ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শামসুল আরেফিন খান

মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না?

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না?

এ কোন্ গণতন্ত্র? যাতে মানুষ মারার মন্ত্র আছে, জোর করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র আছে! এ কোন্ গণতন্ত্র যাতে ফিনভূমির দ্বিতীয় মহাসমরের মারণাস্ত্র মলোটভ ককটেল দিয়ে সামরিক লক্ষ্যভেদ না করে বঙ্গমাতার জঠরে বেড়ে ওঠা মানবভ্রƒণ হত্যার হুকুম আছে? মায়ের কোলে নিষ্পাপ শিশুকে অঙ্গার করার অনুমোদন আছে? এমন সুশীল গণতন্ত্রের কথা কি বাপ-দাদার আমলে কেউ কখনও শুনেছে? এমন গণতন্ত্রের কথা কি কখনও ভেবেছিলেন গণতন্ত্রের পিতৃপুরুষ সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লুটো, ভলতেয়ার, রুশো, মন্টেস্কু, ওয়াশিংটন অথবা জেফারসন কিংবা আব্রাহাম লিঙ্কন? মহাত্মা গান্ধীর কথা নাই বা তুললাম! সে কথা আমার জানা নেই। তবে সে অজ্ঞতায় আমি মোটেও লজ্জিত নই। কারণ যারা গণতন্ত্রের ফুলের বাগানে মোষ চরাচ্ছে তারা বোধকরি এসব মহাপুরুষের নামই শোনেনি। তাতে তাদেরও কোন দোষ দেখি না। আমার এক ভাগ্নে এখন যুক্তরাষ্ট্রে নেভির যন্ত্র প্রকৌশলী। অবসর সময় সে ধর্মসেবায় নিবেদিত থাকে। আর বাড়তি পুণ্যের আশায় রাত করে উপাসনালয়ের কার্পেট পরিষ্কার করে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকে সব বিজ্ঞান বিষয়ে লেটার মার্ক ছিল। আমার তালেবানী দুলাভাই দ্বারা নির্যাতিত বোনের খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে ডাক্তার হবে। কিন্তু সত্তর দশকের মেধাবী ছাত্র মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাস না করায় সে আশা অধরা রইল। বাছাধনের সেই ফেল করার গল্পটা না বলতে পারলে আমার পেটের ভাত হজম হবে না। কপাল মন্দ! মৌখিক পরীক্ষায় একজন বোর্ড সদস্য প্রশ্ন করে বসলেন- আচ্ছা বলেন তো ‘চারচিল’ কে ছিলেন? আমার গুণধর ভাগ্নে উত্তর খুঁজে পেল না। সে জানত শুধু একচিলের দু’পা, চারচিলেরও দু’পা। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল- ‘তাতো জানিনে স্যার। ওটাতো আমার সিলেবাসে ছিল না!’ এই যখন শিক্ষার অবস্থা তখন অশিক্ষার কী দোষ? শিক্ষক পড়াচ্ছেন- ‘কপাল ভিজিয়া গেল নয়নের জলে...।’ ক্লাসের একজন চতুর সেনাপতির ছেলে হাত তুলে উঠে দাঁড়াল- স্যার, নয়ন মানে কী? স্যার বললেন ‘চক্ষু’। ছাত্র শিক্ষকের কপাল বরাবর এক জব্বর প্রশ্ন মারল ছুড়েÑ স্যার তা হইলে কপাল ক্যামনে ভিজল চক্ষের জলে? শিক্ষক বললেনÑ ‘ঠ্যাং দুটো বাঁধা ছিল তমালের ডালে!’ কপাল আর ‘কপোলে’ তালগোল পাকানো সেই মেধাবী ছাত্রই এখন ডিজিটাল হুকুম দিয়ে স্কুল-কলেজে পড়া পৌনে পাঁচ কোটি সোনার ছেলেমেয়েকে ঠ্যাং বেঁধে হরতালের দড়ি দিয়ে অবরোধের ডালে বেঁধে রেখেছে! মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পনেরো লাখ শিশুর বিমূর্ত স্বপ্নের সিলেবাসে রাক্ষস-খোক্ষসের গল্প ঢুকিয়ে দিয়েছে। ভাড়াটে সুশীলরা বেনামে-স্বনামে শাহনামা লিখে তাকে মহান গ্রন্থকার দার্শনিক বানিয়েছে। এখন সেই বিরল গ্রন্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় ঢুকাতে হলে ড. এমাজউদ্দিনকেই আবার ভাইস চ্যান্সেলর বানাতে হবে। ড. ওসমান গনিকে তো না ফেরার দেশ থেকে ‘রবীন্দ্র তরিকায়’ প্লানচেট করে ফিরিয়ে আনা যাবে না। সে কারণেই হোক আর নিজ মেধা গুণেই হোক গুণধর পুত্রের বিদূষী মা ‘ষড়যন্ত্রের’ সঙ্গে তাই গণতন্ত্রকে গুলিয়ে ফেলছেন। গ্রামের নিরক্ষর কৃষক, বকলম দিনমজুর, বাসচালক, হেলপার, রাস্তার ফুটপাথের দোকানদারও আমারই মতো ভাবছে- এ কোন্ গণতান্ত্রিক রাজনীতি, যা গণলোকের সাংবিধানিক অধিকার, চলাফেরার অধিকার, কাজে যাওয়ার অধিকার, বাড়ি ফেরার অধিকার কেড়ে নেয়? ফসলের মাঠে বুনোহাতি ছেড়ে দিয়ে কিষানীর বাড়া ভাতে ছাই দেয়? চৌদ্দ-পনেরো লাখ শিশুর সুখ স্বপ্ন আর আশার লাল টুকটুকে পেয়ারাটা কেড়ে নিতে পাগলা কুকুর লেলিয়ে দেয়? নববধূর মেহেদী পরা হাতে পোড়া রক্ত মাখিয়ে দেয়? আমি তাও জানি না। কিন্তু সে কথা জানতে আমি ড. নিউম্যান ও ড. জি ডব্লিউ চৌধুরীর সেই শিষ্যদের দারস্থ হতে চাই না। তাদের আমি চিনি আধা শত বছর ধরে। যারা বিবেক বিক্রি করে বিদেশ থেকে পা-িত্যের দামী সনদ কিনে এনেছে তাদের কাছে আমি যাব না। তার চাইতে বরং লিভার বেঁচে যে বাবা ছেলেকে প-িত বানিয়েছেন, বাড়ি বাড়ি ভাত রেঁধে যে মা ছেলের বই কিনেছেন, তাঁকে খুঁজব জ্ঞান লাভের জন্য। আমি যাব না ড. এমএন হুদা, ড. হাসান জামান, ড. বজ্জাত হোসেন ও ডক্টর ওসমান গনির দোসরদের কাছে। কারণ আসলদের আমরা একাত্তরে রক্তে ভেজা বিজয় ছিনিয়ে এনে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিলাম। তারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে নেয়ার জন্য ঠিক এখনকার টক শো প-িতদের মতোই তরফদারি করেছিল। নিজামী-মুজাহিদ-কামারুজ্জামান-মীর কাশেমদের ছুরি শান দিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছিল। তার চেয়ে আমি যেমন আছি তেমন মূর্খই রবো। আমি ডাক্তার বি চৌধুরীর কাছেও যাব না, আজীবন তাঁকে সজ্জন ভেবেছি। পূজ্য ভেবেছি। তিনি বিনা দর্শনীতে আরও অনেকের মতো আমাকেও হৃদরোগের চিকিৎসা দিয়েছেন। সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তবুও জ্ঞানের দৈন্য দূর করতে তাঁর কাছে যাব না। কারণ তিনি ন্যায়নীতি ও মানবিক মূল্যবোধই শুধু খোয়াননি, নিজের হার্টটাও হারিয়ে ফেলেছেন অন্যের হৃদরোগ ভাল করতে গিয়ে! বোধহয় আলঝাইমার যাকে মার্কিনীরা বলে অলসাইমার; সেই স্মৃতিভ্রম ও মতিভ্রম রোগেও ভুগছেন। নইলে আবার বুনো মধু খাওয়ার লোভে তিনি ‘ঐতিহাসিক রেল দৌড়ের’ কথাটা অন্তত বিস্মৃত হতেন না। তবে তিনি যদি