ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ভেন্যুতে শিশুতোষ বিড়ম্বনা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দুই ভেন্যুতে শিশুতোষ বিড়ম্বনা

মোরসালিন মিজান ॥ আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে বড়দের বইমেলা। বাস্তবে তা নয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা শিশু-কিশোরদেরও। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে এ মেলা সব সময় গুরুত্ব দিয়ে আসছে। জ্ঞানের অফুরন্ত ভা-ার বইয়ের সঙ্গে আগামী প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রচেষ্টার অন্ত নেই আয়োজক বাংলা একাডেমির। এর অংশ হিসেবে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রতি বছরই ব্যবস্থা করা হয় শিশু কর্নারের। তবে মেলা বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশে বিভক্ত হওয়ার পর থেকে দেখা দিয়েছে বিড়ম্বনা। বাংলা একাডেমি অংশে সাজানো শিশু কর্নারে প্রচুর শিশু এলেও, এখানে মানসম্পন্ন বই খুব একটা চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে, মেলার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মূল প্রকাশকরা শিশু-কিশোরদের উপযোগী অনেক বই করেও দেখা পাচ্ছে না ক্রেতার। এ অবস্থায় শিশু কর্নারটিও মেলার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান অংশে স্থানান্তরের দাবি উঠেছে। নজরুল মঞ্চের তিন দিকে অবস্থিত স্টলগুলো নিয়ে শিশু কর্নার। গত বছরের মতো এবারও শিশু কর্নারে শুধু শিশুদের বইয়ের প্রকাশকরা স্টল সাজিয়েছেন। শিশু কর্নার বিশেষ ব্যবস্থা হওয়ায় সরাসরি এখানেই আসছে শিশুরা। অভিভাবকরা হাত ধরে নিয়ে আসছেন। শুক্র ও শনিবার শিশুপ্রহর চলাকালীন সময় দেখা গেছে এমন দৃশ্য। প্রচুর শিশু এলাকাটি ঘুরে বেড়িয়েছে। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত ছিল শিশু কর্নার। কিন্তু কেনার জন্য বই পছন্দ করতে গিয়ে হতাশই হয়েছেন বাবা-মায়েরা। এখানে কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই মানের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও, অধিকাংশই অখ্যাত লেখকদের যাচ্ছেতাই রকমের ভূতের গল্প, আর যেন-তেন শিল্পীর আঁকা কার্টুন দিয়ে পাতা ভরে রেখেছে। বিভিন্ন স্টলে হরেক রকমরে রংচঙে বই। ঘুরে ফিরেই কার্টুন। রবিবার একটি বেসরকারী স্কুলের শিক্ষিকা আইরিন আহমেদ এখানে এসেছিলেন তাঁর সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে। স্টলগুলো সময় নিয়েই ঘোরেন তিনি। তারপর জনকণ্ঠকে বলেন, এসব বই থেকে বাচ্চারা শেখার কিছু পাবে না। একটু তো সৃজনশীল হতে হবে। এখানকার প্রকাশনাগুলোর মাঝে সেই সৃজনশীলতা, চিন্তাশীলতার অভাব আছে। প্রকাশকরা অবশ্য অভিযোগ স্বীকার করতে নারাজ। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শিশু কর্নারের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঝিঙেফুল’র প্রকাশক গিয়াসউদ্দীন বলেন, শিশুদের বই আমরা যতœ নিয়েই করি। তবে কারও কারও জন্য মান নষ্ট হয়। তাঁদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অন্য এক প্রকাশক বলেন, এজন্য শিশু কর্নার সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এটি হলে বড়দের বইয়ের মাঝে ছোটদের বইগুলো হারিয়ে যাবে। তবে এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের মূল প্রকাশকরা। তাঁরা শিশু কর্নার চান সোহ্রাওয়ার্দীতেই। গত কয়েকদিন এ অংশটি ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি নামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়েছে শিশু-কিশোর উপযোগী বই। অনেকেই স্টলের অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে সেসব বই সাজানো। কিন্তু ক্ষুদে পাঠকদের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। শিশু-কিশোরদের উপযোগী বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ রয়েছে ‘তাম্রলিপি’র। