ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভালবাসার আন্তর্জাতিকতা

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ভালবাসার আন্তর্জাতিকতা

প্রেম বা ভালবাসা সম্পর্কে প্রাচ্যদেশীয় কবি ও দার্শনিক জালালউদ্দীন রুমির একটা উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করা যেতে পারে। রুমি তার প্রেমতত্ত্বে প্রেমের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ প্রেম এক অদ্ভুত শক্তির নাম। প্রেমের চৌম্বক টানে প্রেমিক যেমন আকৃষ্ট হয় প্রেমিকার প্রতি, তেমনি জড় পরমাণুপুঞ্জও আকৃষ্ট হয় পরস্পরের প্রতি। শুধু তাই নয়, এই প্রেমশক্তির আকর্ষণে সৌরজগতের নক্ষত্ররাজিও পৃথিবীকে তাদের দিকে আকৃষ্ট করে স্বাভাবিক আলিঙ্গনের ছলে। প্রেমের এই অতিজাগতিক টানের ফলেই পৃথিবী শূন্যে ঝুলে আছে একটি বাতির মতো, আর এর চারদিকে সব শক্তির সমান আকর্ষণের কারণেই তা ঝুঁকে পড়ছে না এদিক-ওদিক। প্রেমের এই অদ্ভুত বন্ধন পৃথিবীকে অধিষ্ঠিত রেখেছে শূন্যে। নীহারিকাপুঞ্জ থেকে যে প্রেমশক্তি সৃষ্টি করে নভোমণ্ডলের গ্রহ-তারকাকে, সেই শক্তি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সৃষ্টি করে প্রাণ। রুমি প্রেমকে ব্যবহার করেছেন একটি অতিন্দ্রীয় আধ্যাত্মিক নীতি বা শক্তি হিসেবে। প্রেমকে তিনি কেবল মানব-মানবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি, নিয়ে গেছেন একটা আধ্যাত্মিক ও বৈশ্বিক মাত্রায়। আমরা যদি প্রেমকে কেবল মানব-মানবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করি, তবে দেখতে পাই, এই প্রেমশক্তির আকর্ষণ-বিকর্ষণের কারণেই মানুষ পৃথিবীতে এখনও অস্তিত্বমান। মানুষের ভেতর প্রেম-ভালবাসা আছে বলেই মানব সৃষ্টি প্রক্রিয়া এখনও চলমান। প্রেমের শক্তি বা আকর্ষণই প্রজননের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলেছে। মানুষের মধ্যে প্রেম-ভালবাসার ঘাটতি দেখা দিলে পৃথিবীর শৃঙ্খলিত গতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। কিভাবে ব্যাহত হয় তার নজির এখন আমাদের চোখের সামনেই। এই যে বাংলাদেশে এখন পেট্রোলবোমা মেরে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। বোমা নিক্ষেপকারী দুর্বৃত্তদের অন্তরে যদি মানুষের প্রতি প্রেম-ভালবাসা থাকত, তারা কি এ জঘন্য কাজটি করতে পারত? কখনই না। তার মানে তাদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতির ফলে একটি রাষ্ট্রের উৎকর্ষতার দিকে যাওয়ার যে গতি, তা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ভাষার উন্মেষ থেকে আজ অবধি কবি-লেখকরা নানাভাবে প্রেমের মাহাত্ম প্রচার করেছেন, করছেন। তাঁদের লেখা সেসব প্রেমের আখ্যান বহুল পঠিত, বহুবিশ্রুত। যেমন লাইলী-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, শিরি-ফরহাদ, ইউসুফ-জুলেখা, থিসবি-পিরামুস, শাহজাহান-মমতাজের কিংবদন্তি প্রেম জগতের তাবত প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের কিংবা প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার এমনই আকর্ষণ, যার জন্য পৃথিবীর সবকিছু ছাড়তেও রাজি তাঁরা; যেমন প্রেমিক ট্রোজান। যুবরাজ প্যারিসের জন্য স্বামী মেনিলিয়াসকে ছেড়ে চলে আসে সুন্দরী হেলেন। কখনও মৃত্যুকেও বরণ করে নেয় হাসিমুখে; যেমন নিয়েছে থিসবি-পিরামুস। প্রেম