ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

যারা দেশের জন্য হুমকি তাদের সঙ্গে সংলাপ হবে কী ভাবে?

আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে যেদিন আওয়ামী লীগ হলো সেদিন থেকে বাঙালী মসুলমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তখন, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সেক্যুলারিজম বা অসাম্প্রদায়িকতা শব্দগুলো বুদ্ধিজীবীদের মুখেও চলতি শব্দে পরিণত হয়নি। সেই সময় যাঁরা এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন তাঁরা যে দুঃসাহসী ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সবেচেয়ে শক্তিশালী দল ছিল এমন বলা যাবে না। কারণ, বামধারা তখনও প্রবল এবং মেধাবী, সৎ তরুণদের সমাবেশ ছিল বামধারায়। সংগঠনের দিক থেকে তাদের তুলনা ছিল তারাই। তবে, আওয়ামী লীগও সারা বাংলাদেশে সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছিল। এদিক থেকে অন্যান্য দলের তুলনায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে ছিল। আওয়ামী লীগ ঐ ধরনের সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছিল একটি কারণে, সেটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কারণে। তিনি তাঁর চারপাশে এমন সব ব্যক্তিদের জড়ো করতে পেরেছিলনে যাঁরা ছিলেন সৎ, শিক্ষিত এবং আদর্শে অনুপ্রাণিত। ১৯৬৮-৬৯ সালে আওয়ামী লীগের ব্যাপ্তি বাড়তে লাগল এবং ১৯৭০ সালের মধ্যে পূর্ববঙ্গে প্রধান দলে পরিণত হলো আওয়ামী লীগ। সবচেয়ে বড় ব্যাপার বঙ্গবন্ধু তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন এবং ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি মিথ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ভোট পড়েছিল প্রায় ২০ ভাগ। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও মোট নিরঙ্কুশভাবে ভোট পায়নি। ছয় দফার ম্যান্ডেট চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। ম্যান্ডেট পেয়েছিল। কিন্তু ২০-২৫ ভাগ মানুষ তা সমর্থন করেনি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুকে একক জাতীয় নেতায় পরিণত করে। ১ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে তিনি ছাড়া বাঙালীর কোন নেতা ছিলেন না। যাঁরা তাঁকে ম্যান্ডেট দেননি, তাঁরাও আপাতত তাঁকে মেনে নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকেই পুরনো ম্যান্ডেট না দেয়া মানুষজন এবং নতুন অসন্তুষ্ট মানুষজন একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধিতা শুরু করে। ১৯৭২-৭৫ সালে অপপ্রচার ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আচরণে দেশব্যাপী প্রবল অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমর্থক তাঁরাও অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রায় তিন দশক ঐ অসন্তুষ্টরা (১৯৭০, ১৯৭২-৭৫) ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা যে কৌশলটি নিয়েছিলেন তাতে সফল হয়েছিলেন। প্রথম, ঐসব অসন্তুষ্ট ও সুবিধাবাদী মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে নতুন একটি শ্রেণী তৈরি করা হয়েছিল। যারা সব সময় মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগকে একত্রে প্রতিপক্ষ ভাববে। দ্বিতীয়, একই সঙ্গে মনোজগতে আধিপত্য বিস্তার করা। তাদের কৌশল ছিল, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার না করে বিতর্কিত করে তোলা, পাকিস্তান মানসসম্পন্ন দল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলকে একই পাল্লায় ওজন করা এবং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম সৃষ্টি ও তাতে ধীরে ধীরে এ কথা বিস্তার যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে আদৌ যদি কোন জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে হয় তা হলে বাঙালী নয় মুসলিম জাতীয়তাবাদই হবে সঠিক, যার ভিত্তি ১৯৪৭। ১৯৪৭ সালকে তারা ইতিহাসের মূলধারা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাচ্ছিল। এ ধারার মূল দল বিএনপি, পুরনো মুসলিম লীগ ও অন্যান্য অসন্তুষ্ট গ্রুপ ভায়োলেন্সের মাধ্যমে তাদের সৃষ্টি ও বিকাশ। দ্বিতীয় দল জামায়াতে ইসলামী। এই নিষিদ্ধ দলটিকে পাকিস্তানের (অর্থাৎ নিজেদের) স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা মুক্ত করা হয়। প্রথমে দু’টি দল আলাদা মনে হলেও দেখা গেছে, মৌলিক প্রশ্নে তাদের দ্বিমত নেই এবং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বিএনপি থেকে জামায়াত বিস্তৃত হতে পেরেছে এ কারণে যে, তারা প্রায় ১০০টি জঙ্গী গ্রুপ সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের (যারা মুক্তিযুদ্ধের) বিরোধী ছিল, অর্থসাহায্যে বিশাল আর্থিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পেরেছে। হতাশাগ্রস্ত, হাত-পা ভাঙ্গা কিছু লেফটিস্ট ও রাজনৈতিক টোকাই এবং বিভিন্ন চরের পীর ও কিছু হোন্ডা পার্টিও এদের সঙ্গে থাকে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ, যাদের রেকর্ড আছে সেক্যুলার দল হিসেবে শুরু থেকে বাঙালীদের কথা বলার এবং বাঙালীদের রাষ্ট্র গড়ায় নেতৃত্ব শুধু নয়, স্বল্পতম সময়ে বিশ্বের সেরা একটি সংবিধানও দিয়েছে। তাদের সমর্থক– বিভিন্ন মৃদু বামপন্থীও চাইলেও বিএনপি সাপোর্ট করতে পারে না, আওয়ামী লীগ অপছন্দ হলেও বিকল্প নেইÑ এ মনোভাবের দল, গ্রুপ ও ব্যক্তি। যাদের একত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ দলেও সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে যখন ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু, বুদ্ধিজীবী মহল, শিল্প সংস্কৃতি মহলে তাদের সমর্থক একচেটিয়া। এই দুটি ধারার দল ক্ষমতায় গেছে কয়েকবার। কিন্তু হিসাব কষে (হিসাবে ভুল থাকবে না এমন কথা আমি বলি না) দেখেছি, এ দেশে বিএনপি-জামায়াত মানসের লোকের সংখ্যা বেশি। আগে থেকেই ছিল। ১৯৭১ সালের পর থাকার কথা ছিল না। কিন্তু এখন ধরে নেয়া যেতে পারে তাদের সম্মিলিত সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ ভাগ। এদের আমি হেজাবি মনোভাবাপন্ন মনে করি (বিএনপি+জামায়াত+হেফাজতে ইসলাম)। এদের মনের কোনায় কোনায় যেন এক টুকরো হেজাবি লুকিয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রবল সমর্থক, কিন্তু কিছু টাকা হলে বা চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর প্রথম একটি মাদ্রাসা বা মসজিদ স্থাপনে আত্মনিয়োগ করেন। (চলবে)
×