ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ মানবের চিরসখা

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ মানবের চিরসখা

Char;P-7-Last (১০-২) চপ-৮ ওকে-উ.নুই. হঠাৎ করেই গেয়ে উঠতেন তিনি শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত সুকান্তর সেই বিখ্যাত কবিতা, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ।’ কোরাসেও গলা মেলাতেন গণআন্দোলনের যুগে। মিছিলে সেøাগান তুলে যারা আসে, তিনি ছিলেন তাঁদের ভাই। মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে সেøাগান তুলতেন, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ সেই তালা ভাঙতে পারার দলে তিনিও ছিলেন। ছাত্রদের নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে মিছিল সহকারে বেরিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলতেন। আবার গণসঙ্গীতের শিল্পীদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে গাইতেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে।’ সেই গান ছড়িয়ে পড়ত সর্বত্র প্রেরণার অনুষঙ্গ হয়ে। মানবমুক্তির তরে দানবের পরাজয় ঘটাতে সংক্ষুব্ধ ছাত্র হিসেবে ছিলেন রাজপথ, জনপদের সাহসী যুবা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইতিহাসের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে তুলেছিলেন তিনি। সবার সঙ্গে সবার যোগে চেয়েছিলেন স্বাধীন সোনার বাংলা। আর সেই বাংলাকে পাবার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আমিনুল হক বাদশা। সমকালীনদের প্রিয় বাদশাভাই। যিনি জীবনভর শুনিয়েছেন দেশপ্রেম আর সাধারণ মানুষের কথা ও কাহিনী। বাঙালীর সংস্কৃতির বিকাশে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। কোন বিভ্রান্তি তাঁকে আপ্লুত করেনি। বরং আদর্শবান মানুষের ধারায় নিজেকে ক্রমশ অতিক্রম করে একজন সম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিলেন। বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী বাদশা ভাই রাজনৈতিক নিপীড়ন, কারাগারের নির্যাতনকে হাসিমুখেই বরণ করেছেন। মানুষের পাশে, মানুষের কাছে সব সময় থাকায় সচেষ্ট ছিলেন বলেই আমজনতার কাছের মানুষ, প্রাণের মানুষে পরিণত হতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার আগেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়-পাত্রদের অন্যতম ছিলেন। যার প্রতি বিশ্বাস, আস্থা ছিল অগাধ। স্বাধীনতার পরও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কপালগুণে বেঁচে যান। যদিও ঘাতকরা তাঁকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী বেগম বদরুন্নেসা আহমদের বাসা থেকে আটক করেছিল। কিন্তু কৌশলে তিনি রক্ষা পান। মন্ত্রী বেগম বদরুন্নেসার ছিলেন নিকটাত্মীয়। ১৯৬৯ সালে বাদশা, শেখ কামাল ও কামাল সিদ্দিকীÑ এই ত্রয়ী বন্ধু ছায়ানটের শিক্ষক ওস্তাদ খুরশীদ খানের কাছে সেতার শিক্ষার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। ওস্তাদ গভীর মনোযোগ সহকারে তাঁদের তালিম দিতেন। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে তাঁদের সঙ্গীত সাধনায় ছেদ পড়ে। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে তাঁদের পক্ষে সাধনায় মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দিনরাত কাজ করে গেছেন। যুদ্ধশেষের প্রাপ্য চেয়ে গলা হাঁকাননি। বরং যুদ্ধশেষের নতুন নির্মাণের সঙ্গে প্রাণপ্রবাহ সঞ্চিত করে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় ও বলীয়ান ছিলেন। জন্মেছিলেন কুষ্টিয়া শহরে ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর। পিতা ছিলেন আইনজীবী ও সঙ্গীতজ্ঞ খোন্দকার লুৎফুল হক এবং মা সকিনা বেগম। সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁদের। বাড়িতে গানের জলসা হতো। সে কারণে সে বাড়ির প্রায় সবাই সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। অনুজ মান্না হক স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। অপর ভাই খোন্দকার রশিদুল হক নবা শিক্ষকতা ছাড়াও ছিলেন পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। অনুজ লালিম হক একজন লেখক ও আইনজীবী। তাঁদের অগ্রজ রাজু আহমদ ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক এবং বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্র অভিনেতা। আততায়ীর গুলিতে ১৯৭৪ সালে তিনি নিহত হন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন বাদশা ভাই। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। জেলখানায় বসে তিনি এমএ পরীক্ষা দেন এবং ভাল ফল করেন। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকালে গ্রেফতার হয়ে জেলও খাটেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকালে তিনি ছিলেন রাজপথের সাহসী সৈনিক। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্ত হওয়ার পর তিনিও কারাগার থেকে মুক্তি পান। সে সময় হতে বাদশা ভাই বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। স্বাধীনতার পরও এই পদে ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে মিছিলে যোগ দিতেন। পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদকও ছিলেন এবং ইকবাল হল তথা জহুরুল হক হল শাখার সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বেতারে কথিকা পাঠ ছাড়াও কোরাসে গলা মেলাতেন। এ ছাড়া কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের বাহ্যিক প্রচার বিভাগেও কর্মরত ছিলেন। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে চিঠি লেখার কাজও করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। সুদর্শন এবং হাসি মুখের মানুষটি মুগ্ধ করে রাখতে পারতেন সমবেতদের। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে তিনি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের বঙ্গবন্ধু সান্নিধ্য স্মৃতি তুলে ধরতেন। নির্ভার গদ্য আর কাহিনীর বুনন পাঠককে মোহাবিষ্ট করত। সৌম্যকান্তি, লম্বা, মায়াময় চেহারার মানুষটাকে যাঁরা তাঁর তারুণ্যে দেখেছেন, তাঁদের কাছে মহানায়ক উত্তম কুমারের আদলটা সামনে উঠে আসত। কথা বলার ঢঙের মধ্যেও উত্তম কুমারের ছাপ পাওয়া যেত। বিশুদ্ধ বাংলা বিশেষত নদীয়া-শান্তিপুরী বাংলায় যখন কথা বলতেন, মুগ্ধ হয়ে শুনতে হতো। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনকালে তিনি সংবাদপত্র ও সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে সংযোগ রাখতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের দেখা সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করতেন। শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাঁকে মুজিব পরিবারের একজন সদস্যে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর রাজাকার পুনর্বাসনকারী সামরিক জান্তা জিয়া সরকার তাঁকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করে। এরপর তিনি বিলেতে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করেন। এ সময় তিনি ভারত, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতেন। এটিএন বাংলা ইউকেতে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। প্রবাসকালে বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি ও কমনওয়েলথ সাংবাদিক এ্যাসোসিয়েশন ইউরোপ শাখার নির্বাহী সদস্য ছিলেন। ঢাকার কাগজেও মাঝে মধ্যে লিখতেন। দু’সন্তানের জনক বাদশা ভাইয়ের এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৪টি। সৎ সাংবাদিকতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাদশা ভাইয়ের আত্মবিশ্বাস ছিল অফুরন্ত। যা বিশ্বাস করতেন, সেই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট থাকতেন। কারও রক্তচক্ষুকে যেমন ভয় পেতেন না, তেমনি কারও অনুকম্পাও মেনে নিতেন না। প্রবাসের জীবনেও ছিলেন তিনি পুরোপুরি বাঙালী। বাঙালিয়ানাকে প্রসারিত করার জন্য বিলেতে নানা কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। নতুন প্রজন্মকে সব সময় উৎসাহ দিতেন। প্রবাসীদের সব সময় শেকড়ের বন্ধনে আবদ্ধ রাখতে কাজ করে গেছেন । বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সময় তুখোড় মেধাবী এই ব্যক্তিত্ব ছিলেন না পরশ্রীকাতর। বরং পরহিতকারী ছিলেন। অন্যের দুঃখে দুঃখী ও সমব্যথী হতেন। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর গভীর মনোযোগ। প্রতিবছর তিনি বাংলাদেশে আসতেন। একুশের বইমেলায়ও তাঁকে পাওয়া যেত। এবারও একুশ সমাগত, কিন্তু বাদশা ভাই আর আসবেন না বইমেলায় এবং শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে। সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় তিনি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। কিন্তু রয়ে গেছেন আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এবং ইতিহাসের পাতায়। টুপিখোলা স্যালুট; হে বীর বাদশা ভাই।
×