ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাফনের কাপড় পরে মোটর শ্রমিকদের বিক্ষোভ ॥ ছাত্র-শিক্ষকদের মৌনমিছিল, মানববন্ধন

খালেদার অফিসের সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খালেদার অফিসের সামনে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হরতাল-অবরোধের নামে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমা মেরে জ্বালাও-পোড়াও করে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির বিরুদ্ধে এবার ফুঁসে ওঠেছে দেশের ছাত্র, শিক্ষক ও অভিবাবকরা। হরতাল-অবরোধ বন্ধ করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে রাজপথে নেমে এসেছেন তারা। বৃহস্পতিবার হরতাল-অবরোধ বন্ধ করার দাবিতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে সাদা পতাকা হাতে মৌন মিছিল ও মানববন্ধন করেছে কয়েক হাজার ছাত্র-শিক্ষক। এ সময় শিক্ষাকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে খালেদা জিয়ার কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। এছাড়াও পুরো রাজধানীসহ দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজপথে অবস্থান নিয়ে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এদিকে মোটরশ্রমিকরা কাফনের কাপড় পরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ডাকে ৬ জানুয়ারি থেকে সারাদেশে অবরোধ চলছে। অবরোধের ফাঁকে ফাঁকে হরতালেরও ডাক দিচ্ছেন তিনি। আর এ কর্মসূচী চলাকালে প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশে গাড়িতে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, অগ্নিসংযোগ ও হাতবোমা বিস্ফোরণসহ নাশকতামূলক কর্মকা- চালিয়ে এ পর্যন্ত ৭৪ জন মানুষ হত্যা ও কয়েক হাজার গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকেই গুলশানের ৮৬ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর বাড়ির (খালেদা জিয়ার কার্যালয়) সামনে গিয়ে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এক পর্যায়ে সেখানে গিয়ে হাজির হন কয়েক হাজার ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবক। দুপুর ১২টায় শিক্ষা কার্যক্রম হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত রাখার দাবিতে সাদা পতাকা হাতে মৌন মিছিল ও মানববন্ধন শুরু করে তারা। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী তারা এ কর্মসূচী পালন করেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা যায় হরতাল-অবরোধ বন্ধের দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, যাতে বোমা মেরে মানুষ হত্যা বন্ধের দাবিসহ বিভিন্ন দাবি ছিল। এ সময় খালেদা জিয়ার কাছে একটি স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের গেটে সাদা পতাকা হাতে কিছুক্ষণ অবস্থান নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে দেখা করতে চান কারিগরি শিক্ষা শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ। কিন্তু খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক নাজিম উদ্দিনের কাছে স্মারকলিপিটি দিয়ে চলে আসেন তারা। মৌন মিছিল ও মানববন্ধন চলাকালে মোহাম্মদপুরের শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোঃ শরীফ বলেন, ২৬ জানুয়ারি তাদের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল। হরতাল-অবরোধে ওই পরীক্ষা পিছিয়ে ৮ ফেব্রয়ারি নেয়া হয়েছে। সেদিনও হবে কি-না জানি না। খালেদা জিয়াকে স্মারকলিপি দেয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার বলেন, আজ শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে যেতে পারছে না। বোমা মেরে, আগুন দিয়ে তাদের পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ অবস্থা কোনভাবে চলতে দেয়া যায় না। এ বিষয়টি জানাতে আমরা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে স্মারকলিপি দেয়ার সময় তার কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ন্যূনতম সৌজন্য দেখায়নি তারা। এটা নিচু মানসিকতার দৃষ্টান্ত। আমরা সহিংস পরিবেশ পরিহারের আহ্বান জানাতে এসেছি। হরতাল-অবরোধে আমরা শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। আন্দোলন হোক তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তা হতে হবে শান্তিপূর্ণ। শিক্ষাকে রাজনীতির উর্ধে রাখার আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়াকে স্মারকলিপি প্রদানকালে কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের অন্য নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেনÑ সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সহসভাপতি অধ্যক্ষ পিএম মনসুর হাসান, কেন্দ্রীয় নেতা ফরিদউদ্দিন আহমেদ, মোঃ শাহজাহান, মিজানুর রহমান তালুকদার, মোস্তফা চৌধুরী, হিরেন্দ্র নাথ মৃধা, শাহীন আক্তার, শামীম কায়সার, মোঃ এনামুল হক, কিবরিয়া পারভীন, আফরোজ খান, সুশীল চৌধুরী, রেজানুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, আতিকুর রহমান প্রমুখ। এদিকে বেলা সোয়া ১টার দিকে ‘সর্বস্তরের নিরীহ গাড়িচালক’ ব্যানারে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের দাবিতে কাফনের কাপড় পরে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নেন বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। এদের মধ্যে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া গাড়ি চালকদের আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন। এ সময় একদল গাড়িচালক একটি ভ্যানে করে হরতালে পেট্রোলবোমায় পুড়ে যাওয়া একটি গাড়ি নিয়ে আসেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ের