ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে

মোরসালিন মিজান ॥ অদ্ভুত এক পুলকের নাম বসন্ত। প্রিয় এই ঋতু ভেতরের কোথায় যেন ছুঁয়ে দেয়। অমনি বদলে যায় সব। বদলে যেতে থাকে। চঞ্চল হয়ে ওঠে চিত্ত। মন আকুলি বিকুলি করে। সদা নির্লিপ্ত মানুষটিও অনুভব করেন হৃদয়ের শিহরণ। পাষণ্ডও দিব্যি গলে প্রেম হয়ে যায়। সেই প্রেমের, পুলকের ‘বসন্ত এসে গেছে!’ মনে বসন্ত। বনে বসন্ত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- আজি দখিন-দুয়ার খোলা/এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো...। প্রিয় ঋতুকে স্বাগত জানিয়ে প্রেমের কবি নজরুলের উচ্চারণ- এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন...। হ্যাঁ, আজ পহেলা ফাল্গুন, ১৪২১ বঙ্গাব্দ শুক্রবার। বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রতিবারের মতো সারাদেশেই এবারও প্রিয় ঋতুকে বর্ণিল উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেবে বাঙালী। ষড়ঋতুর এই দেশে ফাল্গুন চৈত্র দুই মাস বসন্তের কাল। এ সময় বায়ুপ্রবাহের দূরন্তপনা শুরু হয়। বসন্তের হাওয়া থাকে নির্মল। নাতিশীতোষ্ণ। নতুন ঋতুর আবাহনে এরই মাঝে রূপ লাবণ্যে দারুণ জেগে উঠেছে প্রকৃতি। এখন দারুণ রঙিন চারপাশ। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন। গোলাপ জবা পারুল পলাশ পারিজাতের হাসি। ঘরছাড়া মৌমাছি। কোকিলের কুহুতান। সবাই আবাহন করছে বসন্তকে। কবির ভাষায়Ñ বসন্ত, দাও আনি,/ফুল জাগাবার বাণী- তোমার আশায় পাতায় পাতায় চলিতেছে কানাকানি...। এই ফাগুনে বিবর্ণ রূপ ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠছে প্রকৃতি। নতুন প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। বাগানে ফুটেছে কুসুম। রক্ত পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন, মাধবী, কৃষ্ণচূড়ায় সেজেছে বন। আপন মনে গাইছে পাখি। কবিগুরুর বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে বললে- আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে,/ এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়...। অথবা- বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি,/ দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি...। অনাদিকাল ধরে বাঙালীর মন রাঙাতে আসে বসন্ত। বসন্তের সৌন্দর্য অবলোকন করে অসংখ্য কবিতা হয়েছে। গল্প গান হয়েছে। বসন্তে উদ্বেলিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেনÑফুল ফুটুক নাই ফুটুক/আজ বসন্ত...। এই বসন্তে দারুণ আকুলি বিকুলি করে ওঠে মন। শিল্পীরা গেয়ে ওঠেনÑ আইলো দারুণ ফাগগুন রে লাগলো মনে আগুন রে...। এই ফাগুনে বুকে নতুন করে জাগে ভালবাসার বোধ। কবিগুরু সে কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেনÑ ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল...। ভাললাগা ভালবাসার সৌরভ ছড়ানো নয় শুধু, মিলনের লগ্ন নিয়ে আসে বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহ-মন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোন। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজেÑ মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে...। লোকজ সুরেও প্রতিধ্বনি হয় অভিন্ন বাসনা। আব্বাস উদ্দীনের কালজয়ী কণ্ঠ শোনায়Ñ সুখ বসন্ত দিলরে দেখা, আর তো যৈবন যায় না রাখা গো...। বসন্ত বাতাস ভাটি বাংলার বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমকেও শান্ত থাকতে দেয় না। সুনামগঞ্জের বাউল তাই গেয়ে ওঠেনÑবসন্ত বাতাসে সই গো/বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...। বসন্তের আগমনে এভাবেই উচাটন হয়ে ওঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালবেসে এর পেছনে আবারও ছুটতে প্ররোচনা দেয়। পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে এ সময়। ঘর বাঁধে। মৌমাছিরা মধুর খোঁজে হন্যে হয়। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ছোটে। সব মিলিয়ে বসন্ত অনন্য। প্রতিবারের মতো আজও বসন্তের প্রথম দিনটি ব্যাপক হাসি রাশি আনন্দ গানে উদ্যাপিত হবে। আজ বাসন্তী রং শাড়ি, পাঞ্জাবি পরে খুব সকালে বাসা থেকে বের হবে তরুণ-তরুণীরা। মেয়েরা খোঁপায় পেঁচিয়ে নেবে হলুদ গাঁদার ফুল। দল বেঁধে ঘুরে বেড়াবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুল তলা, ছবির হাটসহ রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি। উদ্যানের সবুজের সঙ্গে আজ হলুদ রং মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, রেস্তরাঁ সবখানে স্থান করে নেবে উৎসবের রং। আজ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হবে বর্ণাঢ্য বসন্ত উৎসবের। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে একযোগে অনুষ্ঠান চলবে চার ভেন্যুতে। চারুকলার বকুলতলা সরব থাকবে সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। বাহাদুর শাহ পার্কে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত হবে বসন্ত উৎসব। ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চে চলবে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। একই আয়োজন উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের উন্মুক্ত মঞ্চে (লাবাম্বার পাশে) থাকবে বিকেল সাড়ে চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। আয়োজকদের পক্ষে মানজার চৌধুরী সুইট জানান, দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় থাকছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বসন্ত কথন, ফুলের প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আদিবাসী পরিবেশনা, শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা, আবৃত্তি, সঙ্গীত, বসন্ত আড্ডা, বাউল সঙ্গীত ও বসন্ত শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনেও অনুষ্ঠিত হবে বসন্তবরণ উৎসব। বাংলা একাডেমি চত্বর ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বসন্ত ও বইপ্রেম দুটোর মিলন ঘটবে এখানে। উপচেপড়া ভিড় হবে প্রাণের বইমেলায়। প্রিয়জন পরস্পরকে আজ বই উপহার দেবেন। ফুল উপহার দেবেন। সব মিলিয়ে অনন্য সুন্দর হয়ে ধরা দেবে বসন্ত। ঋতুরাজের আগমনে আলোয় আলোয় ভরে উঠবে বাংলার আকাশ। দূর হবে যত কালো, আঁধার যত। সকলের তাই প্রত্যাশা।
×