়, তবে তার জন্য অবশ্যই সে দলকে একটা রাজনৈতিক মূল্য দিতে হবে। গত বছর নির্বাচনের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী একটা সুন্দর প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যেখানে একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর বাইরে প্রধান বিরোধী দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মন্ত্রিত্ব দরকষাকষির মাধ্যমে আদায় করার একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা ছিল, যেটা কিনা নির্বাচনের ফলাফল কোন সম্ভাব্য নির্ধারণের বিপক্ষে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হতে পারত। আজকে বিএনপিপন্থী সুশীলরা সে ব্যবস্থার কথা বলছেন। তাহলে আজকে প্রধানমন্ত্রী যখন বলছেনÑ ‘একটি দল নির্বাচনে না এসে যে ভুল করেছে তার খেসারত কেন সমগ্র জাতিকে দিতে হবে?’ সে বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কি কোন যৌক্তিকতা আছে? বিএনপির বর্তমান হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগে একটা জরিপের ফলে দেখা গেছে, ৭২ শতাংশ মানুষ সরকারের সাফল্যকে অনুমোদন দিচ্ছে। মাত্র ৩৫ শতাংশ একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন চান। আজকে সরকারের এবং বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চালেঞ্জ হলো সরকার কতটা কঠোর হস্তে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে পারবে। দয়া করে খালেদা জিয়াকে বন্দী করবেন না। বিএনপি এবং তার ‘একই পরিবারের সদস্য জামায়াতে ইসলামী’ ২০১৩ সালে যা করছে এবং এখনও যা করছে সেটা কোন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের স্বীকৃত রাজনৈতিক পন্থা নয়। এ চোরাগোপ্তা হামলার সঙ্গে একমাত্র নকশাল আন্দোলনের হত্যাযজ্ঞের তুলনা করা যায়। অতএব, কোন রাজনৈতিকপন্থায় এটা দমন করা সম্ভব নয়। এ হিংস্রতার কাছে আত্মসমর্পণের অর্থ হলো এ হত্যাযজ্ঞপন্থায় দাবি আদায়ের স্বীকৃতি দান, যেটা একটা জাতির জন্য আত্মহত্যা। দেশের সব সুস্থ মস্তিকের মানুষ তাকিয়ে আছে প্রধানমন্ত্রীর দিকে কঠোরতমভাবে এ মানুষ হত্যাকারীদের দমন করার আশা আর দাবি নিয়ে। যে কোন ধরনের নমনীয়তা বা দীর্ঘসূত্রতা জাতিকে এক অন্ধ গহ্বরে নিমজ্জিত করবে। লেখক : কানাডার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক এবং সিনেটের ডেপুটি স্পীকার।
×