ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রিস ॥ স্পার্টানরা কি জেগেছে আবার

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

গ্রিস ॥ স্পার্টানরা কি জেগেছে আবার

২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গ্রিসে নির্বাচন হয়ে গেল, সিরিজা নামক পার্টি জেতে, বিপুল ভোটে। আর দুটো চেয়ার পেলে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হতো, তিন শ’টি চেয়ারের মধ্যে ১৪৯টি পেয়েছে। সিরিজার এ বিজয় ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) তুলকালাম সৃষ্টি করেছে। ঘটানোর মূল কারণ দুটো- ১) আর তপশ্চর্যা কৃচ্ছ্রব্রত নয় সমৃদ্ধি চাই; ২) ইইউর ঢালাও কট্টর রুশ নীতি সমর্থন করি না। নবযুগের গ্রীক-উপাখ্যান বোঝার জন্য কয়েক বছর আগের ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়। ২০০৭-২০০৮ সালে আটলান্টিকের ওপর পারে সাব-প্রাইম মর্টগেজ যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সূচনা করে সেই ঝাপ্টায় আটলান্টিকের এ পারে ইউরো জোনের যে কয়টি দেশ ধরাশায়ী হয়, গ্রীসের অবস্থা হয় সবচেয়ে খারাপ। গ্রীস হঠাৎ দেখে যে সময়মতো সভরিন ঋণ (সরকার দেশী ও বিদেশী মুদ্রায় বন্ড ইস্যু করে ঋণ করে এবং বন্ডধারী বা ঋণদাতার কাছে ঋণী থাকে) শোধের অর্থ নেই। তার সভরিন ঋণের মহাজনদের অধিকাংশই আবার বিদেশী ব্যাংক। মহাজনরা দাবি ছাড়বে কেন? তাই আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) এবং ইইউÑ এই তিনের সৃষ্ট ‘ত্রয়কা’ বেল-আউটে এগিয়ে আসে, কয়েক দফায় কয়েক বিলিয়ন ইউরো দেয়া হয় গ্রীসকে, সঙ্গে থাকে ‘কৃচ্ছ্রব্রত নামক সর্বজনীন প্রতিষেধক’-এর ম্যানুয়েল। ম্যানুয়েল মতো চললে ২০২০ সাল নাগাদ গ্রীসের সভরিন ঋণের পরিমাণ কমে জিডিপির (জিডিপি=নির্দিষ্ট সময়ে দেশের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মুদ্রামান) ১২০ শতাংশে দাঁড়াবে অথচ ইত্যবসরে মহাজনরা পাওনার প্রায় ৫০ শতাংশ মাফও করে দেয়। এই হিসেবে, গ্রীস আসলে ‘কিছু টাকা বেশিই পায়।’ কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে ইইউর ইউরো জোনভুক্ত একটি দেশের দশ বছরের মেয়াদেও ঋণ নামক শাপমুক্তি হচ্ছে না। সিরিজার আগ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা ম্যানুয়েল মতো হোমওয়ার্ক করেছে। ফলাফল- কর্মস্থলে পাইকারি ছাঁটাই (সরকারী হিসেবেই প্রায় পঁচিশ শতাংশ), চাকরিহীন তরুণ প্রজন্ম, পেনশনের পরিমাণ হ্রাস করা, মানুষের টাকা-পয়সা নেই বলে অচলপ্রায় দৈনন্দিন কেনাবেচা, গৃহহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি, আত্মহত্যার উর্ধগামিতা, অভিবাসীবিরোধী আল্ট্রা দক্ষিণপন্থীর উত্থান ও প্রসার, সরকারী পরিসম্পদের বল্গাহীন ব্যক্তি-মালিকানাধীকরণ ইত্যাদি। ব্রাসেলসের প্রতিশ্রুত সমৃদ্ধির বদলে হতশ্রীর অতলে তলিয়ে যেতে থাকে গ্রীকরা। গ্রীস প্রায় তৃতীয় বিশ্বভুক্ত দেশের তালিকায় চলে আসে। গ্রীসের নতুন প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসের কাঁধে বর্তমানে ৩১৭ বিলিয়ন ইউরোরও বেশি ঋণ, জিডিপির হিসাবে ১৭৫ শতাংশেরও বেশি, ইইউর রেকর্ড একটি। অর্থাৎ মাথাপিছু হিসেবে প্রতিজন গ্রীক বর্তমানে চৌত্রিশ হাজার ইউরোর ঋণে ঋণী, অথচ গড় আয়ের পরিমাণ মাত্র বারো শ’ ইউরো। সিপ্রাস বা অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাউফাকিস কেউই অবশ্য ঋণ পরিশোধ করবে না বা মওকুফ করে দেয়া হোক এ কথা বলেনি। সিরিজা সোজা বলে দিয়েছে যে ঋণ আমরা শোধ করব অবশ্যই, তবে কেবলমাত্র রক্ত জল করা তপশ্চর্যা, কৃচ্ছ্রব্রত করে নয়, সঙ্গে থাকতে হবে প্রবৃদ্ধি-প্রক্রিয়ার এজেন্ডা। ধারকর্জের শোধ হবে ঋণ করে নয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে শোধ করা হবে ঋণ (নতুন গ্রীক সরকারের প্রস্তাবিত ঋণ পরিশোধের ফর্মুলাটি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকও প্রয়োগ করে দেখতে পারে)। কাজেই ত্রয়কার পরিদর্শকদের সঙ্গে দেন-দরবারে নেই আমরা। আমরা আইএমএফ, ইসিবি