ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দেশের মানুষ দুর্বল সরকার দেখতে চায় না

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

দেশের মানুষ দুর্বল সরকার দেখতে চায় না

বাংলাদেশে বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্ট সন্ত্রাসের ভয়াবহ মাত্রা দেখে আমার অনেক দেশী ও বিদেশী বন্ধু ফোন করে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, সরকারের বিএনপি-জামায়াত তোষণনীতি দেশকে আজ এক ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাঁরা আরও মনে করেন, সরকারের এই বিএনপি-জামায়াত তোষণকে তাদের লালিত নেতৃবৃন্দ ও দুর্বৃত্তরা সরকারের দুর্বলতা হিসেবে ধরে নিয়েছে এবং যতই দিন যাচ্ছে তাদের হিংস্রতার রূপ ও ধরন পাল্টে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তাঁরা ছাত্রলীগ নামক কিছু দুর্বৃত্তের ব্যাপারেও তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, যেখানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এসএসসি পরীক্ষার দিন পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে, সেখানে ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত টেন্ডারবাজিতে ব্যস্ত থেকে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিতে ব্যস্ত রয়েছে। এ সবের কোন বিষয়েই আমার বন্ধুদের সঙ্গে দ্বিমত করার কোন সুযোগ নেই। বেগম জিয়া আহূত আন্দোলনের নামে দেশব্যাপী যে জীবনহরণকারী সন্ত্রাসী কর্মকা- গত ৫ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল, তা শুক্রবার ৩২তম দিন পার করেছে। এই ৩২ দিনে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের, যাদের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। এই নৃশংসতার সর্বশেষ ভয়াবহ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছে গত শুক্রবার রাতে গাইবান্ধায়, যখন দুর্বৃত্তরা একটি চলন্ত বাসে পেট্রোলবোমা মেরে শিশুসহ ৬ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে; আর মারাত্মকভাবে জখম করে ৩৫ জনকে। একই রাতে বরিশালে ট্রাকচালকসহ পেট্রোলবোমায় নিহত হয়েছেন তিনজন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউ, ভারতসহ অনেক দেশ ও সংগঠন এ সব হত্যাকা-ের নিন্দা জানালেও দেশের সুশীল সমাজের অনেক সদস্য, মিডিয়া আর মানবাধিকার সংগঠন এ সব নৃশংসতাকে কোন প্রকারের নিন্দা জানানো দূরে থাক তারা বরং এই নৃশংসতাকে বলে রাজনৈতিক আন্দোলন; আর তা বন্ধ হতে পারে একমাত্র দুই নেত্রীর সংলাপের মাধ্যমে। ‘অধিকার’ নামক একটি মানবাধিকার সংগঠন গুনে বলে দেয় বাংলাদেশে প্রতি দুই দিনে একজন নিরপরাধ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয় কিন্তু জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা কতজন মানুষকে পেট্রোলবোমা মেরে হত্যা করল তার হিসাব দেয়ার তারা প্রয়োজন মনে করে না। যারা সংলাপ সংলাপ বলে প্রতিদিন চিৎকার করেন তাঁরা এটি উপলব্ধি করেন না, কোন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে তো সংলাপ হতে পারে না। এ যাবত কোথাও কখনও হয়নি। তাই যদি হতো তা হলে আইএস, বোকো হারাম, আল কায়েদা, তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়েবার মতো জঙ্গীদের সঙ্গে তো সকলকে নিয়মিত সংলাপ করতে হতো। এই জঙ্গীদের দমন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা করে, বিমান হতে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে আর জর্দানের একজন পাইলটকে যখন আইএস পুড়িয়ে হত্যা করে জর্দানের বাদশা আবদুল্লাহ দুই ঘণ্টার মধ্যে হুকুম দেয় আইএসের মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত দুইজন সন্ত্রাসীর মৃত্যুদ- কার্যকর করতে, যাদের একজন আবার মহিলা ছিল। তখন কিন্তু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একেবারে চুপচাপ। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইট্স ওয়াচও কিন্তু তখন নীরব দশর্কের ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের বেলায় শুধু তাদের যত লম্ফঝম্প। পাকিস্তানের পেশওয়ারে জঙ্গীদের হাতে ১৪৫ জন স্কুলছাত্র নিহত হলে নওয়াজ শরীফ তাৎক্ষণিক হুকুম দেন, সকল মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত জঙ্গী কারাগারে আছে দ্রুততম সময়ে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করতে। প্রতিদিন কমপক্ষে দশজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে। আরও ৫০০ জন লাইনে আছে। সম্প্রতি নওয়াজ শরীফ দ্রুত সামরিক আদালতে জঙ্গীদের সাজা দেয়ার একটি ধারা সংবিধানে অন্তর্র্ভুক্ত করেছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নওয়াজ শরীফের চেয়ে রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী। তাঁর কাছে তো দেশের মানুষ জামায়াত-বিএনপির জঙ্গীদের ব্যাপারে আরও বেশি কঠোর অবস্থান আশা করতেই পারে। দেশের সাধারণ মানুষ এতই বিরক্ত যে এখন তাদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, পেট্রোলবোমা মারতে গিয়ে জামায়াত-শিবিরের যে সকল দুর্বৃত্ত জনতার হাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে, তাদের পুলিশের হাতে তুলে না দিয়ে যেন তাদেরও পেট্রোলের আগুনে পোড়ানো হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি সমর্থনযোগ্য পরামর্শ হতে পারে না; কিন্তু সাধারণ মানুষের ধৈর্যেরও তো একটা সীমা আছে। সেই সীমার বাঁধ ভেঙ্গে গেলে তখন অনেকের জন্যই তা বিপদের কারণ হতে পারে। পলাতক অবস্থান থেকে ভিডিও অথবা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টির সংস্কৃতিটা চালু করেছিল ভারতের নকশালরা। পরবর্তীকালে একই আদলে তা করা শুরু করে আল কায়েদার ওসামা বিন লাদেন। এগুলোর সবই আন্ডারগ্রাউন্ড দল। বাংলাদেশে এই অপকর্মটির অভিষেক ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহউদ্দিনের হাত ধরে। তখন তাকে বলা হতো বিএনপির বিন লাদেন। সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত আরেক যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ ভূমিকায় ছিলেন। তাঁকে আটক করার পর সালাহউদ্দিন আহমদ আবার এ কাজটি শুরু করেছেন। বেগম জিয়ার নামে আবার তাঁর দফতর কাম রেসিডেন্স হতে এখন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়াও শুরু হয়েছে। বিএনপি বর্তমানে অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড দলে পরিণত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন- সরকার কেন সকল অপশক্তি দমনের জন্য তাদের হাতে থাকা সব অস্ত্র ব্যবহার করছে না? যারা এ সব চরম দেশবিনাশী কর্মকা-গুলো করছে তাদের পেছনে তো কোন জনসম্পৃক্ততা নেই। সরকার ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের ধারা মনে করিয়ে দিয়েছে পেট্রোলবোমা ছুড়লে তার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। সাধারণ মানুষ এর প্রয়োগ দেখতে চায়। আন্দোলনের নামে জামায়াত-বিএনপি দেশে যে চরম সন্ত্রাসী কর্মকা- শুরু করেছে তা কঠোরহস্তে দমন না করলে মানুষ তাকে সরকারের দুর্বলতা বলে মনে করবে। বাস্তবে সরকার তো কোন অবস্থাতেই দুর্বল নয়। কয়েক দিন আগে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে কর্তব্যরত একজন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন। কোন মিডিয়াকে তা নিয়ে আহাজারি করতে শুনি না। কিন্তু যখন পেট্রোলবোমা ছুড়ে পালানোর সময় শিবির-ছাত্রদলের দুইজন দুর্বৃত্ত পুলিশের গুলিতে নিহত হলো তখন এক শ্রেণীর মিডিয়া রীতিমতো গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করল ওরা দুইজন শিবির আর ছাত্রদলের কর্মী ছিল না এবং তারা নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিল তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পুলিশকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে জনগণের জানমালের হেফাজত করার জন্য, তা দিয়ে একতারা বাজানোর জন্য নয়। তারা যদি কখনও