ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফজলুল বারী

বিশ্বকাপ প্রতিদিন

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বিশ্বকাপ প্রতিদিন

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গা গরমের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম দল বেঁধে। সিডনির ব্ল্যাকটাউনের ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস পার্কে। গাড়িতে আমার সঙ্গে সওয়ারী মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের প্রিয় প্রজন্ম নিশান, রুবাই আর রিজু। অস্ট্রেলিয়ায় এদের বয়স ৬ মাসের কম বা বেশি। নিশান, রুবাই এদেশে পড়তে এসেছে। রিজু এসেছে স্ত্রীর পড়াশুনা উপলক্ষে। নিশান, রিজু, আমি থাকি কাছাকাছি সিডনির লাকেম্বা-ওয়ালি পার্ক এলাকায়। অবার্নে থাকে রুবাই। আমাদের সঙ্গে যাবে বলে আগে ভাগে ট্রেনে করে লাকেম্বা এসে হাজির! আমরা চারজন এক সঙ্গে হওয়ার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের জার্সি পরে নিয়েছি। কপালে বেঁধে নিয়েছি বাংলাদেশের পতাকা খচিত ব্যান্ড! হুলস্থুল অস্থির এক সাজসজ্জা আর কী! বিদেশে এমন সুযোগ পেলে দেশকে মেলে ধরার এসব আয়োজন-অনুভূতির যে কী আনন্দ তা লিখে বোঝানো যাবে না! এই সুযোগ নিয়ে এসেছে ক্রিকেট! বিশ্ব ক্রিকেট সংঘের গর্বিত সদস্য টাইগার্স ছেলেরা! সিডনির রুটি হিলসের স্পোর্টস ভেন্যুটিতে আগে কখনও যাইনি। নেভিগেটর পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে! লাকেম্বা থেকে চল্লিশ মিনিটের ড্রাইভ। এদেশের পথগুলো নানান গতি সীমায় নিয়ন্ত্রিত। ৫০-৬০-৭০-৯০-১০০ কিমি. ঘণ্টায়! পথের সাইন দেখে গতিসীমা কমিয়ে বাড়িয়ে নিতে হয়! কারণ পথে পথে ক্যামেরার নজরদারি! গতি সীমার ওলটপালট দেখলেই চুপচাপ ছবি তুলে রাখবে ক্যামেরা! ফাইনের নোটিস চলে আসবে বাসার ঠিকানায়! ফাইনের সঙ্গে আবার কাটা পড়বে ড্রাইভিং পয়েন্ট! কে হায় এমন হৃদয় খুঁড়ে ফাইন খেতে, পয়েন্ট খোয়াতে ভালবাসে অতএব পথে বেরুলে আমরা সবাই এদেশে আইনের প্রতি বিশ্বস্ত ছাত্র:) আরেকভাবে বলা চলে এদেশে রাষ্ট্র সারাক্ষণ আমাদের পেছনে বেত হাতে ঘুরে বেড়ায়:) বেত মানে ফাইন, বেত মানে পয়েন্ট খোয়ানো:) ফাইন খাতে বছরে এরা যে পরিমাণ আয় করে তাতে আমাদের মতো এক দুটি দেশের বাজেট যেন করা যাবে! এর জন্যেই এদেশের পথঘাট এত পরিপাটি সুশৃঙ্খল! বাংলাদেশে পথ শাসনের বালাই নেই! মানুষজনও আইন মেনে চলতে চায় না! প্রভাবশালীরা তো নয়ই। তাই পথ যেন সাক্ষাত মৃত্যু ফাঁদ আমার জন্মভূমিতে! রুটি হিলস এলাকাটিতে প্রচুর ভারতীয়-পাকিস্তানীর বসবাস। স্টেডিয়াম এলাকায় পৌঁছে সাইন দেখে পার্কিং এলাকার দিকে এগোই। পার্কিং এদেশে আরেক ব্যয়বহুল বিষয়! কিন্তু ভেন্যুটির পার্কিং এলাকায় দশ ডলারে আনলিমিটেড সময় পার্কিংয়ের ব্যবস্থা দেখে ভাল লাগে। রিজনেবল। সিডনি শহরে এই পার্কিং চার্জ ঘণ্টায় সাড়ে চার ডলারের বেশি। গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে স্টেডিয়ামের দিকে এগোতেই দেখি ঢলের মতো ছুটছে মানুষ! বাংলাদেশী আর পাকিস্তানী। সবার পরনে যার যার দেশের জার্সি। হাতে জাতীয় পতাকা। বাংলাদেশীদের হাতের পতাকাগুলোকে বড় মনে হয়। পতাকা এমন বড়ই হয় বাংলাদেশের। হৃদয়টা যে অনেক বড় হয় বাংলাদেশের মানুষের। গেটে দেখা হয়ে যায় মুসা ইব্রাহিমের সঙ্গে। