ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শীতের আমেজ শেষ, বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

শীতের আমেজ শেষ, বাড়তে শুরু করেছে তাপমাত্রা

কাওসার রহমান ॥ মাঘ শেষ না হতেই বৈশাখের আঁচ। দিনের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। হঠাৎ করেই উধাও উত্তরের হাওয়া। কে বলবে, এই ক’দিন আগেই পরাক্রম দেখিয়েছে উত্তরের হাওয়া। তীব্র শীতে কাঁপনের পরে এখন দুপুরে রোদে মৃদু উষ্ণতার ছাপ। আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে উত্তর হাওয়ার দাপট। উত্তর-পশ্চিম ঘূর্ণাবর্তের কারণে সেখানে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। সেই মেঘই বাংলাদেশের আকাশকে মেঘলা করতে পারে। যার প্রভাবে গঙ্গা অববাহিকার জেলাগুলোতে হালকা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। দুপুরে গরম আর রাতে ঠা-া। এমন অদ্ভূত আবহাওয়ায় শরীর স্বাস্থ্যও বিপর্যস্ত। সামান্য অসাবধান হলেই ঠা-া লেগে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা শোচনীয়। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শীত একেবারে বিদায় না নিলেও আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনা চলবেই। যার প্রভাবে দিন ও রাতের তাপমাত্রার মধ্যে অনেকটা ফারাক দেখা দিচ্ছে। ঢাকার গত ৭ দিনের তাপমাত্রা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্রমেই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বাড়ছে। ৫ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৬.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ৩০ জানুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৩ ডিগ্রী এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৭.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মাঘের শুরুতেই শীত বিদায় নেবে কি না, এমন আশঙ্কা যখন ধীরে ধীরে চেপে বসছে, তখনই আকাশ পরিষ্কার হয়ে উত্তরে হাওয়ার রাস্তা খুলে দেয়। তখনই কাশ্মীর হয়ে উত্তর ভারতে নেমে আসে পশ্চিমী ঝঞ্ঝা। যা মেঘমুক্ত পরিম-ল পেয়ে বিনা বাধায় ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। এ সময়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা না বাড়লেও দ্রুত কমতে থাকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। পরদিন ৩১ জানুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৩.৫ ডিগ্রীতে থাকলেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রীতে নেমে আসে। তারপর দিন ১ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৩.৩ ডিগ্রীতে অবস্থান করলেও সবনিম্ন তাপমাত্রা ১২.৮ ডিগ্রীতে নেমে যায়। ঘন কুয়াশার দরুন সেখানে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেমন বাড়তে পারেনি, তেমন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দ্রুত নেমেছে। দুইয়ে মিলে ঘোর শীতের ঠকঠকানি শুরু হয়ে যায় উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। ঢাকাতেও তার কিছুটা রেশ এসে পড়ে। ২ ফেব্রুয়ারি আবার বাড়তে থাকে তাপমাত্রা। এদিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেমন বেড়ে ২৭.২ ডিগ্রীতে উঠে যায়, তেমনি সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পারদও উঠে ১৪.৮ ডিগ্রীতে। দিনের বেলায় ঝকঝকে রোদে দিনের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে। ৩ ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯.৪ ডিগ্রীতে উঠে গেলেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসে অবস্থান করে। অর্থ্যাৎ শুরু হয় দিনে গরম ও রাতে ঠা-া। দু’দিন এ অবস্থা চলার পর ৫ ফেব্রুয়ারি এসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯.২ ডিগ্রীতে অবস্থান করলেও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৬.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠে আসে। তবে পরের দু’দিন আবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কমে যায়। এ সময়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রীতে নেমে আসে। কিন্তু সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রীতে উঠে যায়। আগামী সাত দিনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৬ থেকে ১৯ ডিগ্রীতে এবং সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭ থেকে ২৯ ডিগ্রীর মধ্যে অবস্থান করবে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ক্রমেই কমে গিয়ে শীত বিদায় নেয়ার জানান দিচ্ছে। এতে দুপুরে রীতিমতো ঘাম ঝরানোর মতো অবস্থা, আর রাত হলেই ঠা-া হাওয়া বিরাজ করছে। চিকিৎসক মহলের