ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বজনদের কাছে ১১ লাশ হস্তান্তর ॥ দুই লাশ মর্গে

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

স্বজনদের কাছে ১১ লাশ হস্তান্তর ॥ দুই লাশ মর্গে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মরদেহ একটি, দাবিদার দু’জন। তাই কাউকেই দেয়া হয়নি। বাকি এগারোজনের মরদেহ শনাক্ত করেন স্বজনরাই। একজন অশনাক্ত। এ কারণে দুটো মরদেহ পড়ে আছে মর্গে। এভাবেই মিরপুরের আগুনে পোড়া তেরোজনের মরদেহের ফয়সালা করা হয়। রবিবার বিকেলে এগারোটি মরদেহই হস্তান্তর করা হয় স্বজনদের কাছে। রাজধানীর মিরপুরে এ্যাপকো প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহতদের ১৩ জনের মরদেহ সম্পর্কে হাসপাতাল সূত্র জানায়, বাকি দুটি মরদেহও শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, এ্যাপকোর মালিকের সীমাহীন গাফিলতি ও উদাসীনতার দরুনই শনিবার সন্ধ্যায় এ ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলের পারিপার্শ্বিকতার চিত্র বিশ্লেষণ করে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগুন লাগতে পারে এমন সব দাহ্য উপাদানের কমতি ছিল না ভবনটিতে। এ ধরনের দাহ্য বস্তুর ছড়াছড়ি থাকলে যতটা সতর্কতা ও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবস্থা থাকা জরুরী, সেটা তো ছিলই না। বরং আবাসিক এলাকায় এ জাতীয় কারখানায় বয়লার ও গ্যাস সিলিন্ডার রেখে আশপাশের বাসিন্দাদেরও নিরাপত্তা হুমকির মুখে রাখা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে দেখা যায়, দুটো ছাড়া বাকি সব মরদেহই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। তাঁরা হলেনÑ বিল্লাল হোসেন (১৯), খোকন মিয়া (২৫), বাদশা মিয়া, মোকলেসুর রহমান বাচ্চু (৩৬), মুকুল মিয়া (২২), তাজবির হাবিব (২৯), ফাতেমা হোসেন ইশিতা (২৮), শবনম পারভিন ইতি (২৭), ওয়াজি উল্লাহ (৩৬), রাসিয়া বেগম (৩৫) ও মন্টু মিয়া (২৯)। বাকি দুটো মরদেহের একটি রাতেও শনাক্তের চেষ্টা চলছিল । এদিকে অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় মর্গের সামনে একটি দফতর খুলেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর। ওই দফতর থেকে ১১ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ওই অগ্নিকা- স্থল থেকে ১১ জনের লাশ ও অগ্নিদগ্ধ দুটি দেহের খ-াংশ নেয়া হয়েছিল মর্গে। দুটি খ-াংশ কি একজনের, না কি দুজনের, তা নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। অগ্নিকা-ে আহত একজন পঙ্গু হাসপাতালে এবং তিনজন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন আহত ব্যক্তিরা হলেনÑ কারখানার নিরাপত্তা তত্ত্বাবধায়ক তৌহিদুল ইসলাম (৫০), নিরাপত্তাকর্মী কামাল হোসেন (৩৫) ও কারখানার শ্রমিক রবিউল ইসলাম (৩৫)। আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে লাশ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেনÑ কারখানার মালিকের ব্যবসায়িক অংশীদার তাসবীর হাবিব (৩০), হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়া (৪৫) ও পিয়ন রাশিয়া বেগম (৫০)। এদিকে আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, কারখানার মালিকের সীমাহীন উদাসীনতা ও গাফিলতিই এ জন্য দায়ী। কারখানাটির মালিকের নাম আনিসুজ্জামান খান। ওই কারখানায় বয়লার, গ্যাস সিলিন্ডারসহ দাহ্য পদার্থ ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান সাংবাদিকদের বলেন, মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন ধরার পর বয়লার বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে তা ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ভেতরে দাহ্য পদার্থ বেশি থাকার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্লাস্টিকের গৃহস্থালি বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির ওই কারখানায় অনেক গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। বিস্ফোরিত