ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কুমিল্লায় পেট্রোল বোমায় ৭ যাত্রী নিহত ॥ এ কোন্ পৈশাচিকতা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কুমিল্লায় পেট্রোল বোমায় ৭ যাত্রী নিহত ॥ এ কোন্ পৈশাচিকতা

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ কুমিল্লায় আইকন পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি নৈশকোচে পেট্রোবোমা হামলায় ৭ যাত্রী নিহত হয়েছে। এতে দগ্ধ ও আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার মিয়াবাজারসংলগ্ন জগমোহনপুর নামকস্থানে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলপথমন্ত্রী মোঃ মুজিবুল হক এমপি, র‌্যাব-হাইওয়ে ও থানা পুলিশসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী প্রতিবাদ-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এদিকে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দিতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পুলিশ, আহত যাত্রী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আইকন পরিবহনের একটি নৈশ কোচ (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৪০৮০) মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজারসংলগ্ন জগমোহনপুর নামকস্থানে পৌঁছলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে বাসটির ভেতরে-বাইরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। এ সময় বাসে ঘুমিয়ে থাকা যাত্রীরা কোন কিছু বুঝে ওঠার আগে আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই ৭জন মারা যায়। নিহতরা হচ্ছেনÑযশোরের গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার জেলা সদরের ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা (বাসা- ৩৫, গোলাপ সেন্টার), হাজী রুকনুজ্জামানের পুত্র নুরুজ্জামান পপলু (৫০), তার একমাত্র মেয়ে যশোর পুলিশ লাইন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী মাইশা নাঈমা তাসনিন (১৫), কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার আবু তাহের (৩৮) ও আবু ইউসুফ (৪৫), নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আসমা আক্তার (৩৮) ও তার ছেলে শান্ত (৬) এবং শরিয়তপুর জেলার ঘোষেরহাট উপজেলার দক্ষিণ গজারিয়া গ্রামের ওয়াসিম। নিহতদের দেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। এ সময় যাত্রীদের আর্তচিৎকারে পুলিশ ও স্থানীয়রা এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। খবর পেয়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। দগ্ধদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ৬ জন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। তারা হলেন- কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সালেহ আহমেদের পুত্র কাঁচামাল ব্যবসায়ী হানিফ (৩৬), একই উপজেলার প্রহরচন্দা গ্রামের সৈয়দ আহমেদের পুত্র রাশেদুল ইসলাম বাদশা (৪২), নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার সোনারগাঁও গ্রামের আলাউদ্দিনের পুত্র পপকর্ন বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম (২৪), ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের আমির আলী শিকদারের পুত্র আরিফ শিকদার (১৮), একই গ্রামের শরিফুল ইসলামের পুত্র জিলকদ আহমেদ (২২), মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার কমলনগর গ্রামের আবদুস সালামের পুত্র ফারুক আহমেদ (২৩)। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সার্জন ও সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মির্জা মোঃ তাইয়েবুল ইসলাম জানান, দগ্ধদের মধ্যে জিলকদ, রাশেদুল ও শফিকুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের শরীরের ৭৪ থেকে ৭৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নেয়া আহতরা হলেন- যশোরের নিহত নুরুজ্জামানের স্ত্রী মাহফুজা বেগম মিতা, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার কমলনগর গ্রামের ইউনুছ মোল্লার পুত্র শরিফুল ইসলাম, আবুল কালামের পুত্র আলী হোসেন, জহিরুল ইসলামের পুত্র জিলকদ, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার কালীরবাজার গ্রামের আলমগীর হোসেনের পুত্র রাতুল, কক্সবাজারের টেকনাফের নুরুল আলমের পুত্র মোহাম্মদ, একই জেলার চকরিয়ার বানিয়াছড়ি গ্রামের নবী মিয়ার পুত্র জমির আলী, পাহাড়িকান্দা গ্রামের সালেহ আহমেদের পুত্র হানিফ, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার কাকাইয়াকান্দি গ্রামের জাকির হোসেনের পুত্র সালাউদ্দিন, আবদুল লতিফের পুত্র ইমান আলী, আকবর আলীর পুত্র আমির হামজা, আফাজ উদ্দিনের পুত্র বাবু, একই গ্রামের মাইনুদ্দিন, আলাউদ্দিন, গফুরনগর গ্রামের আকবর আলী, হাসনাবাদ গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের পুত্র বাবুল, নরসিংদীর