মতে, এমন আবহাওয়ায় বেশিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়েছে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া। যার প্রভাবেই জ্বর ও সর্দি-কাশির প্রকোপ বাড়ছে। সঙ্গে শরীরজুড়ে ব্যথা। তবে এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বরং হঠাৎ করে ঠা-া যাতে না লাগে তার জন্য বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের গ্রামদেশে একটি প্রবাদ আছে, ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, পৌষ সংক্রান্তি শেষ হতে না হতেই পাততাড়ি গুটাতে শুরু করে শীত। আবার তার মাঝেই দুই-তিন দিনের জন্য হঠাৎ করে জেঁকে বসে উত্তরের হাওয়া। তাহলে কি শীতের চরিত্র বদলে যাচ্ছে? এ বছর যেমন সময়ের বেশ আগেই পা রেখেছে শীত। তেমনি গোটা পৌষ মাসে বার বার ছন্দপতন ঘটেছে শীতের। দু’এক দিন শীত পড়লেও তা দীর্ঘায়িত হয়নি। যে দু’এক দিন শীত পড়েছে তা বেশ ভালভাবেই জেঁকে বসেছে। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোকে কাঁপন ধরিয়ে জবুথবু করে দিয়েছে। আসলে তাপমাত্রার এই তারতম্যগুলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তবে মানুষ্যজনিত কীর্তিকলাপ কিছু সীমাবদ্ধ ও আঞ্চলিক পরিবেশের ওপর তারতম্য ঘটাতে পারে। গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের পরিবেশ বিরোধী নানা রকম ক্রিয়াকলাপের ফলে বায়ুম-লের নিচের স্তরে উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে তা প্রভাবিত করছে পৃথিবীর জলবায়ুকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বদলে যাচ্ছে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি, পরিমাণ এমন কি ‘ঋতুছন্দ’ও। গত ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে পৃথিবীর উষ্ণতা প্রতি দশকে প্রায় দশমিক ১৮ সেলসিয়াস হারে বাড়ছে। গলে যাচ্ছে হিমবাহ ও মেরু প্রদেশের বরফ। সমুদ্রতলের উচ্চতা ক্রমশ বেড়ে চলছে। যার প্রভাবে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠেছে আবহাওয়া। কখন দেরিতে ঢুকছে বর্ষা, আবার সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও থেকে যাচ্ছে শীত। বস্তুত, আবহাওয়ার বার্ষিক তারতম্য নির্ভর করছে ৬৪টি বার্ষিক নির্ণায়কের তারতম্যের মাধ্যমে। ফলে কোন বছর শীত খুব বেশি মাত্রায় আবির্ভূত হয়। আবার কোন বছর খুব কম মাত্রায় আসে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোতে যে প্রচ- তুষারপাত হচ্ছে তা এই নির্ণায়কগুলোর তারতম্যের কারণেই। এ কারণেই আমাদের পৃথিবী ২০১৪ সালের আগে এতো গরম দেখেনি জীবনে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর বছরভিত্তিক তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। সেই রেকর্ডই বলে দিচ্ছে, ২০১৪ ছিল উষ্ণতম বছর। এর আগে অবশ্য ২০১০-এ পৃথিবী জুড়ে প্রচ- গরম পড়েছিল। সেই রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছে ২০১৪। গত বছর পশ্চিম আমেরিকার আলাস্কা, আরিজোনা ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি। কোনও কোনও জায়গায় স্বাভাবিকের থেকে ১০-১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ায় তো শীতকালটাই প্রায় লোপাট হয়ে যায়। প্রবল গরমে জলকষ্ট দেখা দিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু আমেরিকার পূর্ব দিকের ছবিটা ছিল ঠিক তার উল্টো। হাড় কাঁপানো শীতে, হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রায় ঠকঠক করেছে নিউইয়র্ক, বস্টন, ওয়াশিংটন। আবহাওয়াবিদদের দাবি, পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের আবহাওয়ার এই বৈপরীত্যই বলে দিচ্ছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের থাবা থেকে এখনও রেহাই পায়নি এ মেদিনী। এগুলোই প্রমাণ করে, আবহাওয়ার মধ্যে বার্ষিক তারতম্য ঘটছে। যার অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। এই উষ্ণায়নের কারণেই সাগরতলের তাপমাত্রা বেড়ে গরমের দিনে অধিক গরম অনুভূত হচ্ছে। আবার এলনিনোর প্রভাবে বার্ষায় পরিমিত বর্ষা, এমন কি শীতে জলীয় বাষ্পের আধিক্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই অনুভূত হচ্ছে না শীত। অদূর ভবিষ্যতেও এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ নেই। ভবিষ্যতে আবহাওয়ার আরও তারতম্য ঘটবে- এমনটাই বলছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। বিজ্ঞানীর দাবি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই যে ধাঁচ, তা সহজে পাল্টাবে না। আর পাল্টাবেই বা কী করে? তাপমাত্রা বাড়ার প্রধান কারণ উষ্ণায়ন। সেই কারণটি যতক্ষণ থাকছে, তাপমাত্রা বেড়েই চলবে। অতএব, সাবধান বিপদ দরজায় কড়া নাড়ছে।
×