ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ পূর্ণ হচ্ছে শাহবাগ আন্দোলনের দুই বছর

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সফল আন্দোলন

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের সফল আন্দোলন

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। একটি রায়ের অপেক্ষায় বাংলাদেশ। রায় হলো। ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের চাহিদা পূরণে তা ব্যর্থ। পুরো বাঙালী জাতিকে অবজ্ঞা করে যুদ্ধাপরাধের আসামি কসাই কাদের মোল্লা দেখিয়ে বসল বিজয় চিহ্ন। মুহূর্তেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ। অনলাইন থেকে আহ্বান জানানো হয় রাজপথে নেমে আসার। নেমে এলো কয়েকজন। শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে অল্প মানুষের সমাগম। লোক সমাগম বাড়তে লাগল। মুহূর্তেই গণমানুষের গণজোয়ারে পরিণত হলো শাহবাগ। শাহবাগে গড়ে ওঠা ওই আন্দোলন মিডিয়ায় প্রচারিত হতে লাগল নানা নামে। শাহবাগ আন্দোলন, গণজাগরণ, শাহবাগ গণদাবি, শাহবাগ গণ-অবরোধ, শাহবাগ প্রজন্ম চত্বর নামসহ নানা নামে প্রচারিত হতে থাকে ওই আন্দোলন। শাহবাগ আন্দোলন ও গণজাগরণ নামে পরিচিতি পাওয়া আন্দোলনটি একটি সময় গণজাগরণ মঞ্চ নামে রূপ লাভ করে। তবে তরুণ প্রজন্মের ওই আন্দোলনটি লোকমুখে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন নামেই বেশি পরিচিত। আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে শাহবাগ আন্দোলনের দুই বছর। এই সময়ে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে নতুন প্রজন্মের হাতে গড়া শাহবাগের ওই আন্দোলন। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে প্রতিবাদটি শুরু হয়। অল্প সময়েই তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের ইতিহাস। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করে। রায়ের পর পরই বিক্ষুব্ধ ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্টদের কয়েকজন নিজ নিজ দায়বদ্ধতা থেকেই শাহবাগে এসে মিলিত হয়। ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (বোয়ান) ব্যানারে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে যায় কিছু তরুণ। যুক্ত হতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। দেশের প্রতিটি স্থানে রায়ের বিরুদ্ধে রূপ নেয় আন্দোলনের নবজোয়ার। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আদলে দেশের বাইরেও গণমানুষের এ আন্দোলন রং ছড়ায়। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধিত হয়, যুক্ত করা হয় সরকার পক্ষের আপীল। তারই ধারাবাহিকতায় কসাই কাদের মোল্লাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়। ওইদিন কসাই কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পর পরই প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় নির্ঝর মজুমদার। তিনি বলেন, ‘বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে আমরা জমায়েত হব, বিক্ষোভ-সমাবেশ হবে।’ ওই স্ট্যাটাসের নিচেই প্রথমে রাকিবুল বাশার রাকিব মন্তব্য করেন, ‘আমি ঢাকার দায়িত্ব নিলাম।’ এরই মাঝে ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক একটি আহ্বান জানায় যেখানে ইমরান এইচ সরকার ও মাহমুদুল হক মুন্সির নিজস্ব ফোন নং দিয়ে সকলকে শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। তার নিচে মন্তব্য করে ব্লগার অনিমেষ রহমান বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তায় নেমে আসুন। তবে ওই ফেসবুকে ইভেন্টের প্রধান প্রচারক ছিলেন সিডাটিপ হিপনোটিক্স (পরাগ)। এ প্রসঙ্গে শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম কর্মী মাহমুদুল হক মুন্সি জনকণ্ঠকে বলেন, রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ১২টা ২২ মিনিটে আমি একটি ইভেন্ট খুলি। সবাইকে অহ্বান জানানো হয় দ্রুত সময়ের মধ্যে রাস্তায় নেমে আসার। ফেসবুকে ইভেন্ট প্রচারে এগিয়ে আসেন সিডাটিপ হিপনোটিক্স (পরাগ)। তার পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সকলেরই জানা। ১২ ডিসেম্বর ২০১৩ কসাই কাদের মোল্লাকে ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। আন্দোলনকারী একাধিক কর্মীর দাবি, কসাই কাদের মোল্লাকে ঝোলানোর পেছনে তাদের ভূমিকাই মুখ্য। এ প্রসঙ্গে আন্দোলনের অন্যতম কর্মী ও ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু জনকণ্ঠকে বলেন, কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসিটি তরুণ প্রজন্মের অন্যতম বিজয়। তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনে নেমে না এলে, লাখো-কোটি জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার না হলে, হয়তবা পার্লামেন্ট নতুন করে আইন প্রণয়ন করত না। শাহবাগ আন্দোলনের ফলেই সরকার নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছে। আজ দুই বছর পেরিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ কয়েকটি খ-ে বিভক্ত। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আন্দোলন থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের মতে, পাঁচ শতাধিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন গণজাগরণের ওই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু বর্র্তমানে তেমন কোন সংগঠনের উপস্থিতি চোখে পড়ে না। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে ইমরান এইচ সরকার বলেন, পাঁচ শতাধিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আমাদের সঙ্গে ছিল। আমার বিরুদ্ধে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে অভিযোগ করা হয় এটি একটি ভুল ধারণা। ওই পাঁচ শতাধিক সংগঠন থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে বসা হলেও মিটিং চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। একেক জনের একেক রকম সিদ্ধান্ত। আর সময়ের কারণেই এমনটি হয়েছে। ইমরান এইচ সরকারের মন্তব্যকে নাকচ করে দিয়ে ব্লগার এ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্টের (বোয়ান) সভাপতি ব্লগার অনিমেষ রহমান বলেন, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষসহ মূল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে চলার কারণে আমাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিতে বিদেশী মালিকানাধীন এনজিওর প্রভাব ছিল। খুশি কবিরের মতো ব্যক্তিত্বের ছায়ায় গণমানুষের গণআন্দোলন চলতে পারে না। ইতিহাস বলে দেয় প্রতিটি আন্দোলনই একটি সময় বিলীন হয়ে যায়। ৫ তারিখের সেই গণমানুষের স্রোত আর ফিরে আসার নয়।
×