ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কোকো কাহিনীর আরেক পিঠ ফালু কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কোকো কাহিনীর আরেক পিঠ ফালু কাহিনী

শংকর কুমার দে ॥ গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বের হচ্ছে, কোকো কাহিনীর আরেক পিঠ আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ‘ফালু কাহিনী’। গাড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেফতার করা ফালুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, ‘ফালুর ব্যবসার অংশীদার কোকো’ সম্পর্কিত তথ্য? রাজধানীর মিন্টো রোডের ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অফিসে বিএনপির যে চার নেতাকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তার মধ্যে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ফালুকে। ফালুই হচ্ছেন পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবাসায়িক, রাজনৈতিকভাবে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার খুবই ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, উপদেষ্টা মোসাদ্দেক আলী ফালু, শামসুজ্জামান দুদু ও যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদÑ বিএনপির এই চার নেতাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে গোয়েন্দারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, সদা হাসিখুশি, নিরহংকারী ফালু, আপন ভুবন রচনা করে আওয়ামী লীগের দুই বার ক্ষমতায় আসার পর গ্রেফতার এড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করেছেন দুই বারই। তবে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠ হাওয়া ভবনের মালিক আলী আসগর লবী, তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফর রহমান বাবরের সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালুও। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে যৌথবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বেগম জিয়ার পরিবারের ব্যবসার নামে একেক জন ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ হওয়ার কাহিনী ফাঁস করেছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কথিত চিরশত্রু বিএনপির খোদ বেগম জিয়ার ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত হয়েও একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে ফালু ব্যাংক ব্যবসা, শেয়ারবাজার, টিভি চ্যানেল এনটিভি, সংবাদ মাধ্যম আর ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। বেগম খালেদা জিয়ার নামে করা ঢাকার অদূরে একটি বৃদ্ধাআশ্রম নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব ছিল তাঁর। বিএনপির বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের সরকারী মহলে তার সখ্য ও বিচরণ ছিল বেশি। এ কারণে পানিতে সাঁতার কেটেও গায়ে কোনদিন পানি লাগেনি। সেই ফালু কিনা এবার আটক হয়ে গেছেন গাড়ি পোড়ানোর মামলায়। এখন আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে ব্যবসায়ে কোকোর অংশীদারের টাকার হিস্যা নিয়ে। তাঁর আটকের হিসাব-নিকাশ মেলাতে ব্যস্ত গোয়েন্দারা। ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়ার মতো বিএনপির সরকারের আমলে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নেপথ্য কাহিনী খুঁজে বের করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অনেকটা ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার’ মতোই বের হয়ে আসছে ফালু কাহিনী। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, তারা অভিযোগ পেয়েছে, ফালুর কাছে রয়েছে কোকোর টাকা ও বেগম জিয়ার পরিবারের সহায় সম্পত্তির হিসাব। এরশাদের পতনের পর বেগম জিয়া প্রথম দফায় সরকার গঠন করলে তাঁর একান্ত সচিব হন ফালু। তখন প্রবল ক্ষমতাধর ছিলেন তিনি। ফালুকে সমীহ করে চলতেন অনেক মন্ত্রীও। তাঁর দাপটের কাছে সিনিয়র অনেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা ছিলেন অসহায়। গুলশানের বিএনপি কার্যালয়ে রাখা কোকোর কফিনের পাশে বসে বেগম খালেদা জিয়ার সামনে ফালুর কান্নার দৃশ্য অনেকের হাসির খোরাক যোগানোর মতো কৌতুকে পরিণত হওয়ার বিষয়ে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছে ফেসবুকে। এসব দৃশ্যও নজর কেড়েছে গোয়েন্দাদের। জিয়া পরিবারের টাকা, সম্পদ ও হিসাব বের করতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাঁকে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে গোপনে। এ জন্যই খিলগাঁওয়ে গাড়ি পোড়ানোর মামলায় আপাতত ফালুকে আটক দেখানো হলেও সরকারের গ্রীন সিগন্যাল মিললে ফালুর নামে আরও মামলা দায়ের করা হতে পারে