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে খ্যাতিমান লেখকদের শিশুতোষ রচনা নিয়মিত বের হচ্ছে। কিন্তু রবিবার বিকেলে লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করেও কোন বাচ্চার আসা-যাওয়া দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকাশক এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি বলেন, আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জন্য অনেক বই করি। যতœ করে করি। দেশের নামী লেখকদের বই দেখিয়ে তিনি বলেন, কিন্তু যেহেতু শিশুদের জন্য একটি আলাদা কর্নার আছে সেহেতু বাবা-মায়েরা সেদিকে চলে যান। এদিকে আসাই হয় না। এর ফলে আমরা খুব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। উৎস প্রকাশনের মোস্তফা সেলিম বলেন, আমরা বড়দের বইয়ের মতো ছোটদের বইও অনেক পরিকল্পনা করে বের করি। কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না। বাবা-মায়েরা সন্তানদের নিয়ে শিশু কর্নারে চলে যাচ্ছে। সেখান থেকে ভাল বই পেলে কিনছে। না পেলে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। এভাবে চললে ভাল প্রকাশকরা ছোটদের বই করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে না বলেও মত দেন তিনি। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে মেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, এটি আমাদের জন্য নতুন সমস্যা। আমরা এ নিয়ে ভাবছি। আগামীতে সবার পরামর্শ নিয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। ১৩০ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার অষ্টম দিনে নতুন বই এসেছে ১৩০টি। মেলার প্রথম সপ্তাহে গতকাল পর্যন্ত (১Ñ৭ ফেব্রুয়ারি) বাংলা একাডেমির নিজস্ব স্টলে বিক্রি হয়েছে ২২,৬১,০৩৬ টাকা। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বিকেলে গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জন্মশতবর্ষ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক এবং অধ্যাপক নিসার হোসেন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। প্রাবন্ধিক বলেন, জয়নুল আবেদিন ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্ময়কর শিল্প-প্রতিভা, এ সত্য উন্মোচিত হয়েছিল তাঁর বয়স যখন ২৯, তাঁর আঁকা ১৯৪৩-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার মাধ্যমে। অবশ্য তাঁর কিছু আগে থেকেই তিনি একজন প্রতিভাবান দক্ষ চিত্রশিল্পী হিসেবে সর্বভারতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন, তবে সেগুলো ছিল প্রায় প্রথাসিদ্ধ বাস্তববাদী নিসর্গ দৃশ্য রচনার জন্য। দুর্ভিক্ষ চিত্রমালা জয়নুলকে একেবারে ভিন্ন মাত্রায় পরিচিত করায়। ব্রিটিশ ভারতের ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় তাঁর ছবির আঙ্গিক ও বক্তব্য ছিল রীতিমতো বিপ্লবাত্মক। পরবর্তী রাজনৈতিক পালাবদল, বিশেষ করে দেশভাগ ও পাকিস্তান নামক এক নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও বদলে দেয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাঙালীর জন্য আধুনিক শিল্পকলার জগত প্রতিষ্ঠার। তাঁর প্রতিভা, শ্রম ও সাংগঠনিক মেধা এ স্বপ্ন পূরণে ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পচর্চার জনক। আলোচকরা বলেন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন একজন বিরল শিল্পীমানুষ। তাঁকে শুধু দুর্ভিক্ষের ছবির চিত্রকর হিসেবে মূল্যায়ন করলে খ-িতভাবে দেখা হবে। জন্মশতবর্ষে শিল্পানুরাগী মানুষসহ সাধারণ মানুষের বিপুল ভালবাসা জয়নুল আবেদিনের সর্বত্রগামী শিল্পপ্রতিভার প্রমাণবহ। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর বলেন, জয়নুল আবেদিন ছিলেন একজন বড় মাপের শিল্পী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ছবি আঁকার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। তিনি তাঁর ছবির মাধ্যমে গণলগ্ন নন্দনের জন্ম দিয়েছেন। তাঁর ছবির বিষয়বস্তু নিম্নবর্গের মানুষকে শিল্প-ক্ষমতাকেন্দ্রের মুখ্য আসনে বসায়। এ মহান শিল্পীর শিল্পকাজ নিয়ে নতুন দৃষ্টিতে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাজেদ ফাতেমীর পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নকশি কাঁথা’র পরিবেশনা। সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী দিল আফরোজ রেবা, চন্দনা মজুমদার, আবু বকর সিদ্দিক, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, অনিমা মুক্তি গোমেজ, মোঃ নূরুল ইসলাম, এনামুল হক এবং শাহ আলম। আজকের অনুষ্ঠান ॥ আজ সোমবার গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে প্যারীচাঁদ মিত্রের দ্বিশততম জন্মশতবর্ষ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন মোরশেদ শফিউল হাসান এবং মোহাম্মদ আজম। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক খোন্দকার সিরাজুল হক।
×