সামনে। তাদের কাছে থাকা একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘আমরা গাড়িচালক একই মায়ের পুত, দেখতে চাই না আর পোড়ামুখ’, ‘আমরা শান্তির দূত’। গাড়িচালকরা খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানান। তার কার্যালয়ের কাছে ৮৬নং সড়কে অবস্থান নিয়ে হরতাল-অবরোধে ও নাশকতার প্রতিবাদে নানা সেøাাগান দেন। এ সময় শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান ওই এলাকার সাংসদ (ঢাকা-১৭) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তিনি অবিলম্বে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনুন। আর তা যদি না করেন তাহলে আপনি শপথ ভঙ্গ করবেন। খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সন্ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ করে শান্তির পথে আসতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও ও ভাংচুর করে আন্দোলন হয় না। গাড়িচালক ইমদাদুল, বাবুল ও আশরাফ সমস্বরে বলেন, আমরা মোটরগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। পেট্রোলবোমা মেরে আমাদের শেষ করে দেয়া হচ্ছে। আমরা নিরাপত্তা চাই। আমরা পুড়ে মরলে পরিবারের সদস্যরা না খেয়ে মরবে। তাই হরতাল-অবরোধ বন্ধ করতে খালেদা জিয়াকে জানাতে এসেছি। মীরসরাইয়ে মহাসড়কে পরীক্ষার্থীদের মানববন্ধন ॥ চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার করেরহাট বাজারের মহাসড়কে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করে এসএসসি পরীক্ষার পরিবেশ করে দেয়ার দাবিতে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি বিদ্যালয়ের সহস্রাধিক এসএসসি পরীক্ষার্থী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার উপজেলার করেরহাটে ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করে পরীক্ষার্থী ছাড়াও ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী। মানববন্ধনে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা তাদের বক্তব্যে হরতাল-অবরোধ দিয়ে তাদের ভবিষ্যত নষ্ট না করতে ও নির্বিঘেœ পরীক্ষা দানের সুযোগ করে দিতে অবরোধকারী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবি জানান। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, বার বার পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় পরীক্ষা প্রস্তুতিতেও ব্যাঘাত ঘটছে। এতে ফলাফলও বিপর্যয় ঘটতে পারে আমাদের। এসএসসি পরীক্ষার্থী আরিফুল হক ও করেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী বিপাসা রানী পাল বলে, আমরা এমন খুন, রাহাজানি, নৈরাজ্য চাই না। আমরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীদের এ মানবিক উদ্যোগের অংশ নেয় করেরহাটের ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনতা। এ সময় মানববন্ধন শেষে আরও অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন করেরহাট কেএম উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সাখাওয়াত উল্লাহ রিপন, জয়পুর পূর্বজোয়ার উচ্চ বিদ্যালয় ও করেরহাট গনিয়াতুল উলুম হোসাইনীয়া মাদ্রাসার সভাপতি এনায়েত হোসেন নয়ন, পশ্চিম জোয়ার রশিদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি সুলতান গিয়াস উদ্দিন জসিম, উদয়ন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শেখ সেলিম, করেরহাট কেএম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাহার উদ্দিন ভুঁইয়া, শিক্ষক জহিরুল ইসলাম, মাওলানা সোহাগ প্রমুখ। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের কর্মকর্তাদের পক্ষে হরতাল-অবরোধ বন্ধ করে এসএসসি পরীক্ষার্থী শিক্ষার্থীদের নির্বিঘেœ পরীক্ষা দেয়ার দাবি জানিয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন করেরহাট কেএম উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি সাখাওয়াত উল্লাহ রিপন। মাগুরায় বিক্ষোভ মানববন্ধন ॥ মাগুরা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, এসএসসি পরীক্ষা বানচালের উদ্দেশে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ হরতালের প্রতিবাদে মাগুরায় বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী মাগুরা জেলা শাখার উদ্যোগে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে এ মানববন্ধন ও সমাবেশ আনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ জেলা ওয়ারর্কার্স পার্টির সম্পাদক অধ্যক্ষ কাজী ফিরোজসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। বক্তরা বিএনপি-জামায়াত এসএসসি পরীক্ষা বানচালের উদ্দেশে অবরোধ হরতালের নামে পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যার তীব্র প্রতবাদ জানান। মানবন্ধনের শেষে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরে বিভিন্ন শহর প্রদক্ষিণ করে আবার চৌরঙ্গী গিয়ে শেষ হয়। ডিমলায় পরীক্ষার্থীদের মানববন্ধন ॥ নীলফামারী থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার এসএসসি পরীক্ষার্থীরা চলমান হরতাল অবরোধের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে উপজেলার স্মৃতি অম্লান চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। এ সময় বক্তব্য রাখেনÑ ডিমলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সায়েম সরকার, ডিমলা উপজেলার ছাত্রনেতা ফেরদৌস পারভেজ, উত্তম কুমার রায়, ইরফান আহম্মেদ মিঠু, সাইয়েন কাদীর কানন, কলেজ ছাত্র সংগঠনের নেতা আব্দুর রশিদ লেবু, আবু তাহের, আমিনুর রহমান ও শিক্ষক সমিতির পক্ষে নিরেন্দ্র নাথ রায় প্রমুখ। বক্তরা আসন্ন এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি জানান।
×