ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কৃষিতে নারী শ্রমিক বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কৃষিতে নারী শ্রমিক বাড়ছে

গত চার-পাঁচ দিনের বড় অর্থনৈতিক খবরগুলো কী তা দিয়ে আলোচনাটা শুরু করা যাক। একটি খবরে দেখা যাচ্ছে- বাংলাদেশের মসলার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে বোম্বাইওয়ালারা। এরা পরিচিত গুজরাটি অথবা মেমন হিসেবে। সংখ্যার হিসেবে এরা খুবই কম- মাত্র তিন-চার হাজার। কিন্তু হলুদ, মরিচ, জিরাসহ বিভিন্ন মসলার ব্যবসা এখনও মেমনরাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এখানে উল্লেখ্য, এ ঘটনা কোন অভাবনীয় ঘটনা নয়। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জভিত্তিক আমদানি ব্যবসা প্রকৃতপক্ষে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী হাউসই নিয়ন্ত্রণ করে। সয়াবিন তেল, রসুন, পেঁয়াজ, ডাল, দুধ ইত্যাদি পণ্যের আমদানি ব্যবসা এক সময় অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাই করতেন। তাঁরা অল্প অল্প পরিমাণ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু কালের ব্যবধানে এ সব ব্যবসায় একটা ‘মনোপলির’ সৃষ্টি হয়েছে। পেঁয়াজের ব্যবসা কয়েকজনের হাতে সীমাবদ্ধ, সয়াবিন তেলের ব্যবসা কয়েকটি হাউসের হাতে বন্দী। এভাবে সকল পণ্যের আমদানি ও সরবরাহই বন্দী হয়ে পড়েছে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ীর হাতে। এমতাবস্থায় মসলার ব্যবসা মেমনদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছে। এ খবর কোন অর্থই বহন করে না বলে আমি মনে করি। বস্তুত দেশে এ প্রবণতা সর্বত্র। স্টিলের ব্যবসায় ছোটরা তিরোহিত হচ্ছে। শিপ ব্রেকিংয়ে ছোট ও মাঝারিরা তিরোহিত হচ্ছে। সকল ব্যবসাতেই এখন প্রাধান্য বড় ব্যবসায়ীদের। তাদের আর্থিক ক্ষমতা অনেক বেশি। তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়া কোন সমস্যা নয়। সরবরাহের নেটওয়ার্কেও তারা অগ্রগামী। এ কারণে শুধু আমদানিজাত দ্রব্যে নয়, দেশীয় পণ্যের ক্ষেত্রেও বড়দের প্রাধান্য। যেমন চালের আড়তদারি ব্যবসা। এ ব্যবসাও বড় মিলারদের হাতে বন্দী হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির এটাই ধর্ম। এখানে ছোটরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। তাদের ব্যয় বেশি, প্রচলন ব্যয় বেশি অথচ ব্যবসার আকার ছোট। জানি না কে কিভাবে ভাবছেন, তবে মনে রাখতে হবে কী শিল্পে, কী আমদানিতে, কী সাধারণ ব্যবসায় যদি ছোটরা টিকতে না পারে এবং ধীরে ধীরে সেসব বড়দের হাতে চলে যায় তাহলে পরিণামে তা ভাল হবে না। সাধারণ খুচরা ব্যবসাতেও এ প্রবণতা লক্ষণীয়। আগে অল্প পুঁজি নিয়ে পাড়ায়-মহল্লায় এমনকি প্রধান সড়কেও একটা ছোট দোকান দিয়ে চলা যেত, কিন্তু এখন তা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে অন্য একটা ব্যাপার। সেটা হচ্ছে ব্যাংকঋণও কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে বড়দের হাতে অথচ এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি নয়। বাস্তবতা হচ্ছে ইতোমধ্যেই বড় বড় ব্যবসার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকঋণও মুষ্টিমেয় হাউসের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। এতে ঋণশৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে। খেলাপীঋণ বাড়ছে। পুনঃতফসিল আর হচ্ছে না, এখন করতে হচ্ছে পুনর্গঠন। অতএব নীতিনির্ধারকদের ভাবার সময় এসেছে। তাদের