ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি ও জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে সহিংসতা বলেই চিহ্নিত করল বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো ;###;রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে সন্ত্রাস চলছে তার নিন্দা করল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য

আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ভারতের অবস্থান পরিষ্কার ॥ রাজনীতি নয় সন্ত্রাস

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ভারতের অবস্থান পরিষ্কার ॥ রাজনীতি নয় সন্ত্রাস

তৌহিদুর রহমান ॥ বিদেশী রাষ্ট্রগুলো বিএনপির চলমান আন্দোলনকে রাজনীতি নয়, সহিংসতা হিসেবেই অভিহিত করছে। তারা বলছে, এই ধরনের সহিংসতা কখনোই রাজনীতি হতে পারে না। সে কারণে বিএনপির আন্দোলনের পাশে নেই তারা। বিদেশী রাষ্ট্রগুলো আরও বলছে, সহিংসতা কখনোই রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। এছাড়া বর্তমান সরকারের প্রতিই সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো। বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দাও জানান হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত বিএনপির এই আন্দোলনকে সহিংসতা হিসেবেই চিহ্নিত করেছে। বর্তমান সরকারের এক বছরপূর্তিতে বিএনপির টানা হরতাল অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে পেট্রোলবোমার আঘাতে ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছেন প্রায় ৭০জন। আহত হয়েছেন আরও শত শত লোক। বাস-ট্রাকের পাশাপাশি ট্রেনেও হামলা চালানো হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষা বা বিশ্ব এজতেমার মতো বড় ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়ও অবরোধ ও হরতাল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না কেউ। এসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছে বিদেশী রাষ্ট্রগুলো। ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। এসব দেশ খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে সহিংসতা কখনোই রাজনীতির ভাষা হতে পারে না। আর এই ধরনের সহিংসতা সৃষ্টিকারী দলের প্রতি তাদের কোন ধরনের নৈতিক সমর্থনও নেই। বিএনপি জোটের টানা অবরোধে চলমান নাশকতা ও সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার নাক গলাবে না বলে স্পটভাবে জানিয়ে দিয়েছে। ভারত সরকারের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির বিষয়ে কোন ধরনের সিদ্ধান্তে যাওয়ার এখতিয়ার ভারত সরকারের নেই। আমরা শুধু এটাই চাই, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ ভাল থাকুক। আশা করতে পারি, তারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করবে। এদিকে বাংলাদেশ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র এম জে আকবর জানিয়েছেন, ভারত সেখানকার পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হোক তা চাইলেও কোন হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। আকবর বলেছেন, আমরা সব সময় চাই আমাদের দেশ ও প্রতিবেশী দেশে শান্তি থাকুক। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলেও সেখানে নাক গলানো বা হস্তক্ষেপ করাটা কিন্তু ভারতের নীতি নয়। সেটা ভারত কখনও করেনি, করবেও না। শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা তিব্বতের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিজেপি মুখপাত্রের এই বক্তব্য নিয়ে সংশয় থাকলেও বিজেপি নেতারা দাবি করছেন, বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা পুরোপুরি সত্যি কথা। কারণ, বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করে ভারত শেখ হাসিনার সমস্যা বাড়াতে চায় না। বাংলাদেশে চলমান প্রায় নজিরবিহীন প্রাণঘাতী নাশকতার মধ্যে মাসব্যাপী চলমান সঙ্কটে ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতৃত্ব শেখ হাসিনা সরকারের পাশে রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং বিবিসিকে বলেছেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থের প্রতি, আমাদের উদ্বেগের প্রতি দারুণ বিবেচনা দেখিয়েছেন। আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ভারত যে জাতীয় স্বার্থকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখতে গেলে শেখ হাসিনাই কিন্তু আমাদের একমাত্র অপশন। কারণ ভারত মনে করে তিনি বাংলাদেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের প্রধান। ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিএনপি জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচীতে পেট্রোলবোমা মেরে নিরীহ মানুষ হত্যার ঘটনাকে ‘জঘন্যতম কাজ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে দেশে চলমান অস্থিরতা ও সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট এ উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে চলমান নৃশংস সহিংসতার নিন্দা জানাচ্ছি। বাংলাদেশে বিদ্যমান অস্থিরতায় আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি। বাসে অগ্নিসংযোগ এবং পেট্রোলবোমা ছুড়ে মারা, রেল লাইনচ্যুত করার ঘটনায় সাধারণ নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন। কেউ কেউ পুড়ে আহত হচ্ছেন। আমরা এ ধরনের জঘন্যতম কাজকে নিন্দা জানাই এবং উদ্বেগ প্রকাশ করছি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এ ধরনের কাজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তীব্রভাবে নিন্দা জানাচ্ছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চালানো সহিংসতার ঘটনাকে অনৈতিক উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ন্যক্কারজনক এ ধরনের কাজের কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি বলেন, সব বাংলাদেশীই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতো প্রকাশের অধিকার রাখেন। এছাড়া আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও আহ্বান জানাচ্ছি যেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের তাৎপরতা চালানোর সুযোগ করে দেয়। সেই সঙ্গে সব দলের প্রতিও আমরা আহ্বান জানাই, তারা যেন তাদের নেতাকর্মীকে যে কোন ধরনের সহিংসতা চালানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সহিংসতার জন্য নিন্দা জানায়। দেশজুড়ে সহিংসতায় হতাহতের খবরে তারা গভীর শোক প্রকাশ করে ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে। এদিকে বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রাণহানিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য। একই সঙ্গে এসব সহিংসতার ঘটনার তদন্তও চেয়েছে দেশটি। যুক্তরাজ্য বলেছে, গত এক মাসের মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্ধশতাধিক প্রাণহানি, কয়েক শ’ লোকের বীভৎসভাবে আহত হওয়ার ঘটনায় তারা স্তম্ভিত। যুক্তরাজ্য বলেছে, সহিংসতার কারণে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কুমিল্লায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় আটজনের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে সকল পক্ষকে এ ধরনের সহিংসতা ঘটানো বা এতে উস্কানি দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। তারা উভয় পক্ষকে সহনশীলতার পরিচয় ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে এ সহিংসতা নিরসনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়াও চলমান সহিংসতার বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে নিন্দা জানায়। সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে জানানো হয়েছে, বিএনপি সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করলেই কেবল আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরো মায়াডোনকে একথা জানান। বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের দেয়া নৈশভোজে উপস্থিত হয়ে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি নয়, সন্ত্রাস করছে। সন্ত্রাসের কাছে গণতন্ত্র কখনোই পরাজিত হতে পারে না- উল্লেখ করে তারা বলেন, বাংলাদেশেও গণতন্ত্রই জয়ী হবে। সে সময় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম, আওয়ামী নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। আর বৈঠকে বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণ সহায়তা অব্যাহত রাখার বিষয়েও ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতরাও পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে জানা গেছে।
×