মানে না জাত-পাত, গন্ধ, রূপ, বর্ণবৈষম্য। নইলে কি কৃষ্ণবর্ণ লাইলীর জন্য মজনু পাগল হয়? প্রেম কখনও প্রেমিককে পৌঁছে দেয় সৃষ্টিশীলতার চূড়ান্তে; যেমন বিয়াত্রিচের প্রেমে মহাকবি দান্তে রচনা করলেন তাঁর অমর কাব্য ডিভাইন কমেডিয়া। বঙ্গ-ভারতের কবিদের কাব্য তো বলা যায় প্রেমেরই সৌন্দর্যখনি। কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রেমেরই জয়গান। মহাকবি কালীদাস বলেন, প্রেমই চিরসত্য, প্রেমই চিরসৌন্দর্য। মেঘদূতের প্রণয়-প্রমত্ত যক্ষ প্রেমের ঘোরে ভুলে যায় জগৎ-জীবনের সব কিছু। প্রভু কুবেরের ক্রুদ্ধতায় নির্বাসিত হয়ে আকাশের মেঘকে দূত করে প্রিয়ংবদার কাছে বার্তা পাঠায়। শকুন্তলায় দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার প্রেমে খানখান হয়ে ভেঙ্গে গেল যত কিছু অস্থায়ী বিলাস বিভ্রম। কুমারসম্ভবে উমা ও শঙ্কর মিলে পেতেছিল অনিন্দ্য প্রেমের অপরূপ যোগাসন। জয়দেব তাঁর গীতগোবিন্দে রাধা ও কৃষ্ণের যে প্রেমের আখ্যান সৃষ্টি করেছেন তা সত্যিকারার্থেই বিরল। আলাওল তাঁর পদ্মাবতীতে রতœসেন ও পদ্মাবর্তীর যে প্রেমের বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাঙালীর হৃদয়কে এখনও আকুল করে তোলে। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় মালেক-নুরুন্নেহার প্রেম নিষ্ঠুর সামাজিকতা বাহ্যিকভাবে ভেঙ্গে দিলেও সেই প্রেম শেষ পর্যন্ত অভগ্ন হয়ে ইহজাগতিকতায় পৌঁছে যায়। কিংবা ভেলুয়া-আমির সাধুর প্রেম, শত দুর্বিপাকেও তাদের প্রেমে সহজে ভাঙ্গন ধরে না। নছরের প্রেম ভাগ হয়ে গেলেও শেষতক তার প্রেম আমিনাতে এসেই স্থির হয়। শ্রীচৈতন্য এই বাংলায় পেতে দিলেন তাঁর অনিন্দ্য প্রেমের গালিচা। রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন প্রেমের অনবদ্য সুর আর নজরুল বাজালেন প্রেমের বাঁশরী। মনের মানুষের সন্ধানে মহাজন লালন সাঁই প্রেমেরই তো মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন। হাছন, রাধারমণ কিংবা শাহ আবদুল করিমের এই বাংলার আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায় প্রেমের আকুল আবেদন। সুদূর জাজিরাতুল আরবের আইয়ুব-রহিমার প্রেমের আখ্যান অনুসারে বাঙালী যখন ‘প্রেম করেছেন আইয়ুব নবী/তাঁর প্রেমে রহিমা বিবি গো’Ñ বলে সুর ধরে, তখন প্রতিটি হৃদয় এক অপ্রকাশ্য আবেগে হাহাকার করে ওঠে। কিংবা ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে গো ভ্রমরা’Ñ বলে যখন গান ধরে শিল্পী, তখন অনাবিল প্রেমানন্দে চিত্ত মোহিত হয়। ‘চান্দের বাত্তি’ জ্বালিয়ে নিশি গুজরান করে বাঙালী প্রেমিক। প্রেম-ভালবাসা আসলেই এক অনন্ত শক্তির নাম। এই ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতে, সবার উর্ধে তুলে ধরতে বিশ্বজুড়ে এখন পালিত হয় ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’। যে কারণেই এই দিবস পালনের সংস্কৃতি চালু হোক না কেন, দিবসটি এখন শুধু ওই কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে নানা মাত্রায়। পাশ্চাত্য-উদ্ভাবিত এই দিবসের অভিঘাত গত এক দশক ধরে আমাদের দেশে বেশ জোরেশোরেই পড়ছে। