ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নানা আইডি ঘেঁটে শিবির ছাত্রদল যুবদলের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে

ইন্টারনেট ফেসবুকে পেট্রোলবোমা তৈরির প্রশিক্ষণ!

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

ইন্টারনেট ফেসবুকে পেট্রোলবোমা তৈরির প্রশিক্ষণ!

আরাফাত মুন্না ॥ চলমান অবরোধ ও হরতালে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সারাদেশে পেট্রোলবোমা হামলা চালানো হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি থেকে পরিকিল্পিতভাবে নির্দেশ ও পেট্রোলবোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া এসব আইডি থেকে আওয়ামী সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা চালানোর জন্য সরাসরি আহ্বান জানানো হচ্ছে। ওই আইডিগুলোর সঙ্গে ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও যুবদলের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে। ফেসবুকে ‘আমি মানুষ না আওয়ামী লীগ’ নামের একটি পেজ থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে কিভাবে পেট্রোলবোমা তৈরি ও ব্যবহার করতে হবে তা দেখানো হয়েছে। পেজটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এর প্রোফাইল পিকচারে লেখা রয়েছে ‘এসো হাসিনার পতন আন্দোলনে’। আর পেজটির কভার ফটোতে দেয়া হয়েছে কোরানের আয়াত। এই পেজটিতে যেসব পোস্ট দেয়া হয়েছে তার পুরোটাই সরকারবিরোধী নানা তথ্য। আরও একটি পেজে পেট্রোলবোমা তৈরির পদ্ধতিটি দেয়া হয়েছে নিউজের স্টাইলে। লেখাটি পড়লে মনে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন সদস্য পেট্রোলবোমা কিভাবে তৈরি করতে হয়, সে বিষয়ে ব্রিফ করছেন। এই পেজটি থেকে ২০১৩ সালের হেফাজতের আন্দোলনের সময়ের সরকারবিরোধী বিভিন্ন পোস্ট দেয়া হয়েছে। আরও একটি পেজ ‘তাজা খবর’ এই পেজে পেট্রোলবোমা তৈরির পদ্ধতি প্রকাশের পাশাপাশি, আওয়ামী লীগ সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর পেট্রোলবোমা হামলা চালানোর আহ্বানও জানানো হয়েছে। এসব পেজের লাইকারদের মধ্যে অধিকাংশের আইডিতেই রয়েছে সরকারবিরোধী বিভিন্ন পোস্ট। অনেকের আইডিতে আবার যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তির দাবিও জানানো হয়েছে। অন্যদিকে অবরোধ ও হরতালে দেশের বিভিন্ন স্থানে যে নাশকতা চালানো হচ্ছে তার নীলনক্সা করেছে জামায়াত। পেট্রোলবোমা তৈরি থেকে বোমা চার্জ করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অধিকাংশ স্থানেই রয়েছে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের সংশ্লিষ্টতা। অনেক স্থানে আবার ছাত্রদল, যুবদলের ক্যাডাররাও নাশকতাকারীদের সংগঠিত করছে। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তিসহ নানা দাবিতে আন্দোলনরত জামায়াত নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এ আন্দোলনের বিভিন্ন নীলনক্সা তৈরি করেছে। দলটি নাশকতার বিভিন্ন পরিকল্পনা তৈরি করে লন্ডনে অবস্থানরত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মাধ্যমে তা পৌঁছে দিচ্ছে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে। পরে তারেকের নির্দেশ অনুযায়ী ওসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। লন্ডন থেকে সম্প্রতি দেশে আসা একটি দায়িত্বশীল সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছে, গত ৬ জানুয়ারির আগে ও পরে ব্যারিস্টার রাজ্জাক ও তারেক রহমানের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে দেশে লাগাতার আন্দোলন চালানোর পরামর্শ তারেককে দিয়েছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। লন্ডনে তারেকের উপদেষ্টা পরিষদেও জামায়াতপন্থী দুই ব্যারিস্টার রয়েছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে। তারেক ও ব্যারিস্টার রাজ্জাকের সঙ্গে ইন্টারনেটে কথা বলার এ্যাপ্লিকেশনগুলোর মাধ্যমে জামায়াতের অনেক নেতাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ-হরতালে ঢাকার বাইরে ৫৭ উপজেলাকে ‘চরম ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানে যখন তখন হামলা-ভাংচুর চালানো হচ্ছে, ছুড়ে মারা হচ্ছে পেট্রোলবোমা। এসব এলাকায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপির একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভাব না থাকলেও দলীয় ক্যাডাররা নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতেই নাশকতামূলক কর্মকা-ে মেতে উঠেছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের তথ্য মতে ঢাকা বাইরে ৬২ উপজেলা থেকে আসা পেট্রোলবোমায় দগ্ধ রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন তারা। এদের মধ্যে অনেকে বাড়ি ফিরলেও অধিকাংশই এখনও চিকিৎসাধীন। পেট্রোলবোমার দাপট যেসব এলাকায় ॥ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, সীতাকু-, ফটিকছড়ি, কক্সবাজার সদর, চকোরিয়া, উখিয়া, মহেশখালী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও সংলগ্ন এলাকা, ফেনীর সোনাগাজী, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর সদরের একাংশসহ উপকূলীয় দুটি উপজেলা, চাঁদপুরের বেশিরভাগ অংশ, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এবং কুমিল্লা কোতোয়ালি ও সদর দক্ষিণ থানার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বেশিরভাগ এলাকা, সিলেট মহানগরের একাংশসহ দূরবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলা, কানাইঘাট, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতায় পেট্রোলবোমার দাপট দেখা গেছে। উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতার খবর মেলে রংপুরের বদরগঞ্জ, পীরগঞ্জ, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, নীলফামারী, লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী দুটি উপজেলা এলাকা, বগুড়ার একাংশ, জয়পুরহাট, পাবনার নগরবাড়ী-কাজীপুর থেকে সাঁথিয়া, নাটোরের সিংড়া-বনপাড়া, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রায় সর্বত্রই। এসব এলাকায় বেপরোয়া হামলা, ভাংচুর, বোমাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এসব নাশকতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সম্প্রতি পুলিশ, ডিবি, বিজিবি, র‌্যাব বিভিন্ন জেলায় ধারাবাহিকভাবে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর কারণে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে হামলার পরিমাণ কিছুটা কমে এসেছে। বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডাররা নিজ নিজ জেলা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আত্মগোপনে বাধ্য হচ্ছেন। ডিবির একটি সূত্র জানায়, যৌথ অভিযান শুরুর পর বিভিন্ন জেলা থেকে পলায়নের পর অন্তত পাঁচ হাজার শিবির ক্যাডার রাজধানীতে প্রবেশ করেছে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা-কাজলা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মানিকনগর, রামপুরার বনশ্রী এলাকা, বাড্ডা, বড় মগবাজার এলাকার বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও মেসে অবস্থান নিয়েছে তারা। এরই মধ্যে বেশকিছু ক্যাডারের নাম-পরিচয়সহ একাধিক তালিকা তৈরি করেছে ডিবি। এ তালিকা নিয়েই মহানগর পুলিশ ও গোয়েন্দারা অভিযানে নামছে। এর আগে ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-শিবির একটানা ১৯ জেলার ৬৩ উপজেলায় ব্যাপক জ্বালাও-পোড়াও চালায়। সে অনুযায়ী চলমান আন্দোলনে হামলায় আক্রান্ত জেলা ও স্থানের সংখ্যা কমে এলেও নাশকতার ভয়াবহতায় কোন কমতি নেই। দিনের আলোতে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মী-সমর্থকদের চেহারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। অথচ সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক নেমে আসছে। রাতের আঁধারে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট ছাড়াও যেখানে-সেখানে হামলা চালাচ্ছে নাশকতাকারীরা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হামলার টার্গেট সড়ক-মহাসড়কের চলন্ত যানবাহন। নাশকতা প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা টহল দিচ্ছে মহাসড়কে। ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে পর্যাপ্ত আনসারও মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ অভিযান, ধরপাকড়ও থেমে নেই। এ পরিস্থিতিতে মহাসড়ক ও চলন্ত যানবাহনগুলো অবরোধ সমর্থকদের হামলার টার্গেট হওয়ায় সীমাহীন আতঙ্কে ভুগছেন যাত্রী। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রধান সড়কগুলো এখন অবরোধ সমর্থকদের সবচেয়ে বেশি নাশকতার টার্গেট হিসেবে পরিণত হয়েছে। শুরু থেকেই নাশকতাকারীরা রেলপথে বেশি করে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে। তবে সেখানে এখন পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়ায় নাশকতাকারীরা মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনকে লক্ষ্যবস্তু করছে। গত এক মাসে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে দুই শতাধিক হামলায় অন্তত ৩৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ।
×