মনে করে জনগণের জানমাল নিরাপত্তার হুমকির সম্মুখীন তাহলে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা তাদের আইনী দায়িত্ব। একইভাবে যাদের কাছে বৈধ অস্ত্র আছে তারা যদি তাদের সঙ্গে সেই অস্ত্র বহন করেন আর কখনও দেখে তাদের জীবন অথবা সম্পদ নিরাপত্তার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে তাহলে তা তিনি আইনগতভাবে ব্যবহার করতে পারেন। গাড়ি পোড়ানো আর পেট্রোলবোমা মারা অব্যাহত থাকলে বৈধ অস্ত্রধারীরা তাদের অস্ত্র নিয়ে রাস্তায় বের হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। জিমি কার্টার যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন একবার ইউনিয়নভুক্ত ট্রাক ড্রাইভাররা তাদের বেশকিছু দাবি-দাওয়া পূরণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হলো। ইউনিয়ন বহির্ভূত ট্রাক ড্রাইভাররা সিদ্ধান্ত নিল তারা তাদের ট্রাক চালাবে। শুরুতে তারা ধর্মঘটী ড্রাইভারদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা দাবি জানাল তাদের বৈধ অস্ত্র বহন করার সুযোগ দেয়া হোক। কার্টার এ প্রসঙ্গে একটি নির্বাহী আদেশ দিলেন এবং দেখা গেল ইউনিয়নবহির্ভূত ড্রাইভাররা তাদের পাশে একে-৪৭ রাইফেল রেখে দিব্যি ট্রাক চালাচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে ধর্মঘট প্রত্যাহার। সরকারকে কখনও কখনও জনস্বার্থে তার শক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শন করতে হয়। জঙ্গীদের হাত সরকারের হাত হতে লম্বা হতে পারে না। কোন কোন তামাদি রাজনীতিবিদ প্রায়শ বলে থাকেন- শেখ হাসিনা যদি শান্তিবাহিনীর সঙ্গে সংলাপ করতে পারেন তা হলে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে দোষ কোথায়? কথাটা ঠিক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে শান্তিবাহিনী একটি ঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গী সংগঠন ছিল এবং কোন সন্ত্রাসী কর্ম করলে তার দায়দায়িত্ব শিকার করত। বিএনপি যদি ঘোষণা দেয় তারাও শান্তিবাহিনীর অনুরূপ সংগঠন, তাহলে সরকার চাইলে তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে পারে। তারা বলুক তাদের এ সব চলমান সন্ত্রাসী কর্মকা- বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত করার জন্য। তা হলে তো অনেক সমস্যাই চুকে যায়। কিন্তু বিএনপি নেত্রী তো বলেন তাদের ‘আন্দালন’ শান্তিপূর্ণ! বিএনপি আর তাদের মিত্ররা বলছে তাদের এই ‘আন্দোলন’ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য। এগুলো স্রেফ ধাপ্পাবাজি। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য বেগম জিয়া আর তারেক রহমানকে জিয়া অর্ফানেজ ট্রাস্ট মামলা হতে বাঁচানো। আর জামায়াতের উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত তাদের বারোজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে মুক্ত করা। কোন এক জাদুমন্ত্র বলে যদি আজ বেগম জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বনে যান তা হলে তিনি পরদিন এই দুটি কাজই প্রথম করবেন। তাদের গণতন্ত্রের নমুনা দেশের মানুষ তাদের পূর্বের দুই মেয়াদে দেখেছে। জনগণের কাছে বড় প্রশ্ন সরকার এখনও কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না? অনেকের মতে বিএনপি বর্তমানে জামায়াতের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের দলকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে হয়ত এক সময় এ দলটিও একটি নিষিদ্ধ সংগঠনে রূপান্তরিত হবে। সব শেষে সরকারের কাছে একমাত্র দাবি যে কোন মূল্যে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করুন। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভর জয় অবশ্যম্ভাবী। সরকারকে বুঝতে হবে বিএনপি নিজেই নিজের সমাধি রচনা করেছে। এ জন্য মূলত মাতা-পুত্রই দায়ী। দলে বেশকিছু বিবেকবান মানুষ আছেন। অসৎ সঙ্গে তাঁদেরও সর্বনাশ হয়ে গেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
×