পলাশের জসিম উদ্দিনের পুত্র মুন্না, জামালপুরের শিমরাইল উপজেলার কমলনগর গ্রামের ইউসুফ মোল্লার পুত্র শরীফ, নোয়াখালীর মাইজদীর সোনাপুর এলাকার মৃত আবুল কালামের পুত্র দুলালসহ অন্তত ৩০ জন। মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে পুলিশের ধারণা। নিহতদের মধ্যে ওয়াসিমের লাশ ব্যতীত অপর ৬ জনের লাশ তাদের স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। খবর শুনে রেলপথমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি মোঃ মুজিবুল হক ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি উপজেলার মিয়াবাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এলাকাবাসীর আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি বলেন, বোমা মেরে, মানুষ হত্যা করে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। তিনি আরও বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নির্দেশে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা এ নৃশংস ও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটিয়েছে। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সামছুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সেলিম, আলী হোসেন, নুরুল ইসলাম হাজারী, আবদুল বারেক, শাহজালাল মজুমদার, আক্তার হোসেন পাটোয়ারী, জিএম মীর হোসেন মীরু, রহমত উল্লাহ বাবুল, মিয়া মোঃ নিজাম, মাহবুব হোসেন মজুমদারসহ আওয়ামী লীগ-যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ। পরে রেলপথমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্থানীয় একটি হোটেলে পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। ওই বৈঠকে রেলপথমন্ত্রী যে কোন মূল্যে দুর্বৃত্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফখরুল ইসলাম পিপিএম, কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল, হাইওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোঃ রেজাউল করিম, কুমিল্লা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, র‌্যাব-১১’র উপ-পরিচালক লে. কমান্ডার গুলজার হোসেন, চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম চক্রবর্তী। এদিকে এ নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে স্থানীয় এলাকার হাজার হাজার জনতা মহাসড়কে নেমে আসে এবং বিক্ষোভ সমাবেশ করে। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম চক্রবর্তী বলেন, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তদন্ত ও আসামিদের গ্রেফতারের স্বার্থে এ বিষয়ে আর কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করতে যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে বলেও তিনি জানিয়েছেন। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, এ নাশকতার ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ গোলামুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা হলেনÑ কুমিল্লার সহকারী পুলিশ সুপার সদর এ সার্কেল জাহাঙ্গীর আলম ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবময় দেওয়ান। তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে এবং আহত প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করে দেয়া হবে। পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী জানান, দুর্বৃত্তদের সম্পর্কে তথ্য প্রদান ও তাদের গ্রেফতারে সহযোগিতাকারীকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছি। এক্ষেত্রে নাম-পরিচয় গোপন রাখা হবে। দুর্বৃত্তদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত। নিহতদের পরিবারকে সহায়তা ॥ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোলবোমা হামলায় ৭জন নিহতের ঘটনায় নিহত পরিবারকে ১০ হাজার এবং আহতদের ৫ হাজার টাকা করে সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোঃ হাসানুজ্জামান কল্লোল বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বিরোধীদলীয় নেতার শোক ॥ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এমপি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বাসে পেট্রোলবোমার আঘাতে নিহতদের প্রতি গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দুষ্কৃতকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তির দাবিও জানিয়েছেন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, রাজনৈতিক দাবি আদায়ের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হরতাল-অবরোধ এখন আতঙ্ক ও দুর্ভোগের আরেক নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী পালনের নামে গাড়িতে আগুন দিয়ে নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। মানবিকতা যেন আজ পেট্রোলবোমায় পুড়ছে। বিরোধীদলীয় নেতা নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
×