ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বইপ্রেমী মানুষ দল বেঁধে আসছেন

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বইপ্রেমী মানুষ দল বেঁধে আসছেন

মোরসালিন মিজান ॥ এক সপ্তাহর বেশি বয়সী মেলা। সঙ্গত কারণেই লোক সমাগম মন্দ নয়। প্রতিদিনই দলবেঁধে আসছেন বইপ্রেমী মানুষ। একা বা দু’জনের জুটিও বেশ চোখে পড়ছে। দলবেঁধে আসা মানুষজন মেলায় উৎসবের আমেজ ছড়ালেও, বই তেমন কিনছেন না। ভাল ক্রেতা নয় তাঁরা। বই দেখা ও কেনার কাজে বেশি ব্যস্ত একলা আসা পাঠক। জুটিবদ্ধ হয়ে আসা নারী-পুরুষও ক্রেতা হিসেবে এগিয়ে। গত শুক্রবার থেকে বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান দুই ভেন্যুতেই ভাল উপস্থিতি চোখে পড়ছে। বড় অংশটি মেলায় আসছে দলবেঁধে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এঁরা পরস্পরের বন্ধু। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ুয়া। ক্লাস শেষ করে দলবেঁধেই প্রবেশ করছেন মেলায়। এমন কয়েকটি দলকে অনুসরণ করে দেখা যায়, উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত তারা। মাঝে মাঝে বই হাতে নিচ্ছেন বটে। কিনছেন কালেভদ্রে। সোমবার ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল এসেছিল মেলায়। সংখ্যায় ৮ জন। সকলেই অনার্সের ছাত্র। মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় পুরোটা কয়েকবার ঘুরে দেখে দলটি। স্টলের সামনে দিয়ে যায়। বইও দেখে হাতে নিয়ে। তবে কাউকেই বই কিনতে দেখা যায় না। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাঁদের কিছু আলোচনাও কানে আসে। এ আলোচনার কোন অংশেই বই জায়গা পায়নি। একে অন্যের সঙ্গে নিজেদের ব্যক্তিগত আলোচনা করছিলেন। চলছিল হাসি ঠাট্টা। বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথা হলো দলের সদস্য শাখাওয়াতের সঙ্গে। কোন বই পছন্দ হয়নি? জানতে চাইলে কিছুটা বিব্রত চেহারা করে তিনি বলেনÑ না, আসলে বই পছন্দ হয়েছে। তবে আরও বই আসবে তো তখন কিনব। অন্য বন্ধুটি সে কথা থেকেই যেন অনুপ্রেরণা পেলেন। বললেন, বই আজকে দেখে গেলাম। কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বইয়ের তালিকাও নিয়ে যাচ্ছি। পরে বই কিনতে আসব। অন্য একটি দলে ছেলেদের পাশাপাশি ছিল মেয়েরাও। মেলার ইউপিলের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে ছবি (সেলফি) তোলা দিয়ে তাঁদের শুরু। তরুণ-তরুণীদের হাসি হুল্লোড় মেলার উৎসবের দিকটি সামনে নিয়ে আসে। যেদিকে দলটি যায় সেদিকেই রাশিরাশি আনন্দ। মন্দ লাগে না। কিন্তু ৬ জনের এই দলের সঙ্গী হয় একটিমাত্র বই। এতো মানুষ। একটি বই। চলবে তো? জানতে চাইলে মজা করার আরও একটি সুযোগ পেলেন যেন শাম্মী। তাঁর জবাবÑ ভাবছিলাম ওরা (ছেলে বন্ধুরা) বই কিনে দেবে। দিল না। কী আর করা, খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি। তবে একা বা অপেক্ষাকৃত কম লোকজন নিয়ে আসা পাঠক বই দেখা ও কেনায় মন দিয়েছেন। হালকা ভিড় হওয়ায় সুযোগটি তাঁরা বেশ কাজে লাগাচ্ছেন। একাধিক পাঠককে অনুসরণ করে এমন ধারণা হয়েছে। মিরাজুল আবেদ নামের এক মাঝবয়সী এসেছিলেন মগবাজার থেকে। তাঁর এক হাতে ব্যাগ। সেখানে ৫টি বই। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, অনেক বই পছন্দ হয়েছে। কয়েকটা নিলাম। একটু গবেষণা ধর্মী বই। আরও কয়েকদিন আসতে হবে। বাকি বইগুলো নিতে আসব। জনপ্রিয় কথাশিল্পী আনিসুল হকের দু’টি উপন্যাস কিনতে দেখা গেলা জুয়েলকে। জুয়েল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে ছিল তানিয়া। কথা বলে জানা গেল, একে অন্যকে বই দুটি তাঁরা উপহার হিসেবে দিয়েছেন। জনকণ্ঠকে জুয়েল বললেন, এখন মেলায় চাপ কম। বই দেখা যায়। তাই আগেভাবে আসা। ঢাকায় আসতে সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। তা না হলে প্রতিদিনই মেলায় আসতাম। অবশ্য প্রকাশকরা বলছেন এমনটি হতেই পারে। অতিদ্রুতই অবস্থা বদলে যাবে। কীভাবে বদলাবে? জানতে চাইলে আগামী প্রকাশনীর কর্ণধার ওসমান গনি বলেন, কয়েকদিন পর মূল পাঠকরা আসতে শুরু করবে। তখন যারা বই কেনে না তারা পেছনে পড়ে যাবেন। তাদের নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে। অবশ্য আড্ডা, গল্পও বইমেলারই অংশ বলে মনে করেন তিনি। বলেন এটা প্রাণের মেলা। এখানে প্রাণ থাকা চাই। ১২৯ নতুন বই প্রতিদিনের মতো সোমবারও মেলায় এসেছে বেশ কিছু নতুন বই। শুধু বাংলা একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়া বইয়ের সংখ্যা ছিল ১২৯টি। এদিন নজরুল মঞ্চে ৭টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। নির্বাচিত বই কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে আনিসুজ্জামানের ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’। ৩০টি প্রবন্ধের এই সঙ্কলনে নানা বিষয় ওঠে