এবং ইইউর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। নতুন সরকারের এই পুনরালোচনার দাবি এথেন্স ও ব্রাসেলসের মধ্যে বেশ টানটানভাব সৃষ্টি করেছে। করবে নাইবা কেন? আয়ারল্যান্ডসহ ইইউর দক্ষিণাংশের তপশ্চর্যা, কৃচ্ছ্রব্রতে হিমশিম খাওয়া দেশগুলোও (পর্তুগাল, ইতালি, স্পেন) ঋণের মহাচাপে টিকে থাকার খড়কুটো খুঁজছে। গ্রীকদের মতো সাহস ও মনোবল নেই, তদুপরি মিডিয়া, যেমন বার্লিন মিডিয়া, দুর্ভাগ্যের সবটুকু দোষ ঋণগ্রস্তদের ঘাড়ে চাপিয়ে রেখেছে। ঋণগ্রস্ত দেশগুলো এখন গ্রীসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, গ্রীস তাদের উচ্চাকাক্সক্ষাহীনতার মোড়ক ঝেড়ে ফেলার আলো দেখাচ্ছে। জোরেশোরেই বলছে, ‘ওরা (জনগণ) যদি গ্রীসে পারে, আমরাও পারব।’ একই সঙ্গে গ্রীস ঘোষণা করেছে যে ইউরো জোনে থাকবে তারা। তপশ্চর্যা ব্রতের প্রধান স্থপতি মেরকেল, সঙ্গে ছিলেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট সারকোজি। ঋণ সমস্যার সমাধানে সিপ্রাস তপশ্চর্যাকে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সোয়াপ করার ফর্মুলা দিচ্ছেন! এ্যাঙ্গেলা মেরকেল হয়ত এটিকে পরাজয় হিসেবে নিচ্ছেন। কারণ, সিপ্রাসকে ঘিরে মেরকেল তথা জার্মানির মধ্যে কেমন অস্বস্তিভাব ও নমনীয়তার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সিপ্রাস তাই প্রথমে ইতালি ও ফ্রান্সের নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে মিটিং করার পরে যাবেন মেরকেলের সঙ্গে দেখা করতে। ইইউ বর্তমানে শাঁখের করাতের অবস্থায় রয়েছে, গ্রীসের দাবি মেনে নিলে, বাকি ঋণগ্রস্তরাও গ্রিসীয় ব্যবস্থা চাইবে। এবারে দ্বিতীয় কারণে আসা যাক। ২৪ জানুয়ারি ‘মারিয়ুপল’ নামক পূর্ব ইউক্রেনের (এন্টি-কিয়েভ বিদ্রোহীদের অংশ) শহরটিতে রকেট আক্রমণে ত্রিশজন মারা যায়। ২৭ জানুয়ারির সকালবেলা ইইউ তাড়াহুড়ো একটি বিবৃতি প্রকাশ করে যে, ইইউর আটাশজন লিডারই (সদস্য দেশ ২৮টি) একমত যেÑ মারিয়ুপলের রকেট আক্রমণে ত্রিশজনের মৃত্যুজনিত ‘দায়দায়িত্ব’ রুশদের। বিবৃতিটি দেখামাত্রই নতুন গ্রীক প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাস সেই দিনই সঙ্গে সঙ্গে প্রেস রিলিজে সোজা বলেন যে, ‘উপরোক্ত বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়, সদস্য দেশগুলোর সম্মতি নেয়ার যে বিধিবদ্ধ কার্যপ্রণালী রয়েছে সেটি পালন না করেই, বিশেষভাবে গ্রীসের নিশ্চিত সম্মতি ব্যতিরেকেই। এ প্রসঙ্গে জোর দিয়ে বলছি যে বিবৃতিটিতে গ্রীসের সম্মতি নেই।’ তাছাড়াও সিপ্রাস ইইউর বৈদেশিক নীতিবিষয়ক প্রধান ফেডারিকা মগেরিনিকেও ফোন করে উষ্মা প্রকাশ করেন। ইইউ অবজারভার ওয়েবসাইটে এক কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, মারিয়ুপলের হত্যাকা-ের জন্য রুশদের দোষারোপ করার লাইনটি তুলে দেয়ার চেষ্টা করেছিল গ্রীস, সঙ্গে অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়াও ছিল, সফল হয়নি। ইইউর ইতিহাসে প্রকাশ্যে এমন পরিস্থিতির দৃষ্টান্ত, যাকে ‘রিট্রো এ্যাকটিভ এ্যাবজুরেশন’ বলা যায়, এই প্রথম এবং গ্রীস তার মাধ্যম। সৃষ্ট এ পরিস্থিতির আসল তাৎপর্য হলো যে ইইউর বিন্যাস থেকে ‘দলচ্যুত’ হওয়া খুবই কঠিন, গ্রীস ‘দলচ্যুত’ হয়ে এই বিন্যাসে আলোড়ন তুলল। ইইউর কোন প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত অপ্রত্যয়জনক, বাস্তবহীন মনে হলে সেটিকে ‘না’ বলার সাহস কি অনুপ্রেরণা যোগানোর কাজ করবে হয়ত। যেমন- হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, স্লোভাকিয়া, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া ইত্যাদি কম প্রভাবশালী সদস্যদের দলচ্যুতির দ্বিধামুক্ত হওয়া সহজ হবে। এমনকি ইউক্রেন-সঙ্কট প্রশ্নে ব্রাসেলসের অবস্থানেও পরির্বতন আনবে- বলা যায়। আসলে গ্রীস ইইউর জং ধরে যাওয়া মান্ধাতা আমলের প্রশাসনে যে ‘সুনামির তরঙ্গ’ নিয়ে এসেছে, বহু দিনের বকেয়া সংস্কারকে অবশেষে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করবে। [email protected]
×