ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপরিকল্পিত নগরায়ন শিল্পায়নে দখল হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অপরিকল্পিত নগরায়ন শিল্পায়নে দখল হয়ে যাচ্ছে জলাভূমি

শাহীন রহমান ॥ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও দেশের জলাভূমির পরিমাণ এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এক সময় দেশে ৭ থেকে ৮ মিলিয়ন হেক্টর জলাভূমি ছিল। দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১১ ভাগই ছিল জলাভূমি। প্রায় ৫০ ভাগ লোক তাদের জীবিকার জন্য জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু এখন বেশিরভাগ জলাভূমি ধ্বংসের পথে। যেগুলো রয়েছে তাও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এক হিসেবে দেখা গেছে স্বাধীনতার পর দেশের জলাভূমির আয়তন কমেছে ৬৫ লাখ হেক্টর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি বিবেচনায় নয়, জীববৈচিত্র্য রক্ষাসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিকভাবে জলাশয় রক্ষার ওপর গুরুত্বও প্রদান করা হয়ে থাকে। কিন্তু দেশে জলাভূমির পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে। লেকসহ সব জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় নেয়া হয় না বলেই জলাভূমি দখল ও দূষণ হয়ে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মৎস্য চাষ, কৃষি কাজ, বিনোদন, ভূ-গর্ভের পানির স্তর স্বাভাবিক রাখা ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে জলাশয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের জলাভূমির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষ করে ১৯৯৭ সালের ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনের ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জুড়ে রয়েছে নদী-নালা, খাল-বিল ও সামুদ্রিক স্রোতধারা। দ্বিতীয় রামসার স্থান হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ১শ’ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। যা স্থানীয় লোকদের কাছে এটি নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল হিসেবে পরিচিত। অথচ এটি এখন পরিবেশ বিপর্যস্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সুপেয় পানি নিশ্চিত করে জলাভূমি। প্রত্যেক মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রতিদিন ২০ থেকে ৫০ লিটার পানির প্রয়োজন। যা দিয়ে রান্নাবান্না ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলে। জলাভূমিই এ সকল পানি সরবরাহ করে থাকে। এছাড়াও জলাভূমি ভূ-গর্ভস্থ পানি পরিশোধন ও রিচার্জ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তাদের মতে, মানব জীবনের ভবিষ্যত নির্ভর করছে জলাভূমির ওপর। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা যেমন, পানির চাহিদা পূরণ, খাদ্য উৎপাদন, উপকূল রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও জলাভূমি থেকে সরাসরি মৎস্য, কৃষি কাজ, প্রাকৃতিক পানি সঞ্চালন, নৌযাতায়াত, বিনোদনের সুবিধা পাওয়া যায়। পরোক্ষভাবে জলাভূমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বৃষ্টির পানি ধারণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, জীবন মানের উন্নয়ন ঘটায়। কিন্তু দিন দিন জলাভূমি সংকোচনের ফলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলাভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল চলন বিন। এটি এখন সর্বনিম্ন আয়তনে নেমে এসেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও সুস্পষ্টভাবে জলাভূমি সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। জলাভূমি রক্ষায় বিদ্যমান আইন ও নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা সর্বাধিকভাবে জলাভূমি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদের মতে, ইজারা পদ্ধতির ব্যবস্থাপনায় দেশে জলাভূমির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পোল্ডারগুলো সুন্দরবন ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করেছে। তিনি বলেন, জলাভূমির ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ৪০০ প্রজাতির মেরুদ- প্রাণী সাংঘাতিকভাবে নষ্ট হচ্ছে। অপরিকল্পিত ধান চাষও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, রাষ্ট্রীয় ভূমির ৭০ থেকে ৮০ হাজার বর্গ কি.মি. অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক জুড়েই রয়েছে জলাভূমি, তেমনি জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই সরাসরি এসব জলাভূমির ওপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করে। আর জীবন-জীবিকার সকল প্রক্রিয়ায় সকল নাগরিকই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। চলন বিলের মতো বৃহৎ বিল, অনেক হাওর-বাঁওড় উন্নয়ন কর্মেও যাঁতাকলে পড়ে শুকিয়ে সংকটা পন্ন, ধ্বংসোন্মুখ। লাখ লাখ পুকুরের বাংলাদেশ আজ পরিবেশ-জ্ঞান ও যতেœর অভাবে ক্রমশ পুকুর শূন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে এখন প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া না গেলে দেশের জলাভূমি রক্ষা করা যাবে না।
×