এসেছে। বিষয় বৈচিত্র্যের পাশাপাশি আছে জরুরী তথ্য। বইটিত বাঙালী সংস্কৃতি ও বাঙালীর ইহজাগতিকতার স্বরূপ-সন্ধানের প্রয়াস পেয়েছেন প্রাবন্ধিক। আনিসুজ্জামানের অভিজ্ঞতায় গড়ে ওঠা বিষয়ের নিপুণ ও নির্ভুল পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রবন্ধগুলো সমকালের এক পরিশীলিত মনীষার অনন্য ভাষ্য হিসেবে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। বেশ কিছু প্রবন্ধ নতুন চিন্তার সুযোগ করে দেবে পাঠককে। নালন্দা থেকে সোমবার মেলায় এসেছে ‘ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’। দীর্ঘদিন ধরে বইয়ের কাজ করছিলেন গোলাম কুদ্দুছ। সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে মাঠে থাকার পাশাপাশি এই বই লেখার কাজ করেন তিনি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন এ গ্রন্থের অন্যতম উপজীব্য। তারও আগে বাংলা কে ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সংগ্রাম করতে হয়েছে অপরাপর ভাষা, সাম্প্রদায়িক শক্তি, উচ্চতর শ্রেণী ও শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে। সেসব কথা বলার চেষ্টা করেছেন লেখক। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার লড়াই এবং বাংলা ভাষা উদ্ভবের সংক্ষিপ্ত বিবরণীও থাকছে বইতে। মেলায় ছোটদের বইয়ের রয়েছে আলাদা কদর। সেই বিবেচনায় আসছে প্রচুর বই। কালান্তর প্রকাশনী থেকে মেলায় এসেছে কাওসার রহমানের শিশুতোষ রচনা ‘শশ্মান ঘাটের ভূত’। দেশ বিদেশের রূপকথার ওপর ভিত্তি করে লেখা বই শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। মেলা মঞ্চের আয়োজন সোমবার গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্যারীচাঁদ মিত্রের দ্বিশততম জন্মশতবর্ষ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. আমিনুর রহমান সুলতান এবং ড. মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করেন মোরশেদ শফিউল হাসান। প্রাবন্ধিক বলেন, উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র ছিলেন স্রষ্টা এবং কর্মযোগী মানুষ। জন্মের পর দু’শ’ বছর অতিক্রান্ত, মৃত্যুর পরও আমরা পেরিয়ে এসেছি একশ বত্রিশ বছর-তবু বাংলাভাষী মানুষের কাছে এখনও তিনি এক স্মরণীয় নাম। ভাষাবিদ্রোহী, সমাজনিষ্ঠ কথাকার, মানবউন্নয়ন সংগঠন, সাংবাদিক, অধ্যাত্মচিন্তক-নানাভাবে তাঁকে আমরা স্মরণ করতে পারি। দ্বিশততম জন্মবর্ষের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্যারীচাঁদের কর্ম ও সাহিত্যসাধনা বিচার করতে বসলে তাঁকে অনায়াসেই ঊনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকিত মানুষ হিসেবে শনাক্ত করা যায়। ঊনিশ শতকের লেখক হলেও, প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমাত্রিক কারণে এখনও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক বলে বিবেচিত হতে পারেন। সাহিত্যের বিষয় ও ভাষা যে সমকালীন জীবন ও জনসাধারণের কথ্যভাষা থেকে গ্রহণ করা যায়Ñ বাঙালী লেখককে তিনি এ কথা শিখিয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যের উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর আমৃত্যু সংগ্রাম। আলোচকদ্বয় বলেন, প্যারীচাঁদ মিত্রকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে না দেখে তার সময়ের সন্তান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ঊনিশ শতকের উপনিবেশিত সমাজ, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, ভদ্রলোক শ্রেণী, নিম্নবর্গ, ভাষারাজনীতি ইত্যাদি নানা প্রেক্ষিতে প্যারীচাঁদ মিত্রকে অবলোকন প্রয়োজন। তারা বলেন, এ পর্যন্ত আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত আধুনিকতার পরিসর পুনর্মূল্যায়িত হলে প্যারীচাঁদ মিত্রও প্রকৃত মূল্যায়ন পাবেন। সভাপতির বক্তব্যে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, প্যারীচাঁদ মিত্রকে বুঝতে হলে ঊনিশ শতকের সমাজ এবং ব্যক্তি ও ইতিহাসের দ্বন্দ্বকে বুঝতে হবে। তার অবদান কেবল ভাষাক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল না বরং সাময়িকপত্র সম্পাদনা, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন সে অনুপাতে তার প্রতি যথার্থ মূল্যায়ন করা হয়নি। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তামান্না তিথির পরিচালনায় নৃত্য সংগঠন ‘কল্পরেখা’ এবং আবুল ফারাহ্ পলাশের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটি’। আজকের অনুষ্ঠান আজ মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলামের নব্বইতম জন্মবর্ষ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ড. মুহাম্মদ সামাদ, অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম এবং ড. এম. অহিদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করবেন কমরেড অজয় রায়।
×