ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আজ কিউপিডের তীরে হৃৎপিন্ড বিদ্ধ হওয়ার দিন

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আজ কিউপিডের তীরে হৃৎপিন্ড বিদ্ধ হওয়ার  দিন

মোরসালিন মিজান ॥ ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে...। নদীর জলে ভালবাসার আগুন নেভে না। দহনে দ্বিগুণ হয় প্রেম। কেউ প্রেমে পড়ে। কারও ওপর আপনি পড়ে প্রেম। ভালবাসার জন্য কেউ হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ছোটেন। দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে অবলীলায় বাঁধেন লাল কাপড়। বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে আনেন ১০৮ নীলপদ্ম। কেউ প্রেমের অসুখে তিলে তিলে নিঃশেষ হন। না পাওয়ার ব্যথায় বুক চৌচির হয়। তবু প্রশ্ন থাকে। তবু মান্না দে কে গাইতেই হয় ‘ভালবেসে সুখী হতে বলো কে না চায়?’ হ্যাঁ, আজ ভালবেসে সুখী হওয়ার দিন। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি শনিবার ভালবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন ডে। সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালন করা হবে। বলে রাখা জরুরী, আজ এমন এক সময়ে ভালবাসা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে যখন মানুষ মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারছে! রাজনীতির নামে, ধর্মের নামে চলছে নৃশংসতা। এই বর্ববরতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারে, একে রুখে দিতে পারে মানুষের ভালবাসা। আজ তাই মানুষে মানুষে যে প্রেম পৃথিবীকে এখনও বসবাসযোগ্য রেখেছে, সেই প্রেমের জয়গান গাইবে মানুষ। দিবস হিসেবে ঘটা করে উদ্যাপনের শুরুটা হয়েছিল পাশ্চাত্যে। ওই সব দেশের প্রেমপাগল মানুষ বহুকাল ধরে ১৪ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করে আসছে। বাংলাদেশে ভ্যালেনটাইন ডে প্রথমদিকে কিছুটা ফিস ফিস ছিল। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ উচ্ছলতা নিয়ে আজ উদ্যাপন করা হবে দিবসটি। ভালবাসা দিবসে আজ শাশ্বত প্রেমের কাছে নত হবে সব বয়সী মানুষ। আজ ভালবাসার কাছে নিজেকে নিশ্চিন্তে সঁপে দেয়ার দিন। সব দেখে মনে হবে ‘এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে।’ ভালবাসার জন্য যে আকুলতা, তার কিছুটা প্রকাশ করে ভাটি বাংলার লোককবি শাহ আবদুল করিম বলেছিলেনÑ আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া...। মনের মানুষ ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত বাঁচা মরা, ঘর বাঁধা ঘর ছাড়া সব ভালবাসার জন্য। প্রেমের টানে রাধারমণও ঘরছাড়াদের একজন হয়েছিলেন। গেয়েছিলেন ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না...। একই অনুভূতি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিলেন মরমী কবি হাসন রাজা। তিনি স্বীকার করে বলেন- নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে...। ভালবাসার দিনে আজ নতুন করে দেখা দেবে চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে যুগল। শহরজুড়ে ঘুরে বেড়াবে। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবেÑ নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলঙ্কার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না...। প্রিয়জনের হৃদয়ে চিরকাল বাঁচার আকুতি জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ থেকে গাইবেÑ ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখো- তোমার/ মনের মন্দিরে। নজরুল থেকে গুন গুন করবেÑ চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/জানিতে নাইকো বাকি, সইও আঁখি কি জাদু জানে...। আজ সারাজীবন প্রিয় মানুষটির পাশে থাকার শপথ নেবে প্রেমিক প্রেমিকরা। নজরুল থেকে হয়ত বলবেÑ এসো তুমি একেবারে প্রাণের পাশে।/ যাও মিশে গো আমার প্রাণে, আমার শ্বাসে...। আর যাঁরা একলা মানুষ, আজ মনের মানুষটিকে ‘ভালবাসি’ বলার সব চেষ্টাই তাঁরা করবেন। পাশ্চাত্যের অনুকরণে জানতে চাইবেÑ উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন? আর যাঁরা সাহস করতে পারবেন না তাঁরা অপেক্ষা করে থাকবেন, হঠাৎ কিছুর জন্য। মনের অজান্তেই গাইবেনÑ হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে-/ এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরাণ চমকি তোলো...। কারও কারও ভেতরে ভালবাসার সব অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কার জন্য ব্যাকুল মন সেটি আর বোঝা হয় না। কবিগুরুকে তাই হয়ত লিখতে হয়Ñ যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/ কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম...। আর যাঁরা নামটি জানেন কিন্তু তাঁকে বলতে পারেন না ভালবাসি সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে রবি ঠাকুর লিখেছিলেনÑ আমি যে আর সইতে পারি নে।/ সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে। অন্যভাবে বললেÑ লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/ কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা...। এখানেই শেষ নয়। ভ্যালেনটাইন ডে মনের পুরনো অনেক ব্যথা আজ জাগিয়ে তুলবে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘ঝরা ফুল’ কুড়োবেন অনেকে। এঁদের হয়েই হয়ত নজরুল লিখেছিলেনÑ বলেছিলে তুমি ভালবেসে মোরে, মোর হাতখানি ধরে।/ সেই দুটি কথা ভুলিতে পারি না, নিশিদিন মনে পড়ে...। অবশ্য এখন অপ্রেমও কম নয়। তরুণ তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছে এবং বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছে- ব্রেকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ। ফের শুরু হয়ে যাচ্ছে ভালবাসাবাসি! তবে আজ এসব প্রেমের কথা হবে না। সুন্দর শ্রেষ্ঠ প্রেমগুলো বার বার স্মরণ করবে মানুষ। আজ সবটুকু সততা নিয়ে একে অন্যকে বলবেন ‘এভরিথিং আই ডু আই ডু ইট ফর ইউ। শিরি-ফরহাদ, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রোমিও-জুলিয়েটের মতো অমর হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হবেন প্রেমিক প্রেমিকারা। আলাদা করে বলা যায় প্রেমিক দেবদাসের কথাটি। সাদা চোখে দেখা প্রেমের সাফল্য ও ব্যর্থতার উর্ধে উঠে গিয়েছিল শরৎ উপন্যাসের এই চরিত্র। আজ বইয়ের পাতা থেকে বাস্তবেও দেখা মেলে দেবদাসের! অদ্ভুত এই প্রেমেও জীবন নিঃশেষ করে দেন অনেকে। শরৎচন্দ্র নিজেও জোরালো অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন দেবদাসের পক্ষে। কালজয়ী উপন্যাসের শেষ অংশে এসে লেখেছিলেন, ‘এখন এতদিনে পার্বতীর কি হইয়াছে, কেমন আছে জানি না। সংবাদ লইতেও ইচ্ছা করে না। শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মতো দুঃখ পাইবে। তবু যদি কখনও দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও। প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে-যেন একটিও করুণার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’ এমন মানবিক প্রার্থনায়, শুভ আকাক্সক্ষায় আজ সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হবে ভ্যালেনটাইন ডে। যতদূর তথ্য, ভ্যালেন্টাইন ডে উদ্যাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবী জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় কিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনও কখনও ওই দু’জনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এরকম-সম্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হচ্ছে না পুরুষরা। তাই ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। গ্রামের উপাখ্যান অনুযায়ী প্রেমের দেবতা কিউপিড সারাক্ষণ প্রেমের তীর হাতে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াতেন। তার তীরেই বিদ্ধ হতো তরুণ-তরুণী। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্বে ছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট মেরিয়াস খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। বন্দী অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। একপর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়। মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন।’ বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সেদিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এ আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। আজ নানা আয়োজনে বিশ্বজুড়ে দিবসটি উদ্যাপিত হবে। বাংলাদেশের প্রেমিক প্রেমিকারাও ঘর ছেড়ে বের হবে। ‘হংস মিথুন’ হবেন। ভালবাসার লাল রঙে নিজেকে বদলে নেবে শহর। প্রেমিক প্রেমিকারা একে অন্যকে উপহার দেবেন ভালবাসার লাল গোলাপ। এর বাইরে মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করে চলবে ভালবাসার আদান-প্রদান। এই প্রেমের, মহোত্তম ভালবাসার জয় হোক। প্রেমের পৃথিবী হোক। এগিয়ে যাক ভালবাসার বাংলাদেশ।
×