ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

অবরোধ-হরতালে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

অবরোধ-হরতালে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ

তেসরা ফেব্রুয়ারি আমার এই নিবন্ধটি লেখার দিনে অবরোধ ও হরতাল যুগপৎভাবে পড়েছে ২৯ দিনে। খবরে দেখলাম হরতাল চলবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। তার অর্থ- আজ শুক্রবারে অবরোধের বয়স ৩১ দিন। কার্যত এটা অবরোধ ও হরতাল নয়। পরিষ্কার চলছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। রেললাইন তুলে ফেলা হচ্ছে। ট্রেনে পেট্রোলবোমা মারা হচ্ছে। বাসে, ট্রাকে আগুন লাগানো হচ্ছে। ডজন ডজন নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছেন। নিরীহ মানুষ অগ্নিদগ্ধ হচ্ছেন। কত মায়ের কোল খালি হচ্ছে। কত স্বামী স্ত্রীহারা হচ্ছেন, কত স্ত্রী স্বামীহারা হচ্ছেন। এসব নির্মম ঘটনা ১৯৭১ সালের ৯ মাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েও ঘটেনি। পাকিস্তানীরা ছিল বিদেশী, এখন নির্বাচনের দাবির বকলমে চলছে নিরীহ মানুষ হত্যা। বাতাস এখন ভারি। নিরীহ মানুষ দাবি করছেন এসব অগণতান্ত্রিক কর্মকা- বন্ধ হোক। চারদিকে নিন্দা হচ্ছে এসব কর্মকাণ্ডের। ব্যবসায়ীরা আকুল আবেদন জানাচ্ছেন অর্থনীতি ও ব্যবসার নামে। তাঁরা বলছেন, অর্থনীতি বাঁচিয়ে আন্দোলন হোক। এদিকে দশ বছরের পাঠক্রম শেষ করে ১৫ লাখ স্কুল ছাত্রছাত্রী তাদের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অভিভাবক, স্কুলশিক্ষক, ছাত্রছাত্রী উদ্বিগ্ন। একবার তারিখ পিছিয়েছে। নতুন তারিখ ঘোষিত হয়েছে, পাশাপাশি আবার হরতালের কার্যকালও বাড়ানো হয়েছে। একটা চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। যুদ্ধটা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে। যারা এসব সন্ত্রাস চালাচ্ছে তাদের সামনে কোন আদর্শ নেই। তাদের মুখে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, মধ্যবিত্তের কোন সুখ-দুঃখের কথা নেই। কেবলই নির্বাচনের কথা। তাও বাহ্য! কিন্তু মানুষ পুড়ানো কেন? এই প্রশ্নের কোন জবাব নেই। জবাব না থাক বর্তমান কর্মকাণ্ড আমাদের কি কি ক্ষতি করছে তার আলোচনা সর্বত্র। আমার কলামে এ সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। অর্থনীতির পাশাপাশি বর্তমান সন্ত্রাস যে সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করছে, তা বোধহয় অনেকের অজানা। সে কথাই বলছি। গত সোমবার মতিঝিল থেকে শান্তিনগর বাসায় ফিরছিলাম। রিক্সাই ভরসা। রাস্তায় ‘প্রাইভেটকার’ নেই বললেই চলে। কে যায় এত বড় ঝুঁকি নিতে। অধিকাংশ গাড়িরই ‘থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স’। অতএব কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। যাদের ‘ফার্স্ট পার্টি ইন্স্যুরেন্স’ তাদেরও সমস্যা। শত হোক বীমা কোম্পানি ‘ক্লেইম সেটেলমেন্ট’ করে না। মাঝখানে আবার কোর্ট-কাছারি জড়িত। অতএব, কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বেরোতে চায় না। একই অবস্থা আমারও। যখন রিক্সা ডাকলাম ধরেই নিলাম ৩০-৪০ টাকার নিচে রিক্সা পাব না। না, আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো, রিক্সাওয়ালা বলল ২৫ টাকা। আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি। কথা না বলে এক লাফে রিক্সায় উঠলাম। ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কী। কত কম দরে ও কিভাবে রাজি হলো। গাইবান্ধার রিক্সাওয়ালা। ঢাকায় সে একা থাকে সবুজবাগের এক বস্তিতে। কয়েকজন একসঙ্গে থাকে। সবাই গাইবান্ধার। খাওয়া-দাওয়া, থাকা একসঙ্গে। সুখ-দুঃখ একসঙ্গে। দুপুরে বাইরে চা-নাস্তা খায়। সকালে ডাল-ভাত খেয়ে ‘মেস’ ছাড়ে। রাতে মেসে যাওয়া। ‘মিল’ হিসাবে খরচ। প্রশ্ন করতে করতে জানতে পারলাম ওর দুই মেয়ে, স্ত্রী বিদ্যমান। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। জামাই এক দোকানে কাজ করে। খাওয়া-দাওয়া মালিকের। মাসে সামান্য কিছু বেতন দেয়, কিন্তু সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। তার মতে, জামাইটার পরিবার ভাল, তাদেরই পাশের গ্রামের লোক এরা। জামাই পক্ষের দাবি ৪৫ হাজার টাকা নগদ। বিয়ে হয়ে গেছে ‘বাকিতে’। পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা দেয়া শেষ হবে, জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাইপক্ষ মেয়েকে তুলে নেবে। রিক্সাওয়ালার এখন সংগ্রাম টাকা সংগ্রহের। তার জমিজমা কিছু নেই। ছিল নদীর পাড়ে বাড়ি। যমুনা নদী-সর্বনাশা নদী। বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে গেছে। এখন ভূমিহীন, গৃহহীন। বর্তমান বসতি সরকারী জায়গায়। কবে উচ্ছেদ হয় সেই আতঙ্ক তার মনে। শুধু ও নয়, আরও অনেকে। এখন মাঘ মাসের শেষ। জ্যৈষ্ঠ মাস আসতে আর মাত্র তিন মাস বাকি। তার কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার টাকা জমাতে হবে। পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা জামাইকে দিতে হবে, বাকি টাকা লাগবে মেয়েকে তুলে দিতে। গরিব কিন্তু সামাজিকতা বলে একটা কথা আছে। তার থেকে মুক্তি নেই। দিনে ৫০০ টাকা জমাতে পারলে মাসে হয় মাত্র ১৫০০০ টাকা। চার মাসে হবে ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু হরতাল ও অবরোধ তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। জান দিতে প্রস্তুত। সপ্তাহে সাত দিন রিক্সা চালানো যায় না। সব দিন সমান রোজগার হয় না। আট ঘণ্টার বেশি রিক্সা চালানো যায় না। এতসব বাধার পরও রিক্সাওয়ালা জান দিয়ে হলেও কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা জমাতে চায়। কিন্তু হরতাল-অবরোধে রোজগার ঠিকমতো হচ্ছে না। দিনে ৫০০ টাকা হচ্ছে না। কোনদিন ৩০০ টাকাতেও নেমে যাচ্ছে। তার দুশ্চিন্তা যদি টাকা যোগাড় না হয় তাহলে কী হবে? মেয়েকে তুলে দিতে না পারলে সর্বনাশ! বিয়ে ভেঙ্গে যায় কিনা, সময় বাড়ানো যাবে কিনা- এ ধরনের চিন্তায় তার এখন ঘুম হয় না। সবাইকে প্রশ্ন করে, স্যার হরতাল-অবরোধ উঠবে না। কে দেবে এ প্রশ্নের উত্তর। এবার আসা যাক আরেক খবরে। হরতাল-অবরোধে গ্রামের কৃষক মার খাচ্ছে। তারা ফসলের দাম পাচ্ছে না। দুধওয়ালার দুধ নষ্ট হচ্ছে। মুরগি, হাঁস, মাছের খামারিদের মাথায় হাত। পর্যটন শিল্পের বারোটা বেজেছে। পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি খতিগ্রস্ত। তৈরি পোশাকের রফতানিকারকদের অর্ডার বাতিল হয় হয়। ব্যাংকাররা উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিদেশী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। ব্যবসা হচ্ছে না। মালিকরা এসব বোঝে না। তাদের লাভ চাই। ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা লাভ চায়। তারা আনন্দে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করছে। কিন্তু অধস্তনদের কাছ থেকে ব্যবসা চাই। না হলে বছর শেষে শুরু করবে ‘ছাঁটাই’। মানুষের যাবে চাকরি। এসব তো ভবিষ্যতের কথা। বর্তমানের কথা কী? সংগঠিত খাতের কথা বাদ দিই। কারণ সেখানে কত লোক আর চাকরি করে। বেশিরভাগ লোকের চাকরি বেসরকারী অসংগঠিত খাতে। সবচেয়ে বড় কথা চাকরি নয়, দিন আনে দিন খায়- এ ধরনের লোকের সংখ্যাই বেশি। আবাসন শিল্পে কাজ করে লাখ লাখ শ্রমিক- এরা চাকরিজীবী নয়। দোকানে দোকানে ঠিকা কাজ করে- এরা চাকরিজীবী নয়। এরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে। চাতালে কাজ করে হাজার হাজার শ্রমিক, চিংড়ি ও মৎস্য চাষ, সেলাই, ওয়েল্ডিং, হোটেল ও রেস্তরাঁয় কাজ করে লাখ লাখ লোক। এ ধরনের লোকের সংখ্যা কত যারা চাকরিজবীবী নয়। এ ধরনের লোকেরা মাস শেষে বেতন পায় না। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, সাপ্তাহিক ছুটি, বিনোদন ছুটি, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি এদের কোনদিনই প্রাপ্য নয়। অথচ এই কোটি কোটি দিনমজুর আজ ভাগ্যের কাছে মার খাচ্ছে। প্রতিদিন খবর ছাপা হচ্ছে, কাগজে ছবি ছাপা হচ্ছে। শ্রমিক বসে আছে খোলা রাস্তায়, সামনে তার যন্ত্রপাতি। এখন দারুণ শীত। তার মধ্যেই সে কোনমতে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে ‘ডাকের’ আশায়। না এর কোন ভরসা নেই। দিন শেষে তার ভরসা কী? ধার-কর্জ ছাড়া উপায় নেই। যারা গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছে কাজের আশায় তারা গ্রামে চলে যাচ্ছে। যাদের আস্তানা ঢাকার বস্তিতে তাদের কী উপায়? ধার-কর্জ ছাড়া গত্যন্তর নেই। পাশের দোকানির কাছ থেকে বাকিতে মাল কেনা। চাল বাকিতে কেনা, সবজি, মাছ ইত্যাদি। কে দেবে এত ধার। সবারই এখন টানাটানি চলছে। যারা পারছে তারা তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গে খাচ্ছে। অবস্থাপন্ন আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার নিচ্ছে। এই যে কষ্ট ভোগকারী দিনমজুর তাদের সংখ্যা কত? সম্প্রতি একটি দৈনিকে সরকারের তথ্য উদ্ধৃত করে কিছু খবর দেয়া হয়েছে। এসব তথ্য থেকে সমস্যার ব্যাপকতাটা খবরের কাগজের তথ্যমতে, দেশে এখন ৪ কোটি ৮০ লাখের মতো শ্রমিক আছে। এর মধ্যে সিংহভাগই দিনমজুর, যারা দৈনিক মজুরিরভিত্তিতে কাজ করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশে নাকি চালকল আছে ২১ হাজারের বেশি। যদি তাই হয়, তাহলে এতে দৈনিক কতজন শ্রমিক কাজ করে। কয়েক হাজার যদি হয় চাতাল তাতে শ্রমিক কাজ করে কতজন। এভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে প্রায় তিন-চার কোটি দিনমজুরই আজ বেকার। ভাবা যায় বিষয়টির ব্যাপকতা ও গভীরতা। এক অর্থে যারা দেশের গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ আজ উপোসী। রোজগার নেই, কাজ নেই। কর্মহীন বেকার জীবনযাপন করছে এই লোকেরা। এদের আয় না হলে বাজারও একপর্যায়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শত হোক তাদের ক্রয়ক্ষমতাও ‘বাজারের’ (মার্কেটের) একটা বড় শক্তি। মধ্যবিত্ত ক্ষতিগ্রস্ত, নতুন নতুন লোকের চাকরি যাওয়ার উপক্রম। এদিকে খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ। এ সবই শেষ বিচারে ক্ষতি করবে জাতীয় উৎপাদনের। আমাদের প্রাক্কলিত জিডিপি হার অর্জিত হবে না। অথচ এ সময়টা ছিল আমাদের জন্য খুবই অনুকূল। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম কম, তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে সর্বনিম্ন। এর সুযোগ আমরা নিতে পারতাম। এ সুযোগ নষ্ট হতে যাচ্ছে। এটাই চায় বাংলাদেশবিরোধী একটা চক্র। বাংলাদেশে আগুন জ্বলুক এটা একটা প্রতিশোধমূলক চক্রান্ত। সেই চক্রান্তের একটা আভাস পাওয়া গেল একটি বিদেশী দূতাবাসের এক কর্মকর্তার ‘দেশত্যাগের’ মাধ্যমে। লেখক : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
×