ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাজীপুরে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ আবুল হাশেম জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

গাজীপুরে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ আবুল হাশেম জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ গাজীপুরে কমিউটার ট্রেন লক্ষ্য করে অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমা হামলায় দগ্ধ সত্তরোর্ধ আবুল হাশেম এখন ঢাকা মেডিক্যালের সার্জারি ওয়ার্ডে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মাথায় আঘাত পাওয়ায় সাতদিন ধরে তিনি অচেতন। মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন স্থান পুড়ে গেছে। হাসপাতালে বেডে তার নিস্তেজ দেহ পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে কষ্ট ও যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছেন। কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছেন তিনি। নাকে নল লাগিয়ে দুধ ও কোমল পানীয়সহ তরল জাতীয় খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। চলছে স্যালাইন। বয়সের ভারে নুয়েপড়া হতদরিদ্র কৃষক আবুল কাশেমের শয্যাপাশে দিনরাত পালাক্রমে সেবা করছেন স্বজনরা। চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পরিবারটি হিমশিম খাচ্ছে। কেউ তার খোঁজ নেয়নি। সরকারীভাবে সাহায্য-সহযোগিতার কথা বলা হলেও তিনি এখনও পান না। এমন অভিযোগ করে তার স্বজনরা জানান, ঘটনার পর এ পর্যন্ত কেবল রেলমন্ত্রীর পক্ষ থেকে চিকিৎসাসেবা বাবদ ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান পেলেও সরকারীভাবে আর কোন আর্থিক সহায়তা পাননি তিনি। সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার গ্রহণ করার কথা থাকলেও সিটিস্ক্যান, রক্তসহ বিভিন্ন প্যাথলজি পরীক্ষা করাতে হচ্ছে তাকে। চিকিৎসার খরচ যোগাতে জমি বন্ধক রেখে টাকা যোগাড় করে তার চিকিৎসা চালানো হচ্ছে। তাঁরা অভিযোগ করেন, সবার দৃষ্টি শুধু বার্ন ইউনিটের দিকে। তাঁদের দিকে কেউ খোঁজ নেয় না। এদিকে নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমা হামলায় আবুল হাশেমের মাথায়, গলায় ও দু’হাতে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। শ্বাসনালীও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে বাঁচিয়ে তুলতে জরুরী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হতে পারে বলেও চিকিৎসকরা জানান। গত ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে গাজীপুর শ্রীপুর রেলস্টেশনের আউটার সিগন্যাল এলাকায় জামালপুরগামী কমিউটার ট্রেনের একটি বগি লক্ষ্য করে এই পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে অবরোধকারীরা। এতে ট্রেনের আবুল হাশেমসহ প্রায় ১৫ যাত্রী দগ্ধ হন। প্রথমে শ্রীপুর উপজেলা কমপ্লেক্স হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে অবস্থা অবনতি হলে মধ্যরাতে তাঁকে ঢাকা মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের ইউনিট-৩ এর ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ নম্বর মুমূর্ষু ১ বেডে ভর্তি করা হয়। ওই ওয়ার্ডে ডাঃ রাজিবুল হকের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। সরেজমিন ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, হরতাল-অবরোধকারীদের পেট্রোলবোমা হামলায় মারাত্মক দগ্ধ হতদরিদ্র কৃষক আবুল হাশেমের দেহ বেডে নিথর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করছেন। নাকে নল লাগিয়ে দুধ ও কোমল পানীয় খাওয়ানো হচ্ছে। চলছে স্যালাইন। তাঁর শয্যাপাশে পালাক্রমে চিকিৎসার খোঁজ-খবর রাখছেন ছেলে শাহজাহান, ভাতিজা সুমন ও একই ঘটনার শিকার সুস্থ হয়ে ওঠা চাচাত ভাই সাইদুল ইসলাম। তাঁরা সবাই চিকিৎসাধীন দগ্ধ আবুল হাশেমের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই অজানা আতঙ্কে আঁতকে উঠছেন স্বজনরা। দগ্ধ আবুল হাশেমের চাচাত ভাই সাইদুল ইসলাম জানান, আবুল হাশেম একজন কৃষক। তিনি ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার কাদিরপুর নিবাসী মৃত আব্দুর রহমান ও জেলেকা বানু দম্পতির ২ মেয়ে ৫ ছেলের মধ্যে সবার ছোট। তাঁর স্ত্রীর নাম ফজিলা খাতুন। তিনি ২ ছেলে ১ মেয়ের জনক। সপরিবারে থাকেন গ্রামের বাড়িতে। গ্রামের বাড়িতে বিভিন্ন জমিতে কৃষি কাজ করে পুরো সংসার চালাতেন। ছেলে শাহজাহান তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা দেশব্যাপী চলমান লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীর কারণে গ্রামে কৃষি কাজও ঠিকমতো করতে পারছেন না। এতে প্রায়শই পরিবারের সদস্যরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাচ্ছিলেন। এই সংবাদ শুনে গাজীপুরের জয়দেবপুর নিবাসী গার্মেন্টসকর্মী ভাতিজা দুলাল তাঁর সংসারে মাঝে মধ্যে আর্থিক সহায়তা করতেন। পরে ভাতিজা দুলালের পরামর্শে গত ২ ফেব্রুয়ারি সকালে গফরগাঁও থেকে ট্রেনে গাজীপুরের জয়দেবপুরে আসেন বৃদ্ধ আবুল হাশেম। সেখানে ভাতিজা দুলালের সঙ্গে দেখাও করেন। দুপুরের খাবার খান। পরে ভাতিজার কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে বিকেল ৪টায় গাজীপুর থেকে জামালপুরগামী একটি কমিউটার ট্রেনে উঠে নিজগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেন আবুল হাশেম। এ সময় চাচাত ভাই সাইদুর ইসলাম তাঁর সঙ্গে ওই ট্রেনে যাচ্ছিলেন। