ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হেমন্তর গোলে বাংলাদেশে বসন্তের উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

হেমন্তর গোলে বাংলাদেশে বসন্তের উৎসব

রুমেল খান ॥ শেষ চারে নাম লেখাতে প্রয়োজন ছিল অন্তত ড্র। কিন্তু ড্র নয়, গৌরবের সঙ্গে জিতেই বহু কাক্সিক্ষত সেমিফাইনালে উঠেছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। চলমান আন্তর্জাতিক ফুটবল আসর ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ’-এ গ্রুপ ‘এ’র শেষ ম্যাচ ছিল সোমবার। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ এ ম্যাচে ১৬৫ ফিফা র‌্যাঙ্কিংধারী বাংলাদেশ ১-০ গোলে হারায় ১৭২ র‌্যাঙ্কিংধারী শ্রীলঙ্কাকে। দলের পক্ষে জয়সূচক ও মহামূল্যবান একমাত্র গোলটি করেন মিডফিল্ডার হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস। সেমিতে যেতে শ্রীলঙ্কার জয় ছাড়া কোন বিকল্প ছিল না। কিন্তু জয় তো দূরে থাক, ম্যাচে সমতায় ফিরতে যে পেনাল্টি পেয়েছিল, তাও গোলে পরিণত করতে ব্যর্থ হয় তারা! বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম ম্যাচের আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সেমিতে যেতে না পারলে অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন তিনি। কিন্তু রাবণের দ্বীপদেশ লঙ্কাকে হারিয়ে লক্ষ্য পূরণ করায় তা আর করতে হলো না এই মিডফিল্ডারকে। লঙ্কাকে হারানোর পর আরেকটি চমকপ্রদ পরিসংখ্যানও জানা গেছে। তা হলো, এই মাঠে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল দীর্ঘ চার বছর পর কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়ের দেখা পেল। সর্বশেষ ২০১১ সালে এ মাঠে আরব দেশ লেবাননকে ২-০ গোলে পরাভূত করেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। সেটা ছিল ফিফা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের খেলা। সোমবারের জয়ে ‘এ’ গ্রুপের রানার্সআপ হলো স্বাগতিক বাংলাদেশ। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন মালয়েশিয়ার কাছে প্রথম ম্যাচে ০-১ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। মালয়েশিয়ার কাছে হেরেছিল শ্রীলঙ্কাও (০-২)। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামেই আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেমিতে খেলবে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ হবে ‘বি’ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন। তবে সেটা কোন্ দল- তা নির্ধারিত হবে থাইল্যান্ড, বাহরাইন ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে যে কোন একটি দল থেকে। ‘আমাদের দেশে ফুটবলটা এমনই- জিতলে সব হালাল, আর হারলেই সব হারাম! শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে হালাল করতে চাই।’ রবিবার ম্যাচ-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই এমনটা বলেছিলেন মামুনুল। সোমবার ম্যাচে জয়ের পর কেমন ছিল মামুনুলের অভিব্যক্তি? কোন বাড়তি উচ্ছ্বাস নয়, রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজালে মামুনুল ধীরে ধীরে মুখে হাত দিয়ে মাঠে বসে পড়লেন। তাকে সান্ত¡না দিতে বুকে জড়িয়ে ধরছেন গোলদাতা হেমন্ত। দলের অন্য খেলোয়াড়রাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ওই মুহূর্তে যদি কেউ মাঠে ঢুকে এটা দেখতেন, তাহলে নির্ঘাত ধরে নিতেন, এই বুঝি হারের হতাশায় মুহ্যমান হলো বাংলাদেশ দল! এ পর্যন্ত বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ১৫ বার মুখোমুখি হলো। বাংলাদেশের জয় ১০টিতে। ৩টি ম্যাচ জিতেছে লঙ্কানরা। বাকি দুটি ম্যাচ ড্র হয়। উল্লেখ্য, একমাত্র বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কাই এ আসরে অংশ নিয়েছে জাতীয় দল হিসেবে। বাকিরা অংশ নিয়েছে যুব দল হিসেবে। এ ম্যাচে দুর্দান্ত খেলেন উইঙ্গার জাহিদ হোসেন। অনেকেই মন্তব্য করেন- ক্লাব পর্যায়ে পারিশ্রমিক সংক্রান্ত অপরাধের কারণে বাফুফে কর্তৃক এক বছরের নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় জেদ করে ভাল খেলেছেন তিনি। ১১ ও ২০ মিনিটে তার দুটি গোল প্রচেষ্টা অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়। ৩১ মিনিটে গোল করার সবচেয়ে সহজ সুযোগ নষ্ট করে বাংলাদেশ। রায়হানের লম্বা থ্রো থেকে সোহেল রানা যে শট নেন, তা জালে ঢোকার আগ মুহূর্তে কোন মতে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন লঙ্কান এক ডিফেন্ডার। তবে ৪০ মিনিটে ভাগ্যদেবী সহায় হন বাংলাদেশের প্রতি। বাঁ প্রান্ত থেকে জাহিদের ক্রস থেকে বল পেয়ে বুক দিয়ে বল নামিয়ে দেন এমিলি। সেই বল রিসিভ করে বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের দুর্দান্ত গড়ানো শটে লঙ্কান গোলরক্ষক সুজন পেরেরাকে পরাস্ত করেন হেমন্ত ভিনসেন্ট বিশ্বাস (১-০)। উল্লাসে ফেটে পড়ে গোটা বাংলাদেশ। মাঘের শীতে একরাশ হেমন্তের ছোঁয়া যেন এনে দেয় হেমন্তের এই গোলটি। দ্বিতীয়ার্ধেও একই আক্রমণাত্মক ছন্দে খেলে বাংলাদেশ। ৫৪ মিনিটে ডান প্রান্ত থেকে হেমন্তর শট আটকে দেন শ্রীলঙ্কার গোলরক্ষক সুজন। ৬০ মিনিটে বাঁ প্রান্ত থেকে সোহেল রানার বাড়িয়ে দেয়া বল বক্সের মধ্যে পেয়ে পোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন এমিলি। কিন্ত তার শট মিস হয়। ৬৭ মিনিটে বেঁচে যায় বাংলাদেশ। লঙ্কান বদলি মিডফিল্ডার সেনানায়ক বল নিয়ে ঢুকে পড়েন বাংলাদেশের ডি-বক্সে। পোস্ট ছেড়ে এগিয়ে তাকে ফাউল করেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেল। সঙ্গত কারণেই কাতারের রেফারি খামিস মোহাম্মদ পেনাল্টির নির্দেশ দেন। তবে মিডফিল্ডার এএএন রোশনের পেনাল্টি শট ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিরিয়ে দেন শহীদুল। ফিরতি বলে লাফিয়ে উঠে দীর্ঘদেহী রোশনে যে হেডটি নেন, তা খুব সহজেই লুফে নেন শহীদুল। আবারও উল্লাসে মাতোয়ারা হয় গোটা বাংলাদেশ। আগের ম্যাচে আরেক গোলরক্ষক রাসেল মাহমুদ লিটনের ভুলে গোল হজম করে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। সোমবারের ম্যাচে হতো কোচ ক্রুইফ সেই রাগ থেকেই খেলাননি লিটনকে। শহীদুলও যদি গোল খেতেন, তাহলে তিনিও বনে যেতেন লিটনের মতো খলনায়ক। কিন্তু পেনাল্টি রক্ষা করে খলনায়ক থেকে নায়কই বনে যান শহীদুল! ৮৫ মিনিটে হেমন্তর আরও একটি শট পোস্টের কাছ থেকে ডিফেন্ডার ইরাঙ্গা দৌড়ে এসে বল পাঠিয়ে দেন মাঠের বাইরে। রেফারি শেষ বাঁশি বাজালে জয়ের আনন্দ নিয়েই মাঠ ছাড়ে মামুনুলবাহিনী।
×