ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরেজমিন বগুড়া ॥ নাশকতাকারীরা জামিন পাচ্ছে, পৃষ্ঠপোষক সরকারপন্থী উকিলরা

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

সরেজমিন বগুড়া ॥ নাশকতাকারীরা জামিন পাচ্ছে, পৃষ্ঠপোষক সরকারপন্থী উকিলরা

রাজন ভট্টাচার্য/সমুদ্র হক ॥ রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে বগুড়ায় একাট্টা হয়ে নাশকতা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী। কৌশল পরিবর্তন করে একের পর এক ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ে মেতে উঠেছে তারা। সড়ক ও রেল যোগাযোগ অচল, সহিংস তা-ব চালিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি ও হত্যার মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায় এ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এক মাসে পেট্রোল অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক পণ্য ও যাত্রীবাহী পরিবহন। ১০টির বেশি পয়েন্টে চলছে নাশকতা। দুইজন ট্রাকচালকসহ আহত প্রায় শতাধিক মানুষ। নানা অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। নাশকতাকারীদের পক্ষ নিয়ে আদালতে লড়ছেন সরকারপন্থী আইনজীবীরাও! গত ৬ জানুয়ারি থেকে এক ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৭ দিনে বগুড়ায় সন্ত্রাসী ও নাশকতায় ৪৭টি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয় অন্তত ৩৬টি গাড়িতে। যার ৩২টিই পণ্যবাহী ট্রাক। ভাংচুর করা হয়েছে দুই শতাধিক যানবাহন। বগুড়া শহরতলির সাবগ্রাম এলাকায় রেলপথের ৫শ’রও বেশি স্প্যান্ডেল ক্লিপ খুলে নাশকতা করা হয়। এ পর্যন্ত শহর ও আশপাশের এলাকায় খইয়ের মতো ককটেল ও বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে অন্তত ৬শ’। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে এ পর্যন্ত নাশকতা ও সন্ত্রাসীর মামলা দায়ের করা হয়েছে ২৭টি। এতগুলো ঘটনায় কম মামলার বিষয়ে ওই সূত্র জানায় একই দিনে যে কয়টি গাড়ি পুড়েছে ও ভাংচুর হয়েছে তার জন্য একটি করেই মামলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার অভিযুক্তরা একই ব্যক্তি। রবিবার ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৫শ’ ২৭ জন। যার মধ্যে বিএনপির নেতা ও কর্মী ৪শ’ ৩০ জন, জামায়াতের ৬৪ জন। যেখানে আতঙ্ক-আর নাশকতা ॥ গত কয়েক দিনের অবরোধ ও হরতালে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে বগুড়া-রংপুর, বগুড়া-নাটোর, বগুড়া-ঢাকা মহাসড়ক এবং প্রথম বাইপাস সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে। রাতে এসব সড়ক সন্ত্রসী ও নাশকতাকারীদের চোরাগোপ্তা হামলার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। পুলিশ পয়েন্ট ও টহল পুলিশের গতিবিধি লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গেরিলা কায়দায় হামলা চালায়। কখনও পুলিশের ওপর ককটেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ পাল্টা গুলি করলে পালিয়ে যায়। এর মধ্যে দিনের বেলায়ও তারা ট্রাকে আগুন লাগায়। যেমন রবিবার সকালে ও দুপুরে তিন দফায় শহরতলির এরুলিয়া ভবেরবাজর এলাকায় ৩টি ট্রাকে আগুন লাগান হয়। এর আগে প্রথম বাইপাস সড়কের বনানী, ছিলিমপুর, চারমাথা, বারোপুর, মাটিডালির মোড় বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের নওদাপাড়া, ঠেঙ্গামারা, বাঘোপাড়া, গোকুল, মহাস্থান এলাকায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটারজুড়ে বিএনপি জামায়াত-শিবিরেরকর্মী ক্যাডাররা কখনও গাছের গুঁড়ি ফেলে টায়ারে আগুন লাগিয়ে পথ রোধ করে। এরপর সময় বুঝে যানবাহন ভাংচুর অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের নাশকতা করতে থাকে। সহিংসতা যাদের প্রাণ কেড়েছে ॥ সারাদেশের ন্যায় বগুড়াতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হামলা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। গত কয়েকদিনে মহাসড়কের পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে ও ইটের আঘাতে দুই ট্রাকচালক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। নুনগোলার বারোপুর এলাকায় এক ফার্নিচার ব্যবসায়ী সাজু ট্রাক ভাড়া করে মালামাল নিয়ে নড়াইলের উদ্দেশে রওনা দেয়। নিশিন্দারা এলাকায় পৌঁছুলে সন্ত্রাসীরা পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করলে ট্রাকচালক টিটেন মিয়া, হেলপার আব্দুর রহিম ও সাজু মারাত্মক দগ্ধ হলে পরের দুইজনকে ঢাকায় পাঠানোর হয়। বার্ন ইউনিটে মারা যান আব্দুর রহিম (৪২)। এর আগে ইটের আঘাতে আহত শিবগঞ্জের মাঝিপাড়ার সোবহান (৪৫) ঢাকায় মারা যান। এ পর্যন্ত যে সব ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তার বেশিরভাগই ছিল পণ্য বোঝাই। আলু, চিনি, সুজি, চাল ও সবজিসহ নিত্যপণ্যের ট্রাকগুলোর ওপরই টার্গেট করা হয়। জামিনে মুক্তি পাচ্ছে হামলাকারীরা ॥ এ পর্যন্ত নাশকতার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াতের যত নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তার বড় একটি অংশ ছাড়াও পেয়েছে। তাছাড়া যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের মধ্যে প্রথম সারির কোন নেতা নেই। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। সবার প্রশ্ন একটাই নাশকতাকারীরা ফের ভয়ঙ্কর কোন ঘটনা ঘটাতে পারে। জানা গেছে, বিস্ফোরণ মামলায় নিশিন্দারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর বিএনপির সহ-সভাপতি শহীদুল ইসলাম সরকারকে গ্রেফতারের পর তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন। তার জামিনের পক্ষে আদালতে লড়েন আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবী। আবার জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অভিযুক্ত করে মামলায় তাদের আগাম জামিন পেতে সহযোগিতা করেণ আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবী পরিষদের নেতা। এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। মামলা দায়ের করার পর অনেক অভিযুক্ত জামিনে বের হয়ে আসে। এ বিষয়ে একজন আইনজীবী বললেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তের তালিকা এক ও অভিন্ন। অনেক মামলায় অভিযুক্তের নাম ঠিকানা ও বিবরণ দেয়া হলেও আরেকটি মামলায় সংক্ষিপ্ত নাম দেয়া হয়। অনেক সময় ঠিকানাও এদিক-ওদিক করা হয়। অভিযুক্তরা কে কি করছেন তাও বলা হয় না। বাবার নাম বাড়ির ঠিকানাও ভুল থাকে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মামলার জব্দের কোন তালিকা থাকে না। ফলে অভিযুক্তরা সহজেই জামিন পেয়ে পুনরায় নাশকতায় মেতে ওঠে। বাস মালিক সমিতির সদস্য হায়দার আলী জানান যাত্রীদের অসহায়ের কথা বিবেচনায় এনে এবং নিজের ও শ্রমিকদের দিকে তাকিয়ে ঝুঁকি নিয়েই গাড়ি বের করতে হচ্ছে। ট্রাকচালক মনির ও আব্দুল হামিদ বললেন, ‘শ্রমিকদের বসে থাকলে তো আর চলে না। পেটের দায়ে বের হতেই হয়। কি হবে তা ওপরওয়ালার ওপর ছেড়ে দিয়েই পথে নামি।’
×