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাঁদের বহনকারী কমিউটার ট্রেনটি গাজীপুরের শ্রীপুর পৌঁছলে হরতাল-অবরোধের সমর্থনে অবরোধকারী সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারে। তখন যাত্রীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ট্রেনের বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই পুরো বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। দগ্ধ আবুল হাশেমের চাচাত ভাই সাইদুল ইসলাম আরও জানান, আগুনের ভয়াল থাবা থেকে জানালার ফাঁক গলিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ে তিনি। কিন্তু ততক্ষণে পেট্রোলবোমায় তার দু’হাত, মাথা, ঘাড়, পিঠ, গলা, কান ও কোমড় আগুনে পুড়ে যায়। আগুনে তার পায়ের গোড়ালি ও মাথার বেশকিছু অংশ ঝলসে যায়। পরে তিনি আহত অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয়দের সহায়তায় চাচাত ভাই হাশেমকে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় বাইরে বের করেন। পরে পুলিশ ও স্থানীয়রা দ্রুত তাদের উদ্ধার করে প্রথমে শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে তাদের দু’ভাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের পরামর্শে ওইদিন রাত পৌনে ১০টায় তিনি তাঁর চাচাত ভাই আবুল হাশেমকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁদের দু’জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পা ও মাথায় আঘাতের কারণে ওইদিন রাত প্রায় ১২টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের সার্জারি বিভাগের ইউনিট-৩-এর অধীনে ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করেন। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিলেও তাঁর চাচাত ভাই আবুল হাশেমকে ওই ওয়ার্ডের ৪ নম্বর মুমূর্ষু ১ বেডে ভর্তি করেন। পরদিন সকালে তাঁকে ডাঃ রাজিউল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, পরেরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর চিকিৎসার খরচ বাবদ রেলমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদের হাতে ১০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে দগ্ধ হাশেমের ছেলে শাহজাহান ও চাচাত ভাই সাইদুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এখনও কোন আর্থিক সাহায্য পাননি তাঁরা। শাহজাহান আরও জানান, ভর্তি করানোর পরদিন বড় ডাক্তারের পরামর্শ ও নির্দেশে ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ব্রাদার-স্টাফরা তাঁর বাবা আবুল হাশেমের একটি সিটিস্ক্যান করেন। ওই সিটিস্ক্যান করাতে তাঁদের কোন টাকা লাগেনি। ভর্তি করানোর পর থেকে এ পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে সরবরাহকৃত ওধুষপত্র বিনামূল্যে দেয়া হলেও বেশ কয়েককটি মূল্যবান ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনে দিতে হয়েছে। দগ্ধ হাশেমের ছেলে শাহজাহান ও চাচাত ভাই সাইদুল ইসলাম আরও বলেন, চিকিৎসকের পরামর্শে শনিবার দ্বিতীয় দফায় ঢাকা মেডিক্যালের এক্সরে বিভাগ থেকে আবুল হাশেমের সিটিস্ক্যান ও প্যাথলজি বিভাগ থেকে রক্তসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সিটিস্ক্যান করাতে তাদের প্রায় আড়াইহাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। এছাড়াও আবুল হাশেমকে ভর্তি করানোর পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলেও দাবি করে তাঁর স্বজন-পরিবার। তাঁরা আরও বলেন, হরতাল-অবরোধের সহিংসতায় আহতদের চিকিৎসায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বরাদ্দকৃত নগদ ১০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান এখনও তাঁরা কেউ পাননি, এমনকি কেউ তাদের বলেনি ও দেননি। সাইদুল ইসলাম আরও জানান, ওই ঘটনায় তিনিও সামান্য আহত হলেও সরকারীভাবে কোন আর্থিক সহায়তা এখনও পাননি। তাঁর বাবার নাম মৃত কলুমুদ্দিন। মা আছিয়া খাতুন। ৪ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। তাঁর স্ত্রীর নাম হালিমা খাতুন। দাম্পত্য জীবনে ৩ মেয়ে ২ ছেলের জনক বলেও জানান তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আবুল হাশেমের ছেলে শাহজাহান জানান, নিউরো সার্জারি বিভাগের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ নম্বর মুমূর্ষু ১ নম্বর বেডে আবুল হাশেমের চিকিৎসা চললেও তাঁকে দেখতে তাঁর পরিবারের কাউকে এমন বীভৎসতার কথা জানানো হয়নি। এতকিছুর পরও তাঁর বাবা আবুল হাশেম সুস্থ হয়ে যেন তাঁদের মাঝে ফিরে আসেন। তাঁর চিকিৎসার খোঁজ-খবর নিতে তিনি স্ত্রী, সন্তান ও বৃদ্ধ মা জেলেকা বানু দিনরাত পালাক্রমে বাবা আবুল হাশেমের শয্যাপাশে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন।
×