বলে এমনটি আভাস দিয়েছে গোয়েন্দারা। কারণ বিএনপি ও বেগম জিয়ার পরিবারের সব কিছুই তার নখদর্পণে। গোয়েন্দা সূত্র জানান, কোকো মারা গেলে তার লাশ আনতে মালয়েশিয়া চলে যান ফালু। কোকোর লাশ বনানী কার্যালয়ে নিয়ে গেলে বেগম জিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোকোর লাশের সঙ্গে পরিবারের বাইরে ছিলেন কেবল ফালুই। কোকোর লাশ আনতে ফালুর মালয়েশিয়া যাওয়ার ঘটনায় আবারও লাইম লাইটে আসেন তিনি। এমনকি তিনি বিএনপির অনেকের কাছেই আবারও ঈর্ষায় পরিণত হয়েছেন। এখনও বেগম জিয়ার কাছে দলের অনেক নেতার চাইতে অতিশয় বিশ্বস্ত ফালু। তাঁর সঙ্গে শোকার্ত মা হিসেবে চিন্তা, চেতনা ও ব্যক্তিগত কথাবার্তায় সান্ত¡না পেতে শেয়ার করতে চেয়েছিলেন পুত্রহারা বেগম জিয়া। গোয়েন্দাদের কাছে অভিযোগ আছে, কোকোর বেনামী টাকার সবটাই রয়েছে ফালুর কাছে। ফালু তার নিজ ব্যবসা দিয়ে হোয়াইট করছেন বিপুল অঙ্কের ব্ল্যাক মানি। ফালু নিজেও গত ছয় বছর চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন। বেসরকারী ব্যাংক আইএফআইসির পুরো মালিকানাই তার। এমনকি অভিযোগ আছে, শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও তার ভূমিকা আছে। বিএনপির প্রথম সরকারে বেগম জিয়ার একান্ত সচিব থাকার পরও ফালুকে আওয়ামী লীগ তার গত দু’দফা সরকারের মেয়াদে কিছুই বলেনি বরং আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সব লবি মেইনটেইন করার মধ্য দিয়ে ফালু নিজে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ধরে রাখেন। অঢেল সম্পত্তির মালিক হন ফালু। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ফালুর যেভাবে দীর্ঘ সময় কেটেছে সেই সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী, ’৯৬তে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে চুপচাপ কাটিয়ে দেন ফালু। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বিএনপির রাজনীতি থেকে আবারও নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। ২০০১ সালে বিএনপি পুনরায় ক্ষমতাসীন হলে ফালু বেগম জিয়ার কাছাকাছি থাকতে ব্যর্থ হন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই বিএনপির নেতৃত্ব তারেক রহমানের হাতে। তখন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফালুর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি ভালভাবে নেননি পুত্র তারেক রহমান। তারেক রহমানের হাতে ক্ষমতা যাওয়া পর ক্ষমতার শীর্ষস্থান থেকে ছিটকে পড়েন ফালু। একপর্যায়ে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফালুর ঢোকাও বন্ধ হয়ে যায়। ২০০১ সরকারের শেষের দিকে বি. চৌধুরী-মেজর (অব) মান্নানের নেতৃত্বে বিএনপিতে ভাঙ্গন ধরে। এর আগে বিএনপির মনোনীতি রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরীকে মগবাজারের রেললাইন ধরে দৌড়ানি দেয় বিএনপি। বি. চৌধুরীর রেললাইন ধরে দৌড়ানোর দৃশ্য সামনে আসার নেপথ্যের কারিগর ছিলেন তারেক রহমান। বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। শূন্য হয় ঢাকা-১০ আসন। অনেক প্রভাবশালী প্রার্থীকে টপকিয়ে তখন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী মনোনয়ন বাগিয়ে নেন ফালু। ভোটারবিহীন তুমুল বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফালু সাংসদ নির্বাচিত হন। সরকার পতনের পরে ওয়ান ইলেভেন এলে ফালু তখন আটক হন। ওয়ান ইলেভেন সরকারের কাছে ফালু তার সহায় সম্পত্তির বিবরণ দিলে চমকে যান দেশবাসী। তখনই প্রকাশ পায়, শাজাহানপুরের ফালু ছিলেন সামান্য একজন গোরখোদকের সন্তান। কিন্তু বেগম জিয়ার দু’দফা সরকারের সময়ে ফালু হাজার কোটি টাকার সহায় সম্পত্তির মালিক বনে গিয়ে সবাইকে চমকে দেন। গোয়েন্দা সংস্থার এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যাত্রাবাড়ীর বাসে পেট্রোলবোমা হামলার মামলায় ফের রিমান্ডে আনা হয়েছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে। বিএনপির নেতা সামসুজ্জামান দুদুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ করা অব্যাহত আছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকেও। বিএনপির চার নেতাকে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে চলমান অবরোধের সঙ্গে হরতালের নামে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে সহিংস সন্ত্রাস চালানোর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালুকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে কোন মহল থেকে কোন প্রকার তদ্বির করা হচ্ছে না বলে জানান গোয়েন্দারা বরং গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে সব ধরনের সহায়তা করছেন তিনি (আলহাজ মোসাদ্দেক আলী ফালু)।
×