গ্যাস সিলিন্ডারও সেখানে দেখা গেছে। এ সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস সূত্র আরও জানায়, এ জাতীয় দাহ্য পদার্থ যেখানে রাখা হয়, সেখানে যদি একই সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার মেশিন থাকে সেটা খুবই বিপজ্জনক। এটা জেনেও ওই কারখানায় নেয়া হয়নি কোন সতর্কতা ও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা। এটা মূলত কারখানা মালিকের চরম উদাসীনতা ও গাফিলতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ গাফিলতি শাস্তিযোগ্য। সরেজমিনে দেখা যায়, এ্যাপকো বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের চারতলা ভবনের কারখানাটি মিরপুর ১ নম্বরে সনি সিনেমা হলের বিপরীত পাশে অবস্থিত। কারখানাটিতে প্লাস্টিক ও ফোমের মিশ্রণে একবার ব্যবহারোপযোগী খাবারের প্যাকেট, গ্লাস প্লেটসহ বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তৈরি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জাহিদ হাসান রবিবার জনকণ্ঠকে বলেন, শনিবার পাঁচটার দিকে কারখানাটির নিচতলায় বিকট শব্দে দুটি বিস্ফোরণ হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুন আর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো ভবন। ওই সময় ভবনে থাকা লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। কেউ ভবন থেকে দৌড়ে বের হয়ে কেউ ছাদে উঠে পাশের সংযুক্ত ভবনের ছাদে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। ঘটনার পর আশপাশের ভবন ও বাসাবাড়িতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিচে নেমে যান। ঘটনাস্থলে কারখানাটির মেশিন অপারেটর মোঃ মামুন বলেন, ‘আমি চারতলায় চেয়ারে বসা ছিলাম। হঠাৎ জোরে দুটো শব্দ হয়। কয়েক সেকেন্ড পর দেখলাম, নিচ থেকে আগুন আর ধোঁয়া ওপরের দিকে আসছে। আমি তাড়াতাড়ি ছাদে যাই। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফ দিয়ে বের হয়ে যাই। মামুন জানান, কারখানায় সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দুই পালায় কাজ চলে। পণ্য উৎপাদন, হিসাবরক্ষণ ও বিপণনের কাজ চলে এই ভবনে। শনিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া পালায় ২২ পুরুষ ও ১০ নারী কর্মরত ছিলেন। শনিবার সাভার থেকে পিকআপ ভ্যানে করে ভবনের নিচতলায় কাঁচামাল আনা হয়। পিকআপ ভ্যানটির সহযোগী মোঃ সজীব বলেন, কাঁচামাল নামানোর পর গাড়ি বের করার সময় হঠাৎ দুটি বিস্ফোরণ ঘটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন ধেয়ে এসে তাঁদের গাড়িতে লাগে। তিনি ও চালক দৌড়ে ভবন থেকে বের হয়ে আসেন। দেখেন, আগুনে দগ্ধ হয়ে বের হয়ে আসছেন দুই নিরাপত্তাকর্মীসহ তিনজন। এর আগে শনিবার রাতে শাহ আলী থানার পুলিশ ১৩টি লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। স্বজনরা লাশগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সারারাত শনাক্তের চেষ্টা চালায়। তারপর দুপুরের মধ্যে ১১টি মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জনকণ্ঠকে জানান, আবাসিক এলাকায় ঘিঞ্জি পরিবেশের এ কারখানার নিচতলায় বয়লার ছাড়াও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ডেও আগুন লাগে। পরে বিস্ফোরিত গ্যাস সিলিন্ডারও সেখানে দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক মোবারক হোসেন ভবন ঘুরে বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় পুড়ে যাওয়া লাশ পাওয়া গেছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় অফিস ও স্টাফ কোয়ার্টার ছাড়াও প্লাস্টিকের সামগ্রী ছিল। কারখানায় ‘ওয়ান টাইম’ পানির গ্লাস ও খাবার প্যাকেট তৈরি হতো। ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক মেজর শাকিল নেওয়াজ জানান, কারখানায় প্লাস্টিক পণ্য তৈরি হতো। ‘হাইড্রোজেন সায়ানাইট’র মতো দাহ্য পদার্থ এবং মাল্টি হ্যাজার্ড জিনিসপত্র থাকায় মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাজ করতে হয়েছে।
×