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট বিজয়ী। স্ত্রীর পড়াশুনা উপলক্ষে এখন সিডনিতে আছেন মুসা। গেটে ব্যাগ আর শরীর তল্লাশি শেষে মিলে ভেতরে ঢোকার অনুমতি। খেলা ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। টসে জিতে ব্যাট করছিল বাংলাদেশ। তাই গ্যালারিতে অবস্থান নিতে নিতে দেখি ভেতরে সে এক অন্য উন্মাদনা! বলে বলে হৈ হৈ করে উঠছে বাঙালী! সঙ্গে দুলছে সবার হাতে থাকা বাংলাদেশের পতাকা! কেউ সেøাগান দিচ্ছে জয় বাংলা। কেউ পাশের পাকিস্তানী গ্যালারির স্টাইলে সেøাগান দিচ্ছে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ! অথবা অনেকে উচ্চৈঃস্বরে প্রকাশ করছে তাদের আনন্দ অনুভূতি, বাংলাদেশ বাংলাদেশ ধ্বনিতে! পাশের পাকিস্তানী গ্যালারি থেকে সেøাগান দেয়া হচ্ছিল, পাকিস্তান জিতেগা। বাংলাদেশ গ্যালারি থেকে জবাব দেয়া হচ্ছিল, হারেগারে হারেগা পাকিস্তান হারেগা। শুরুতে দুই উইকেট খুইয়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। প্রথমে তামিম, পরে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ দায়িত্ব নিয়ে খেলতে থাকায় দূর্যোগ সামাল দেয়া যায়। ইনজুরি-অস্ত্রোপচারের ধকল কাটিয়ে দলে ফিরেছেন তামিম। পাকিস্তানের সঙ্গে গা গরমের ম্যাচে সে খেলবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। তামিম থিতু হয়ে খেলছে দেখে ভাল লাগে। সাকিবের কাছে যা আশা করে দেশের মানুষ তা না পাওয়া যাওয়ায় আড়াই শ’ রান পেরুলো না বাংলাদেশ ইনিংসের পর খাবার দাবারের এলাকায় গিয়ে দেখি লম্বা লাইন। আমাদের চারজনের জন্যে চারটা বারগার, এক বাটি চিপস আনা হয় ৫১ ডলারে। খেতে খেতে দেখি অনেক বাংলাদেশী বাঙালী! দেশের টানে সবাই ছুটে এসেছেন। সোমবার কাজের দিনে অনেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। এদেশে একদিন কাজ না করা মানে দেড় শ’-দুই শ’ ডলারের গচ্চা! কিন্তু এরপরও কাজ বাদ দিয়ে এসেছেন। দেশ যে আগে। বাংলাদেশে যারা হানাহানি মারামারি করছে তারা কী জানে এই দেশপ্রেমিকদের মনের খবর? রেমিটেন্স কী এমনি এমনি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে প্রতিবছর? এখানে যত মানুষ প্রবাসের সবার একটাই চাওয় ভাল থাকুক দেশ। কিন্তু দেশ তো ভাল নেই! সে ভাল না থাকার কষ্ট তারা যেন ক্রিকেটারদের দেখে ভুলতে এসেছিলেন! বাংলাদেশ বোলিং ভাল দেখা যাবে এমন পৃথক একটা এলাকা দেখে বসেছি। এ এলাকাটি টিলার মতো। ঘাসের গালিচায় বসেছি আমরা। আকাশ মেঘলা। তাই সন্ধ্যার অনেক আগেই জ্বলে ওঠে ফ্ল্যাডলাইটের বাতিসব! এদেশে এমন বেশিরভাগ পাড়ার মাঠেও ফ্ল্যাডলাইটের ব্যবস্থা থাকে। ফিল্ডিংয়ে রুবেলকে কাছাকাছি পাওয়া গেলে অন্য এক বিব্রত ঘটনাও ঘটেছে! রুবেলকে দেখলেই হ্যাপি হ্যাপি বলে চিৎকার করেছে অনেকে! আরেকটা উইকেট নেয় ব্যাটা, তাহলো তোমার সব কেস-মোকদ্দমা মাফ, বলে চিৎকার করেও বলেছে কেউ কেউ! বিদেশের মাটিতে এসেও এমন বিব্রত কথাবার্তায় কী দেশের জন্যে ভাল খেলতে পারে দেশের একজন প্লেয়ার? কিন্তু হলো না শেষ পর্যন্ত! আশা জাগিয়ে জিততে পারল না বাংলাদেশ! সিডনি ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
×