ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আহত অর্ধশত ॥ যাত্রী ও পণ্যবাহী পরিবহনে বেশি নাশকতা

সরেজমিন রংপুর ॥ বেপরোয়া জামায়াত-শিবির আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে ৯ জনকে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সরেজমিন রংপুর ॥ বেপরোয়া জামায়াত-শিবির আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে ৯ জনকে

রাজন ভট্টাচার্য/মানিক সরকার মানিক ॥ নগরবাড়ি থেকে সরকারী জরুরী সার ট্রাকে বোঝাই করে লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরের গোডাউনের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন ট্রাকচালক জেলাল শেখ (৩২) ও তার সহকারী মোহাব্বত (৩৪)। ভালই গল্প-গুজবে কাটছিল তাদের সময়। ট্রাকটি যখন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ চক্ষু হাসপাতাল অতিক্রম করছিল ঠিক তখনি চালক জেলাল দূর থেকে দেখতে পান মাফলার দিয়ে মুখ পেঁচানো তিন চার যুবক আগুনের এক কু-লী হাতে এগিয়ে আসছে। তাদের দেখে সন্দেহ হলে ট্রাকের জানালা তুলে দেন জেলাল। এক যুবক এরই মাঝে আস্ত একটি ইট ছ্ুড়ে মারে সামনের গ্লাসে। আরেক যুবক ছুড়ে মারে আগুনের কু-লীটি। নিমিষেই জেলাল এবং মোহাব্বতের চোখ মুখ ঝলসে যায় পেট্রোলবোমার আগুনে। এলাকাবাসী উদ্ধার করে প্রথমে তাদের নিয়ে যায় গোবিন্দগঞ্জ হাসপাতালে। পরে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। পেট্রোলবোমার শিকার হওয়ার এ বর্ণনাটি ছিল রংপুর মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন জেলালের। রংপুর অঞ্চলে একের পর এক ঘটছে পেট্রোলবোমার ঘটনা। উত্তরের এ জেলায় বেপরোয়া জামায়াত শিবির। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে ফের এলাকায় ফিরেছেন স্থানীয় জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারির মধ্যেও নাশকতা থেমে নেই। নিরাপদ নয় এ এলাকায় সড়ক মহাসড়ক। জেলা শহর, উপজেলা থেকে শুরু করে সবখানেই সুযোগ বুঝে হামলা চালাচ্ছে। এ কারণে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। লাগাতার অবরোধের প্রায় এক মাসে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বার্ন ইউনিটেই মারা গেছেন ৯ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন অন্তত অর্ধশত। আর মৃত্যু যাতনায় হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছেন এখনও ৮ জন। অসহায় পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের খোঁজ রাখে না কেউ। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাবে পরিবারের চাকা থেমে যেতে বসেছে। এদিকে রংপুরে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ঘটছে বোমা মেরে জঘন্য এ মানুষ হত্যার ঘটনা। এ অঞ্চলে প্রথম পেট্রোলবোমার ঘটনাটি ঘটে গত ১২ জানুয়ারি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। এখানে জামায়াত শিবিরের কর্মীরা একটি বাসে বোমা ছুঁড়লে অগ্নিদগ্ধ হন গঙ্গাচড়ার বেতগাড়ির স্বপন (৩৫) আর বদরগঞ্জের আসাদুল (৩৫)। তারা এখনও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু যাতনায় ছটফট করছেন। এর দুদিন পরেই বড় ঘটনা ঘটে রংপুরের মিঠাপুকুরে। এদিন রাতে কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা অভিমুখী খলিল স্পেশাল নামের একটি বাসে পেট্রোলবোমা ছুঁড়লে ঘটনাস্থলেই অঙ্গার হয়ে যায় তাজা চারটি প্রাণ। এ সময় অগ্নিদগ্ধ হন ১৮ জন। এদের মধ্যে পরবর্তীতে মারা যান আরও দু’জন। সেদিনের সেই ঘটনায় এখনও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু যাতনায় কাতরাচ্ছেন দু’জন। গত ২৪ জানুয়ারি রাতে পেট্রোলবোমার শিকার হয়ে রংপুরে আসেন ট্রাক চালক আব্দুল মালেক ও রফিকুল ইসলাম। পরদিন মালেক মারা গেলেও রফিকুল এখনও যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। গত বুধবার রাতে মারা যান দিনাজপুরের পুলহাট এলাকার আব্দুর রশীদ। তিনি ভুষির বন্দরে পেট্রোলবোমার শিকার হন। একই ঘটনায় মারা যান গোলাম রব্বানী নামের আরেকজন। রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক মারুফুল ইসলাম জানান, সোমবার পর্যন্ত এখানে ৮ জন অগ্নিদগ্ধ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যেহেতু এদের প্রত্যেকের মুখম-ল পুড়ে গেছে সেহেতু এদের কাউকেই এখনও আশঙ্কামুক্ত বলা যাবে না। তিনি জানান, হাসপাতালের এ ইউনিটটি যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। রংপুরের পুলিশ সুপার আব্দুর রাজ্জাক জানান, নাশকতা ও নৈরাজ্য দমনে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব সর্বত্রই কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপরও চোরাগোপ্তা বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। দূর থেকে কেউ মেরে পালালে তাদের তো আর ধরা যায় না। বিজিবির রংপুর রিজিয়ন সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহফুজার রহমান জানান, তাদের রিজিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীন উত্তরের এ ১৬ জেলার পুলিশ প্রশাসনের বাইরেও এসব জেলার সড়ক মহাসড়কে বিজিবি ৫২টি প্লাটুন নিয়মিত কাজ করছে। এছাড়াও আরও ২২ প্লাটুন রিজার্ভ রয়েছে। যে কোন প্রয়োজনে তারাও মাঠে নেমে আসবেন বলে জানিয়েছেন রহমান। নাশকতা রোধে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান। নিয়মিত অভিযান তো আছেই। জানা গেছে, গত কিছুদিনে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের ১৬ জেলায় তারা ৫৯টি পিস্তল রিভলবার আটক এবং ২৪৮ রাউন্ড গুলি, ৫৪টি ম্যাগজিন, গান পাউডার ৩৩ কেজি উদ্ধার করেছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। নাশকতার কারণে থেমে যাচ্ছে গাড়ির চাকা। সীমিত আকারে চলছে আন্তঃজেলা ও অভ্যন্তরীণ যানবাহন। যাত্রী, চালক, হেলপাররা নেহায়েত চরম বেকায়দায় পড়েই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা নিয়েই চলাচল করছেন। সবার মনে ভয়, এই বুঝি এলো পেট্রোলবোম ! রংপুরে সন্ত্রাস নির্মূলের ঘোষণা ॥ ঐতিহ্যের জেলা রংপুর। যেখানে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার জন্ম। সাম্প্রতিক সময়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জামায়াত-শিবিরের আগ্রাসন, হামলাসহ নানা অঘটনে স্থানীয় মানুষের শান্তি গেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে জেলার বিভিন্ন স্থানে চলছে সহিংস তা-ব। রংপুরের মিঠাপুকুরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির দুর্বলতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বেগম রোকেয়ার মিঠাপুকুরে নারীদেরও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহার করা হচ্ছেÑ উল্লেখ করে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক ও এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। ১৬ জানুয়ারি মিঠাপুকুর উপজেলা বালিকা বিদ্যালয় মাঠে ‘সন্ত্রাস ও নাশকতা, অবরোধে আইনশৃঙ্খলা’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তারা এ ঘোষণা দেন। আইজিপি বলেন, রংপুরের মিঠাপুকুরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিদের দুর্বলতার কারণে এখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখন পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন দেখছেন। তাদের সঙ্গে আপনারা (নারী) কেন? মিঠাপুকুরের পাশাপাশি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী, গোবিন্দগঞ্জেও সন্ত্রাসীরা ত্রাস সৃষ্টি করেছে বলে উল্লেখ করেন আইজিপি। তিনি বলেন, আমরা এ সন্ত্রাসীদের নির্মূল করবোই। আজকে যারা হরতাল, অবরোধ, ভাংচুর করছেন তারা এসব কীসের জন্য করছে? এটা তারা নিজেরাও জানেন না। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বেনজীর আহমেদ বলেন, মিঠাপুকুরে দুর্বৃত্তরা পাঁচজনের প্রাণ নিয়েছে। তাদের মধ্যে একটি নিষ্পাপ শিশুও ছিল। ২০১৩ সালের মতো একটি গোষ্ঠী দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানুষ হত্যা করতে আগুন দিয়ে জ্বালাও-পোড়াও করছে। এছাড়া, সন্ত্রাসীরা গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য দাঁড়িয়েছে। এদিকে ২৯ জানুয়ারি নাশকতার অভিযোগে বিএনপি জামায়াতের ৪৫ জনকে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আগের দিন আরও ৫৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯ জানুয়ারি জেলার মিঠাপুকুর উপজেলা থেকে গ্রেফতার করা হয় বোমারু মিন্টুকে। বেশির ভাগ হামলাকারী মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র ॥ হরতাল, অবরোধসহ নানা কর্মসূচীতে দায়িত্ব পালনরত রংপুরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর জামায়াত-শিবিরের তা-ব মামলার আসামির বেশিরভাগই মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। তাদের অনেকে গ্রেফতার হলেও বেশির ভাগ এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব অরাজকতার কারণে মামলা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনও অগ্রগতি নেই। মামলার আসামি জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনার মূল হোতাই ছিল জামায়াত-শিবির ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী। ফিরে দেখা ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, চলমান নাশকতার সঙ্গে যুক্তদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। তা ছাড়া দেশের মধ্যে যে কয়টি জেলায় সবচেয়ে বেশি নাশকতার ঘটনা ঘটে এর মধ্যে রংপুর অন্যতম। এখানে সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণা করে। এ রায় ঘোষণার পরপরই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা একযোগে হামলা চালায় বিভিন্ন সরকারী স্থাপনা, আওয়ামী লীগ অফিস, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও পুলিশের ওপর। ওইদিন রংপুরের মিঠাপুকুর ও পীরগাছায় জামায়াত-শিবিরের তা-বে এক পুলিশ সদস্য নিহত ও অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছিলেন। জামায়াত-শিবিরের লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের ওপর হামলা চালায়। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিস ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়। লুটপাটের চেষ্টা করে স্থানীয় সোনালী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি দোকানে। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করে। মামলায় ১০ হাজারের বেশি আসামি করা হয়। মামলার পরপরই পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে মাদ্রাসা শিক্ষক ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের। এদিকে, একই দিন পীরগাছা উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে মোজাহার আলী নামের এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন। আহত হন আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, মিঠাপুকুর ও পীরগাছা উপজেলায় অন্তত ১৫০টি মাদ্রাসা রয়েছে। এবারের ২০ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ফের নাশকতা চলছে। পলাতক আসামিরা ফিরে এসেছে এলাকায়।
×