ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিটি প্রকল্পই বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে ঝিমিয়ে পড়ছে ;###;প্রতিবছর একটু একটু করে সময় বৃদ্ধি করা হয় ;###;বিশটির মধ্যে উনিশটির অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি

কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র ॥ গতি নেই নির্মাণে

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

কয়লা বিদ্যুত কেন্দ্র ॥ গতি নেই নির্মাণে

রশিদ মামুন ॥ বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের মধ্যে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি একটি কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। দুই দেশের সরকার থেকে রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (এনটিপিসি) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডে (পিডিবি) গড়াতে লেগে যায় আরও আট মাস সময়। ওই বছর এনটিপিসি এবং পিডিবির মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য এমওইউ স্বাক্ষর হয়। বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ করার জন্য ওই বছর অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর এনটিপিসির সঙ্গে আরও একটি চুক্তি হয়। এর পরের বছর ২০১১ তে ২৫ মে বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য সাইট ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায় সরকারের কাছ থেকে। ওই বছর ৩১ ডিসেম্বর বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় এনটিপিসি। যথাক্রমে যৌথমূলধনী কোম্পানি গঠন চুক্তি, কোম্পানি গঠন হয় ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি এবং ওই বছরের ৩১ অক্টোবর। প্রথম বোর্ডসভা হয় ২০১৩-এর ৩১ জানুয়ারি। ওই বছর এপ্রিলে গুরুত্বপূর্ণ আরও দুটি চুক্তি হয়। এর একটি হচ্ছে বিদ্যুত ক্রয় চুক্তি অন্যটি বিদ্যুত কেন্দ্র বাস্তবায়ন চুক্তি। উদ্যোগ গ্রহণের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে দরপত্র যেমন আহ্বান করা হয়নি, তেমনি অর্থায়নও নিশ্চিত হয়নি। এই হচ্ছে যৌথ বিনিয়োগে দেশের কয়লাচালিত বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের বাস্তবায়ন অগ্রগতির চিত্র। অন্যদিকে ২০১১ তে ওরিয়ন খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড খুলনা এবং ঢাকার মাওয়াতে দুটি বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ পায়। এরপরের বছর ২০১২-এর ২৭ জুনে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য চুক্তি করে পিডিবি। বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে ২৫ মে ২০১৪ তে পরিবেশ অধিদফতরে জমা দেয়া হয় ছাড়পত্রর জন্য। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ছাড়পত্র না মেলায় বিদ্যুত কেন্দ্রটির অর্থায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নকারীরা পরিবেশগত ছাড়পত্র থাকার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। এভাবে যৌথ উদ্যোগ, আইপিপি এবং সরকারী মিলিয়ে ২০টি বিদ্যুত প্রকল্পর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে একটি মাত্র বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়নেরর নিশ্চিয়তা দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন (জাইকা)। অন্য ১৯টির অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। ফলে ১৭ হাজার ৬৮৮ মেগাওয়াটের কয়লা চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে ঝিমিয়ে পড়েছে। প্রত্যেক বছর বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদনে আসার সময়সীমা একটু একটু করে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। শুরুতে বলা হয়েছিল, রামপাল এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে ২০১৫ সালে। এখন বলা হচ্ছে প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসবে ২০১৮ সালে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, এই সময়সীমাও মেনে চলা সম্ভব হবে না। এখনও কোন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার, যৌথমূলধনী কোম্পানি কিংবা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান চুক্তি করতে পারেনি। ২০টি বিদ্যুত প্রকল্পের মধ্যে মাত্র তিনটির সঙ্গে পিডিবি বিদ্যুত ক্রয় চুক্তি করতে পেরেছে। অন্যগুলোর সঙ্গে সেই চুক্তিও হয়নি। বেসরকারী সাতটি বিদ্যুত কেন্দ্রের সঙ্গে বার বার চুক্তির তাগাদা দিলেও চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। চুক্তি করার জন্য বেসরকারী কোম্পানিগুলোকে সময় বেঁধে দেয়ার পরও তারা আরও সময় চেয়ে আবেদন করছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দেশীয় সরকারী সংস্থার ছয়টি বড় বিদ্যুত প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। সব বিদ্যুত কেন্দ্রের ক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো থেকে মোট সাত হাজার ৯২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যাবে। বিদ্যুত প্রকল্পের মধ্যে প্রথম উদ্যোগ নেয়া রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য একটি বাস্তবায়ন রোডম্যাপ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ওই বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক অগ্রগতি বৈঠকে জানানো হয়েছে, বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য দরপত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য কয়লা পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরিবেশ পরামর্শকের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মহেশখালিতে তেনেগা বারহেড মালয়েশিয়া এবং পিডিবি যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য একটি এমওইউ করেছে। গত ডিসেম্বরে বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য যৌথমূলধনী কোম্পানি গঠনের নির্দেশ দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। চায়না হুদিয়ান হংকং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গ পিডিবি আরও একটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্রের এমওইউ করেছে। এর যৌথমূলধনী কোম্পানির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়া গেছে। সরকার আগামী চার মাসের মধ্যে বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ শেষ করার সময় বেঁধে দিয়েছে। এজন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগকে অবহিত করেছে পিডিবি। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের দুটি রাষ্ট্রীয় কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আরও দুটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোরিয়ান কেপকোর সঙ্গে এমওইউ-এর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পিডিবি থেকে বিদ্যুত বিভাগকে জানানো হয়েছে, কেপকোতে খসড়া এমওইউ পাঠানো হয়েছে। এমওইউ-এর উপর উভয় পক্ষের মতামত চূড়ান্ত করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও এমওইউ-এর উপর মতামত পাওয়া গেছে। তবে কবে নাগাদ এই এমওইউ স্বাক্ষর হবে তা চূড়ান্ত হয়নি। পটুয়াখালিতে নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট এ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) চুক্তি করছে। পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের কাছে বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোম্পানির নাম প্রস্তাব করা হবে ‘পায়রা কোল বেজড পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানি’। গত বছর ১৯ মার্চ ঢাকায় কোম্পানি দুটি পটুয়াখালীতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করে। কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের মধ্যে সরকারী ছয়টি প্রকল্প রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন কোম্পানি এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের বাস্তবায়ন করবে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে নির্মাণ করবে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুত কেন্দ্র। বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য সম্প্রতি পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। মহেষখালীতে আরও একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে পিডিবি। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্প প্রস্তাবটি বিদ্যুত বিভাগে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটির পরামর্শক নিয়োগে কারিগরি এবং অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ গত মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছিল বিদ্যুত বিভাগ। ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি ইজিসিবি মুন্সীগঞ্জে ৬০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির প্রাক-সম্ভাব্যতা জরিপের কাজ শেষ হলেও এখনও সম্ভাব্যতা জরিপ শেষ হয়নি। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপ করার জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির জন্য বরগুনার আমতলীতে যায়গা চেয়েছে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি। দিনাজপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের সুপার থার্মাল বিদ্যুত কেন্দ্র এবং বড়পুকুরিয়াতে বিদ্যমান কেন্দ্রের ৩য় ইউনিট হিসেবে আরও একটি ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র করা হবে। বড় কেন্দ্রটির সম্ভাব্যতা জরিপের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার জন্য দরপ্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য কেন্দ্রটির প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বড় আইপিপি প্রকল্প রয়েছে আটটি। এছাড়া একটি বাণিজ্যিক বিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। বিএসআরএমএস চট্টগ্রামের মীরের সরাইতে ১৫০ মেগাওয়াটের ওই বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির লাইসেন্স জটিলতা সরকারকে অবহিত করেছে তারা। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যক্টরি একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায়। শুরুতে তারা ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব দিলেও এখন সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হচ্ছে তারা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়া বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করবে। খুলনা এবং ঢাকাতে ওরিয়নের দুই বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিবেশগত সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতর এখনও এ বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়নি। সূত্র বলছে, পরিবেশ অধিদফতরের নানান জিজ্ঞাসার উত্তর দিচ্ছে স্পন্সর কোম্পানি। পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার পরই অন্যকাজ শুরু হবে বলে খুলনা বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে জানান। তিনি বলেন, পরিবেশগত সমীক্ষার ছাড়পত্র না পেলে অন্যান্য কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ বিনিয়োগকারীদের এ সংক্রান্ত শর্ত রয়েছে। একই অবস্থা ঢাকার অদূরে মুন্সীগঞ্জের বিদ্যুত কেন্দ্রটির বলে জানান তিনি। এ ছাড়া মেঘনাঘাট ৬৩৫ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ২৮২ মেগাওয়াট, আনোয়ারা-২৮২ মেগাওয়াট, এস আলম গ্রুপের চট্টগ্রাম ৬১২ মেগাওয়াটের দুটি কেন্দ্রের সঙ্গে এখনও চুক্তি করতে পারেনি পিডিবি।
×