ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফোরকান চিনিয়ে দেয়ার পর পাকি সেনারা দেবেন ডাক্তারকে হত্যা করে

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ফোরকান চিনিয়ে দেয়ার পর পাকি সেনারা দেবেন ডাক্তারকে হত্যা করে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ষষ্ঠ সাক্ষী মোঃ হাবিবুর রহমান মৃধা জবানবন্দী প্রদান করেছেন। জবানবন্দী শেষে আজ আসামি পক্ষের আইনজীবীকে জেরা করার জন্য দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। জবানবন্দীতে সাক্ষী বলেন, রাজাকার ফোরকান মল্লিক সুবিদখালীর দেবেন ডাক্তারের স্ত্রী বিভা রানীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ফোরকান চিনিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানী সেনারা দেবেন ডাক্তারকে গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়া ফোরকান মল্লিকের নির্দেশে তিনজন হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করে মুসলমান বানায়। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষী এ কথা বলেছেন। ট্রাইব্যুনালে অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলাম। সাক্ষীকে জবানবন্দীতে সহায়তা করেন প্রসিকিউটর মোখলেসুর রহমান বাদল ও প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি। সাক্ষী জবানবন্দীতে বলেন, আমার নাম মোঃ হাবিবুর রহমান মৃধা। পিতা-মৃত মিনাজ উদ্দিন মৃধা, গ্রাম-পশ্চিম সুবিদখালী, থানা- মির্জাপুর, জেলা- পটুয়াখালী। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৬০/৬১ বছর। আমি নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। বর্তমানে আমি মৌসুমী ব্যবসা করি এবং মির্জগঞ্জ থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পটুয়াখালীতে আসে। ১৯৭১ সালের বাংলা শ্রাবণ মাসে মির্জাগঞ্জ থানার আজাহার উদ্দিন খান, আসামি ফোরকান মল্লিক, হামিদ খান, মোজাফ্ফর খান, ওয়াজেদ সিকদার, কাঞ্চন মেম্বার, শাহজাহান শিকদার প্রমুখ পিস কমিটি গঠন করে এবং মির্জাগঞ্জে পুরাতন হাসপাতালে রাজাকার ক্যাম্প গঠন করে। প্রসিকিউশনের সাক্ষী আরও বলেন, ১৯৭১ সালে আমি এবং আমার পিতা সুবিদখালী বাজারে গঙ্গাচরণের মিষ্টির দোকানে দুধ সরবরাহ করতাম। আমাদের গরুর খামার ছিল। এই মিষ্টির দোকানটি দেবেন্দ্র ডাক্তারের ওষুধের দোকানের সংলগ্ন পশ্চিম দিকে ছিল। ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট সকাল বেলা গঙ্গাচরণের দোকানে দুধ সরবরাহ করার পর গঙ্গাচরণ দুধের প্রাপ্য টাকা বিকালে নিতে বলেন। আনুমানিক দুইটা আড়াইটার দিকে দুধের টাকা আনতে গঙ্গাচরণের দোকানে যাই। টাকার জন্য আমি অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে দেখি দোকানের সামনে আকাবর গাজী, ফোরকান মল্লিক, শাহজাহান সিকদার, জবেদ আলী খান, হামেদ গাজী প্রমুখ রাজাকারসহ সেনারা কাদের জমাদ্দার সাহেবরে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে আমি যেখানে ছিলাম সে দিকে আসছে। তারা পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে আসছিল। এ সময় গঙ্গাচরণ আমাকে বলে, মনু টাকা পরে নে, মিলিটারি আসতাছে, তাড়াতাড়ি তুই পালা। আমি দোকান বন্ধ করব। বেঁচে থাকলে টাকা পরে নিস। এর পর দেখতে পাই আসামি ফোরকান মল্লিক, কমান্ডার শাহজাহান সিকদারসহ অন্যান্য রাজাকাররা পাকসেনাদের নিয়ে বাঁধা অবস্থায় কাদের জমাদ্দারকে নিয়ে দেবেন ডাক্তারের ঘরের সামনে উপস্থিত হয়। এই অবস্থা দেখে দেবেন্দ্র ডাক্তার পালাবার চেষ্টা করেন। তখন ফোরকান মল্লিক এবং রাজাকার কমান্ডার শাহজাহান সিকদার পাকসেনাদের দেবেন ডাক্তারকে চিনিয়ে দেয়। তখন পাকসেনাদের একজন পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে তা পড়ে দেবেন ডাক্তারকে লাথি মারে। এ সময় অন্য রাজাকাররা দেবেন ডাক্তারের ঘরে লুটপাট করে। দেবেন ডাক্তারের কক্ষের পূর্ব পাশের ঘরে অবস্থানরত হারান কবিরাজ (তখন বয়স ছিল ৯০ বছর) পাকসেনাদের অনুনয়-বিনয় করে বলে, দেবেন ডাক্তার অত্যন্ত ভাল মানুষ, তিনি নিঃসন্তান, তাকে দয়া করে মারবেন না। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পাক সেনাদের একজন হারান কবিরাজকে চপেটাঘাত করে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়লে তার নাতি শান্তিরঞ্জন কবিরাজ হাতে ধরে তার দাদুকে দাঁড় করায়। তখন আমি আরও দেখতে পাই দেবেন ডাক্তারের স্ত্রী বিভারানী রাজাকার এবং পাকসেনাদের তার স্বামীকে না মারার জন্য অনুনয় বিনয় করলে ফোরকান মল্লিক প্রথমে ধাক্কা দিয়ে বিভারানীকে ফেলে দেয়। এ সময় দেবেন ডাক্তারকে একজন পাকসেনা গুলি করে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে। এই অবস্থায় ফোরকান মল্লিক তার হতে থাকা রাইফেলের বেয়নেট দিয়ে বিভারানীকে আঘাত করে। এ ছাড়া সাক্ষী বলেন, আমাদের পাশেই রমনী কুন্ডুদের দোকান ছিল। এ সময় কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাই। পরে জানতে পারি পাকসেনা ও রাজাকাররা কাদের জমাদ্দার ও হাফেজ খলিফাকে গুলি করে হত্যা করেছে। দুই দিন খোঁজাখুঁজির পর এ দুই জনের লাশ পায়রা নদীর চর থেকে উদ্ধার করা হয়। আমরা কাদের জমাদ্দারের লাশ দেখেছি। তার লাশ তার গ্রামের বাড়ি আমড়াগাছিয়ায় দাফন করা হয়। হাফেজের লাশ কাকড়া বুনিয়োতে নিয়ে দাফন করা হয়।
×