ছোট ও মাঝারি ব্যবসা, শিল্প-দোকান রক্ষায় ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় যে খবরটা দেখলাম কাগজে, তা বাজেটের আকার সম্পর্কে। তাতে বলা হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট ১৬ শতাংশ বড় হবে। এ খবর দিতে গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিগত ছয় বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কী কী অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার একটা হিসাব দিয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে গত ছয় বছরে (২০১০-১৫) এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে আছে সরকারী ও বেসরকারী খাত। পাঁচ কোটি লোক মধ্য আয়ের স্তরে উন্নীত হয়েছে অর্থাৎ তারা নিম্নআয়ের লোক ছিল। ছয় বছরে তারা তাদের মধ্য আয়ের লোক হিসেবে উন্নীত করেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৪ শতাংশে। অতিদরিদ্র লোকের সংখ্যা ১১ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে ছয় বছরে ছয়গুণ। এর পরিমাণ এখন ২২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। এটা একটা রেকর্ড। রফতানি বেড়েছে তিনগুণ। এর পরিমাণ এখন ৩০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। এই যে চারটি অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা হয়েছে বিগত ছয় বছরে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরেই মাথাপিছু আয় ছিল ১১৯০ ডলার অর্থাৎ মাসে প্রায় ১০০ ডলার। টাকার অঙ্কে প্রায় ৮ হাজার টাকা মাসে। এ অগ্রগতি যে কোন মানদ-ে প্রশংসনীয়- এটা বলতে কারও দ্বিধা থাকার কারণ নেই। এ প্রেক্ষাপটেই ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার হবে ২,৯১,৬৭০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২,৫০,৫০৬ কোটি টাকা। কোন সন্দেহ নেই বাজেটের আকার টাকার অঙ্কে বিশাল। স্বাধীনতার পর পরই আমাদের বাজেটের পরিমাণ ছিল নগণ্য পরিমাণের। প্রশ্ন এতে নয়। একটা ফাঁক এতে আছে, তা হচ্ছে বাজেটের গুণগত দিক, পরিমাণগত নয়। গুণগতভাবে বিচার করলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এক টাকার কাজ দুই টাকায় করি। এতে বাজেটের কলেবর বাড়ে। কিন্তু গুণগতমান বিঘিœত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন পরিমাণগত সম্প্রসারণ হয়েছে অফুরন্ত, পনেরো লাখ ছেলেমেয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু এদের অনেকেই একটা চিঠি স্বাধীনভাবে লিখতে পারছে না। একটা চাকরির দরখাস্ত লিখতে পারবে না। একইভাবে মানগত দিকে নজর দিলে বাজেটের গুণগতমান ঠিক থাকে না। আমাদের এখন দরকার শিক্ষার মতোই বাজেটের গুণগত দিকে নজর দেয়া। এক টাকার কাজ এক টাকায় করার চেষ্টা করা। একটি খবরে দেখলাম কৃষি কাজে পুরুষকে টপকে নারীরা সামনে চলে এসেছে। আরেকটি খবরে দেখলাম সরকারী ব্যাংকের খেলাপীঋণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। দুটো খবরই গত সপ্তাহের এবং বলাবাহুল্য দুটো খবরই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমেই আসা যাক খেলাপীঋণের পরিমাণের দিকে। বহুদিন পর সরকারী ব্যাংকের ওপর একটা ইতিবাচক খবর। খেলাপীঋণ কোন দৈব ঘটনা নয়। এটা একটা এ্যাকাউন্টিং এবং তা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মের অধীনে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি তার নিয়মনীতি পরিবর্তন করে, সংশোধন করে, তাহলে খেলাপীঋণ বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। সবচেয়ে বড় কথা ব্যবসায় যদি মন্দা চলে, শিল্পে যদি মন্দা চলে তাহলে কোন নিয়মনীতিতেই খেলাপীঋণের ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোন দেশ পারে না। চলমান হরতাল-অবরোধ অব্যাহত থাকলে পরিবহন ও হোটেল ব্যবসাসহ বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত দিতে অপারগ হবেন। তাই নয় কি? এর জন্য ব্যাংক দায়ী নয়, কোন কর্মকর্তা দায়ী নয়, ব্যাংকের পরিচালকরাও দায়ী নয় অথচ খেলাপীঋণ বাড়বে। এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। আমি ইচ্ছাকৃত খেলাপীর কথা বলছি না, আমি বলছি ব্যবসায় ক্ষতি বা মন্দাজনিত কারণে যারা খেলাপী হয় তাদের কথা। আগের দিনের ব্যাংকাররা তাদের নিজস্ব নিয়মেই এ সমস্যার সমাধান করত। মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরাও তা করত। এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। কিন্তু একশ্রেণীর মিডিয়া বিষয়টাকে অহেতুক ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমনভাবে উপস্থাপিত করে যে, তাতে মনে হয় সব শেষ হয়ে গেল। এই যে বর্তমান খবর সরকারী ব্যাংকের খেলাপীঋণ হ্রাস পেয়েছে এটা শতকরা হিসাবের। বস্তুত ব্যাংকের নয় শুধু সকল সরকারী তুলনামূলক হিসাবই শতকরা হিসাবে করা হয়। এখানে জোর দিয়ে বলা যায় দুটো ঘটনা ঘটলে সরকারী ব্যাংকের কেন- সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের খেলাপীঋণই বহুলাংশে হ্রাস পেত। সরকারী ব্যাংক তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়াতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধ আরোপিত আছে। যদি তা না হতো তাহলে খেলাপীঋণের পরিমাণ শতাংশের হিসেবে আরও কমত। বহু খেলাপীঋণ মামলাধীন। এটাও ফয়সালা করা সম্ভব হতো। কিন্তু হাইকোর্টে রিট করে খেলাপীরা মামলার কার্যক্রম বন্ধ করে রেখেছে। এতে বিপুল পরিমাণ টাকা আটকা আছে। গত ছয় মাস হাইকোর্টে ব্যাংকের মামলা দেখার জন্য বিশেষ বেঞ্চটি ছিল না। ফলে মামলার রায় নেই। এ সব কথা কেউ বলে না। মিডিয়া তো নয়ই অথচ বলা উচিত ছিল। এবার যে বিষয়টি আলোচনা করব তা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খবরে দেখা যাচ্ছেÑ কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। পুরুষরা চলে যাচ্ছে অন্যান্য জীবিকায়। গত এক দশক আগে যেখানে কৃষিতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৮ লাখ সেখানে এখন কৃষিতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৫ লাখ। দেখা যাচ্ছে কৃষি খাতে নারীশ্রমিকের সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েছে ১৭ শতাংশ হারে, বিপরীতে পুরুষশ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে ৩ শতাংশ হারে। নারীরা কৃষিতে জড়িত হচ্ছে, পুরুষরা চলছে শহরে। তারা জড়াচ্ছে অন্যান্য কাজে। লক্ষণীয়, নারীরা আগে বেশি জড়িত ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে। এখন এর প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে। পুরুষরা শহরে চলে যাওয়ার ফলে গ্রামে শ্রমিকের যে শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে, তা পূরণ করছে নারীশ্রমিকরা। এ ঘটনা সারাদেশেই ঘটছে। নারীরা সমানে সমান এগিয়ে যাচ্ছে। তারা ইট ভাঙছে, মাটি কাটছে। কী না। এ ঘটনা আমাদের অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য দিক। এতে সমাজেও ঘটছে বিবর্তন ও পরিবর্তন। লেখক : সাবেক অধ্যাপক, বিআইবিএম
×