সম্বিত ফিরে পান আর যারা পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ পোড়াচ্ছে জাতির অর্থনীতি ছারখার করছে, খুনী ইয়াহিয়ার দোসর বলে তাদের চিনতে পারেন, উপযুক্ত বিশেষণ দিয়ে তাদের গালমন্দ করেনÑ তাহলে বিকল্পধারার শূন্য গোয়ালে ধোঁয়া দেয়ার কাজে ভাড়া খাটতেও রাজি আছি। বেকারত্ব বড় বালাই। পেট্রোলবোমা মেরে তাঁর পুরনো সাথীরা যে হাজার হাজার কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ আর জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন পুড়িয়ে দিচ্ছে সে জন্য তিনি যদি এতটুকু মর্মবেদনা অনুভব করতেন তাহলে আমি তাঁর পুরনো বুকের ব্যথার কবিরাজি চিকিৎসা বাতলে দিতাম। তিনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি আমি তাঁকে হাঁটুর ব্যথার কবিরাজি দাওয়াই খুঁজে দিয়েছিলাম এই ‘জনকণ্ঠে’ লেখা ‘বি চৌধুরী ভাল নেই, মাহির কোন ভয় নেই’ শীর্ষক নিবন্ধে। তিনি সেটা পড়ে প্রীত হয়েছিলেন। নিজেই সে কথা বলেছেন। এবারেও আমার কাছে হৃদয় জ্বালাপোড়ার মোক্ষম দাওয়াইয়ের সন্ধান আছে। মার্কিন মুল্লুকের বদ্যি-কবিরাজরা অনেক তেলেসমাতি জানেন। তবে শেষবিচারে আমি তাঁকে দুষব না। বড় কোরবানি ছাড়া বুকের সব ব্যথা যায় না। লাইসেন্সের মালিক তিনি। অথচ বন্দুক-গুলি-বোমার ওপর তাঁর কোন খবরদারি নেই! রিমোট ভাতিজার হাতে। ছোটবেলার আরেকটা গল্প না বলে পারছি না। গত শতকের ৪৮ সালে ঢাকার গাছে গাছে বাঁদর ঝুলত। ঘরের হেঁসেল থেকে ভাতের হাঁড়ি হাইজ্যাক করে গাছের ডালে বসে পেট ভরাত। একদিন এক বাঁদরের একটা বাচ্চা কে যেন আটকে ফেলেছিল। অমনি সেই বাঁদর মা গেরস্তের ঘরে ঢুকে দোলনা থেকে এক ছোট্ট শিশুকে তুলে নিয়ে গাছের মগডালে চড়ে নির্বিকার বসে থাকল। সন্তানের বাবা বন্দুক তাক করে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন। পুলিশ ইপিআর এ্যাটেনশন পজিশনে। কারও কিছু করার নেই। শিশুর জীবন-মরণ ওই বাঁদর মার হাতে! অবস্থা বড়ই বেগতিক! কিন্তু সব কিছুর তো একটা সীমা আছে। সুশীলরা গলা নরম করেছেন। কিন্তু দেশনেত্রীর মন নরম হয় না। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হাতজোড় করে বলেছিলেন, আল্লার ওয়াস্তে দেশ পোড়ানো বন্ধ করুন দেশনেত্রী। এখন তিনিই বলছেন, দেশের সরকারকে দেশ ও দেশের ভবিষ্যত বাঁচাবার জন্য নির্দয়ভাবে শক্তিপ্রয়োগ করতে হয়। এখনই সে সময়। বিজিবি প্রধান তাঁর সমস্ত রিজার্ভ তলব করেছেন। এরকম দুঃসময়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি ‘কলসির কানার’ জখম ভুলে চোখের সামনে রক্তে ভেসে বিদায় নেয়া প্রয়াত রাষ্ট্রপতির বিধবার পাশে দাঁড়িয়েছেন। মানবতা বলে কথা! ডাক্তার সাহেব বলছেন, সংলাপ ছাড়া কোন উপায় নেই। আমিও তাই বলি। সেই সঙ্গে এও বলি- স্যার, সে দিন হয়েছে বাসি! লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
×