ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংলাপ না প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক পথে সন্ত্রাস মোকাবেলা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সংলাপ না প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক পথে সন্ত্রাস মোকাবেলা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বিএনপির সঙ্গে সরকারের কোন সংলাপ হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় বলেন, বিএনপির সঙ্গে কোন সংলাপ নয়। তারা সন্ত্রাসী কায়দায় যে হামলা চালাচ্ছে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক পথে তা মোকাবেলা করা হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের লাগাতার অবরোধ-হরতালের মধ্যে চলমান নাশকতা বন্ধে একসঙ্গে তিনটি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। সন্ত্রাস দমন আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দ্রুত বিচার আইনের প্রয়োগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে মত এসেছে মন্ত্রিসভার বৈঠকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মন্ত্রিসভার সদস্য জনকণ্ঠকে বলেন, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক শেষে সিনিয়র মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দেশব্যাপী চলমান নাশকতা নিয়ে মন্ত্রিসভায় আলোচনার সূত্রপাত করেন কয়েক মন্ত্রী। পরে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীকে আইনের বিষয়ে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী বলেন, এসব নাশকতা মোকাবেলায় নতুন করে আইন প্রণয়নের কোন প্রয়োজন নেই। সন্ত্রাস দমন আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও দ্রুত বিচার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে নাশকতা বন্ধ করা যাবে। আইনমন্ত্রী আরও বলেন, সন্ত্রাস দমন আইনের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে একে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সম্পৃক্ত করাও আবশ্যক। অপর এক সিনিয়র মন্ত্রী বলেন, বিএনপি যা করছে তা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়। তারা সন্ত্রাস করছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এ সময় বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের কথা বলা হয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের পক্ষ থেকে। আলোচনার একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপির সঙ্গে কোন সংলাপ হবে না। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে। এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রশাসনিকভাবে মোকাবেলা করা হবে। তিনি বলেন, তারা কিসের দাবিতে আন্দোলন করছে? তাদের সুনির্দিষ্ট কোন এজেন্ড নেই। আমরা বৈধ সরকার। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছি। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। অংশ না নিলে আমাদের কী করার আছে? এখন তারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে। এই সন্ত্রাসী কর্মকা- কঠোর হাতে দমন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, অতীতে আমরা জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করেছি। এ দেশ থেকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রসাবাদ নির্মূল করেছি। তাদের এই সন্ত্রাসী কর্মকা-ও নির্মূল করা হবে। অর্নিধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী অন্য নেতাদের উদ্দেশ বলেন, সকলে নিজ নিজ এলাকায় যোগাযোগ রাখবেন। কোথাও কোন সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটলে দলীয় নেতাকর্মীরাও তা মোকাবেলায় এগিয়ে আসবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সকল সংসদ সদস্যকে এলাকায় তৎপরতা বাড়াতে বলা হয়েছে। আপনারাও এর তদারকি করবেন। সহিংসতার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘মারাত্মক’ ক্ষতি হচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিয়েছেন বৈঠকে। একজন মন্ত্রী বলেন, আন্তঃজেলা যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় সবজি, মালামালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি হওয়ার বিষয়টিও তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন। নির্বাচনের বর্ষপূর্তির দিন গত ৫ ফেব্রুয়ারি সমাবেশ করতে না পেরে লাগাতার অবরোধ পালন করছে ২০ দলীয় জোট। বিরতি দিয়ে চলছে টানা হরতালও। এসব কর্মসূচীতে দেশব্যাপী মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটছে। এ কারণে তিন দফা পিছিয়ে নেয়া হয়েছে এসএসসি পরীক্ষা। প্রশাসনিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও নাশকতা মোকাবেলা করা হবে। এর আগে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এছাড়া দেশব্যাপী পেট্রোলবোমায় আহতদের সুচিকিৎসার ব্যাপারেও মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনা হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের লাগাতার অবরোধ-হরতালের মধ্যে চলমান নাশকতা বন্ধে একসঙ্গে তিনটি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। পাশাপাশি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে বিভিন্ন নীতি তৈরিতে পেশাগত ও কারিগরি পরামর্শ ও সহায়তা দিতে নতুন একটি অধিদফতর সৃষ্টির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ডাক ও টেলিযোগযোগ বিভাগের অধীনে টেলিযোগযোগ অধিদফতর সৃজনের প্রস্তাব’ অনুমোদন দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে টেলিযোগাযোগের বিভিন্ন নীতি তৈরিতে পেশাগত ও কারিগরি পরামর্শ ও সহায়তা দেবে এই অধিদফতর। টেলিযোগযোগ অধিদফতরের ২১টি কার্যপরিধি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত কোন অধিদফতর সৃজনের বিষয়ে মন্ত্রিসভার অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয় হওয়াতে এটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হয়। ১৯৭৯ সালের বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ এ্যান্ড টেলিফোন বোর্ড অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিটিটিবি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে ওই অধ্যাদেশে দুটি ধারা সংযোজন করে বিটিটিবিকে বিলুপ্ত করে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) নামে দুটি কোম্পানি গঠন করা হয়। এর ফলে বিটিটিবিতে কর্মরত বিসিএস টেলিকম ক্যাডার ও অন্যান্য পদে বাধ্যতামূলকভাবে প্রেষণে বিটিসিএল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এ নিয়োগ দেয়া হয়। বিসিএস টেলিকম ক্যাডাররা বাধ্যতামূলকভাবে প্রেষণে বিটিসিএলে নিয়োগে আপত্তি এবং অন্য ক্যাডারে যাওয়ার জন্য মামলা করে। এর ফলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। অধিদফতর সৃষ্টির এই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ সমস্যা সমাধানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে বললে তারা টেলিযোগাযোগ অধিদফতর সৃষ্টিসহ কয়েকটি সুপারিশ করে। বিসিএস টেলিকম ক্যাডারের পদগুলো টেলিযোগযোগ অধিদফতর গঠনের পর সেখানে ন্যস্ত হবে। টেলিযোগযোগ অধিদফতরের স্থায়ী পদ হবে ২৩৮টি এবং কিছুপদ পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বিভিন্ন পদে যারা রয়েছে তারা অবসরে গেলে তাদের পদ পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মোশাররাফ হোসাইন জানান। এ রকম পদ রয়েছে ৭ হাজার ৫৩৬টি। টেলিযোগযোগ অধিদফতরে ৮১টি প্রথম শ্রেণীর পদ থাকবে এবং এর প্রধান হবেন একজন মহাপরিচালক। এ অধিদফতর গঠন হওয়ার পর বিসিএস টেলিকম ক্যাডার ও অন্যান্য পদে নিয়োগ নিয়ে যে সমস্যা মামলা চলছে, তা সমাধান হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এছাড়া সরকারী কর্পোরেশন (ব্যবস্থাপনা-সমন্বয়) আইন, ২০১৫’র আবশ্যকতা আছে কিনা, তা জানতে ছয় মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছে মন্ত্রিসভা। সোমবার সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে আইনের খসড়া উপস্থাপন করা হয়। আইনের খসড়া উত্থাপন করা হলেও মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন না দিয়ে বর্তমানে আইনটির আবশ্যকতা আছে কিনা, তা পর্যালোচনা করতে ছয় মন্ত্রীকে বলেছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অধীন অনেক কর্পোরেশন রয়েছে। কর্পোরেশনগুলোর কাজের সমন্বয় ও সামঞ্জস্যতার জন্য ‘পাবলিক কর্পোরেশন ম্যানেজমেন্ট-কোঅর্ডিনেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬’ প্রণয়ন করা হয়। সামরিক শাসনামলের আইন পর্যালোচনা শেষে বাংলায় প্রণয়ন করে মন্ত্রিসভায় আনার বাধ্যবাধকতা থাকায় এটি মন্ত্রিসভায় আসে। আইনের আওতায় অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বিদ্যুত ও জ্বালানিমন্ত্রীকে নিয়ে একটি পরিষদও গঠন করা হয়েছিল। নতুন আইনে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রীকে এ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আইনটির উদ্দেশ্য ভাল হলেও, বাস্তবে এর প্রয়োগ হয়নি। আইনটি বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকর, এটা বলা যাবে না। অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে পরিষদের পাঁচ মন্ত্রী বসে পর্যালোচনা শেষে আইনটির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা নির্ধারণ করবে। ১৯৮৬ সালের দিকে কর্পোরেশনগুলো যতটা কার্যকর ছিল, এখন সে তুলনায় কার্যক্রম কমে গেছে। কারণ প্রাইভেট সেক্টর আগের তুলনায় অনেক প্রসার লাভ করেছে। এছাড়া কর্পোরেশনগুলোর জন্য আলাদা আলাদা আইন রয়েছে। নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এগুলো পরিচালিত হয়। সমন্বয়ের কথা বলা হলেও আইনটি সেভাবে কাজ করেনি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা আইন থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য আইনটি করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
×