ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গাইবান্ধায় পেট্রোলবোমা;###;নিজের কষ্ট ভুলে ব্যস্ত দগ্ধ মেয়ের সেবায়

তারা মিয়া জানেন না তাঁর স্ত্রী-সন্তান বেঁচে নেই

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তারা মিয়া জানেন না তাঁর স্ত্রী-সন্তান বেঁচে নেই

মানিক সরকার মানিক, রংপুর থেকে ॥ গাইবান্ধায় পেট্রোলবোমায় চোখ-মুখ আর পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বি-১২ বিছানায় শুয়ে মৃত্যু যাতনায় দাপাদাপি করছিল সুন্দরগঞ্জ থানার তারা মিয়ার শিশুপুত্র সুজন (১৩)। চিকিৎসকদের অনুমান- কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে সে। এ সময়টায় সাধারণত মানুষের মুখে মা-মা রা উচ্চারিত হলেও তার বেলায় তাও হচ্ছিল না। মাতৃ¯েœহ কিংবা স্বজনের শুশ্রƒষা কিছুই মিলছিল না তার। অথচ পাশের আরেক রুমেই ৭ নম্বর বেডে একই যাতনায় কাতরাচ্ছিলেন পরম মমতাময়ী মা আর অবজারভেশন কক্ষে কাতরাচ্ছিলেন ছোট বোন তানজিলাকে নিয়ে জন্মদাতা পিতা তারা মিয়া (৩২)। অথচ এদের কেউই তখনও জানতেন না একে অপরের প্রকৃত অবস্থা কী, কিংবা কে কোথায়? পরে অবশ্য পিতা তারা মিয়াকে জানানো হয় তার স্ত্রী আর ছেলে পাশের রুমেই আছে। কিন্তু কিছু সময় পরেই পরম ¯েœহের ধন সন্তান সুজন মারা গেলে তাকে আর জানানো হয়নি সেটি। আর এরপর বিকেল সাড়ে ৩টায় স্ত্রী সোনাবানুও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে সে খবরও জানানো হয়নি তাকে। নিজের শরীরের পোড়া যাতনা ভুলে তিনি ব্যস্ত তার ছোট মেয়ের যাতনার সামাল দেয়া নিয়ে। দৃশ্যগুলো শুক্রবার রাতে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের। এ যেন এক চরম মর্মস্পর্শী বেদনাবিধুর দৃশ্য, যা কেবল চোখে দেখলেই বিশ্বাস করা যায়। নইলে স্বপ্নই মনে হবে তা। গাইবান্ধার তুলশীঘাটে বোমায় দগ্ধ হওয়া তারা মিয়ার গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার পাঁচপীর গ্রামে। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সেখানেই যাপিত করেন জীবন। সম্প্রতি অবরোধ শুরুর কয়েক দিন আগে বড় মেয়েকে ঢাকায় রেখে অন্যদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন তিনি। কিন্তু হরতাল আর অবরোধের কারণে যেতে পারেননি। বাধ্য হয়েই থেকে যান এতদিন। কিন্তু এখানে থেকে যাওয়ায় সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে তাঁর। ঢাকার আয় আর সুন্দরগঞ্জের আয় দিয়ে তাাঁর সংসার চলে না। সম্প্রতি কিছু যান চলাচল শুরু হওয়ায় জীবনের ঝুঁকি হলেও বেছে নেন শুক্রবারের দিনটি। তারা মিয়া জানান, ‘এত্তি সংসার চালাবার না পারি শুকুরবারের দিনটাক ভাল মনে করি বাছি নিনু, কিন্তু কায় জানে ওই কুত্তার ঘর মোর সংসারটাক এমন তছনছ করি দিবে?’ তারা মিয়া তখনও (শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টা) জানেন না তার ¯েœহের ধন সুজন আর পরম আপনজন সুখ দুঃখের সঙ্গী স্ত্রী সোনাবানুও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ছোট মেয়ে তানজিলার (৫) দুই পা আর দুই হাত আগুনে পুড়ে গেছে। নিজেরও পুড়েছে মাথা, ঘাড় আর পায়ের কিছু অংশ। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিজের যাতনা ভুলে মেয়ের যাতনা মেটাতে খুব কাছে থাকা স্ত্রী আর সন্তান সুজনেরও তেমন খোঁজ নিতে পারছেন না তিনি। তবে আশপাশের সবার দেয়া মিথ্যা আশ্বাসে তিনি জানেন, তাঁর স্ত্রী-সন্তান এখন অনেকটাই ভাল আছে। শুধুই যে পরিবারের এ চারজনকে নিয়েই তাঁর এই কষ্ট, ব্যথা তা নয়, তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলে আশরাফুলও ছিল শুক্রবারের সেই গাড়িতে। কিন্তু তার খোঁজও তিনি এখনও জানেন না। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও আসেনি তার ভাতিজা। এ কারণে তাঁর ধারণা হয়ত ভালই আছে সে। তারা মিয়া জানান, তাঁর মোবাইল ফোনটা হারিয়ে গেছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গেও কেউ যোগাযোগ করছেন না। টাকা-পয়সাও সঙ্গে নেই। কিছু কিনে খাবেন কিংবা দুগ্ধপোষ্য মেয়েকে খাওয়াবেন সে সঙ্গতিও নেই তাঁর। নির্মম এই দৃশ্যগুলোই বলে দেয় কতটাই বিভৎসতায় মেতে ওঠা এই শকুন-শকুনীর দল।
×