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দিবসটির প্রভাব এখনও মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শুধু মধ্যবিত্ত বললে ভুল হবে, বলতে হবে নাগরিক মধ্যবিত্ত। কারণ গ্রামীণ মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের কাছে দিবসটির বিশেষ কোন তাৎপর্য এখনও পর্যন্ত নেই। সামাজিক নানা বিধি-নিষেধের কারণে দিবসটির তাৎপর্য তাদের কাছে এখনও ঠিক সেভাবে পৌঁছেনি। কিন্তু গ্রাম ক্রমেই নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিংবা নগর গ্রামের দিকে। গ্রামীণ মানুষ ক্রমেই পুরনো ধ্যান-ধারণাকে পরিত্যাগ করে নতুন ধ্যান-ধারণার দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি এলে আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াগুলো যেভাবে ‘বিশ্ব ভালবাসা দিবস’ এর প্রচারণা চালায়, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দিবসটি ছড়িয়ে পড়বে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রায় সতেরো কোটি নারী-পুরুষের মধ্যে। তখন খুব সহজে সবাই গ্রহণ করবে দিবসকেন্দ্রিক ভালবাসাবাসির এই সংস্কৃতিকে। এ সংস্কৃতি গ্রহণের মধ্যে আমি নেতিবাচক বা খারাপ কিছু দেখি না। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, এটি বাঙালীর সংস্কৃতি নয়, এটি বিদেশী সংস্কৃতি; আমরা এই সংস্কৃতিকে কেন গ্রহণ করব? আমার প্রশ্ন হচ্ছে, অখ- বাঙালী সংস্কৃতি বলতে কি কিছু আছে? বাঙালী সংস্কৃতির মধ্যে তো যুক্ত হয়েছে নানা দেশের নানা সংস্কৃতি। বাঙালী সবসময় সুন্দরকে গ্রহণ করে, অসুন্দরকে বর্জন করে। ভালবাসা দিবসের মধ্যে তো অসুন্দর কিছু নেই, এটিকে গ্রহণ করতে আপত্তির কোন কারণ আমি অন্তত দেখি না। আমি মনে করি, বাঙালী দিবসটিকে গ্রহণ করতে মোটেই আপত্তি তুলবে না। দিবসটিকে বিধর্মী, বিজাতীয়, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি ‘দাগ’ লাগিয়ে এটিকে বর্জন করা আসলে যাবে না। কেননা এটির মধ্যে সৌন্দর্য আছে, মানবতা আছে, ভালবাসা আছে। মানুষ সভ্য হয়ে ওঠার জন্য তো সৌন্দর্য, মানবতা আর ভালবাসার বিকল্প নেই। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে বা বিশ্ব ভালবাসা দিবসটির মধ্যে আমি একধরনের আন্তর্জাতিকতা দেখতে পাই। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এখন দিবসটি পালিত হচ্ছে। পৃথিবীর নানা দেশের, নানা ভাষার, নানা বর্ণের, নানা ধর্মের মানুষ একই দিনে ভালবাসার উৎসবে মেতে উঠছে। এটাকে বলা যায় ভালবাসার আন্তর্জাতিকতা। একটি দিবস সারা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে পালন করছে। তার মানে বিশ্বের সব মানুষকে দিবসটি একটা সুতোয় বেঁধে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের নামে, ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতির নামে মানুষে মানুষে যে বিভক্তি, দিবসটি সেই বিভক্তিকে কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিচ্ছে। এটা তো মানবতার জন্য খুব ভাল একটা ব্যাপার। এর চেয়ে ভাল সংস্কৃতি আর কী হতে পারে? এটাকে প্রত্যাখ্যান করার, বিদেশী, বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে নাক সিটকানোর কোন কারণ আমি দেখি না। আজ বিশ্ব ভালবাসা দিবস। ভালবাসার জয় হোক, ভালবাসা দিবসের জয় হোক। ভালবাসার মহিমায় উদ্ভাসিত হোক বিশ্ববাসী, ভালবাসার বলে বলীয়ান হোক বিশ্বের সমস্ত নারী-পুরুষ। সর্বমানবের সম্মিলিত ভালবাসার উৎসবে মুখরিত হোক সমস্ত পৃথিবী। লেখক : কথা সাহিত্যিক
×