ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাপের ফল কখনও পবিত্র হয় না

প্রকাশিত: ০৩:২০, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

পাপের ফল কখনও পবিত্র হয় না

নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো কাজটি সজ্ঞানে হোক আর জেদের বশবর্তী হোক, তার মাসুল দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। কোমলমতিদের শিক্ষিত হয়ে ওঠার, জাতিকে ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেয়ার পথে যারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ হাসিলে তৎপর, তারা মূলত ভাবী প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এ কাজটি যথেষ্ট। মুহূর্তের উন্মাদনায় যারা দেশবাসীর প্রতি যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তা প্রলম্বিত করছেন, তাঁদের মনুষ্যবোধ যে লোপ পায়নি, তা নয়। তারা সর্বার্থে মূলত মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছেন। অযথা সহিংসতা, পৈশাচিকতার যে ঘৃণিত অবস্থা তৈরি করছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসাটাই তো সঙ্গত; কিন্তু তারা তা করছেন না। দুর্বৃত্তপনা দিয়ে ভাবী প্রজন্মকে যে শিক্ষা দিতে চান, তা হিতে বিপরীতই হতে বাধ্য। এই যে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা দেবে বলে গত ক’মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আসছে, তারা আমাদেরই সন্তান। তাদের জীবনের এই চলার পথে সব বাধা-বিঘœ সরানো যাদের কাজ, তারাই যখন হরতাল-অবরোধ আয়োজন করে পরীক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে তোলে, তখন সংশয় জাগেÑ এরা আসলে কী চায়? হরতাল ডাকা দলের এক নেতা তো বলেই দিয়েছেন, ‘কিসের পরীক্ষা? পরীক্ষা দিয়ে কী হবে? আগে আন্দোলন।’ কোথায় তারা তাদের গত এক মাসের অবরোধ কর্মসূচী পালনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারছেন, সম্পদহানি ঘটাচ্ছেন, তার জন্য দুঃখ এবং লজ্জাবোধ করবেন তা নয়; বরং আস্ফালন করে বেড়াচ্ছেন। মনুষ্যত্ববোধের এমন অধঃপতন নিকটকালে মেলেনি। অতীতে এদেশে বহু আন্দোলন হয়েছে, বহু প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটেছে; কিন্তু এভাবে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা হয়নি। এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচী অনেক আগেই নির্ধারণ করা। সুতরাং এই সময়টাতে কথিত ‘আন্দোলন’ নামক কর্মসূচীর সাময়িক বিরতি দেয়া যেত। কিন্তু তারা বরং পরীক্ষাকে ঠেকাতে অবরোধের পাশাপাশি হরতাল ডেকেছে টানা তিন দিনের। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এ ধরনের কর্মসূচী জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই নামান্তর। বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রধান কাজ হচ্ছে এখন দাবি আদায়ের নামে মানুষ হত্যা করে, ভয়ভীতি দেখিয়ে, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি এবং এটা করতে তারা অনেকটা কামিয়াবও হয়েছে। এই যে একতরফা সহিংসতা চালানো হচ্ছে বিনা প্রতিরোধে, এই যে হত্যাযজ্ঞ, পৈশাচিকতা চলছে, এসবই নাকি রাজনীতি ও আন্দোলনেরই অংশ এবং তা বিএনপিÑজামায়াতের ‘ডেমোক্র্যাটিক রাইটস’ বলে অভিহিত করছেন সুশীল সমাজের কেউ কেউ। বোমা বানাতে গিয়ে বোমায় নিজেই যখন বিস্ফোরণে মারা যায়, তখন তাকে আর নিজ দলের কর্মী হিসেবে স্বীকার করা হয় না। অথচ দলের নেতানেত্রীদের আহ্বানে এই বোমা নির্মাণে ব্রতী হয়েছিল ছাত্রদলের এক আঞ্চলিক নেতা। ছাত্র যদি হয়ে পড়ে বোমাবাজ তবে তো ভবিষ্যত ভয়াবহ। যাদের হাতে থাকার কথা বই-খাতা-কলম-ল্যাপটপ, তাদের ব্রেন ওয়াশ করে বোমা নির্মাতা বানানোর পেছনে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিকাশ ঘটানোই হয়ে পড়ে লক্ষ্য। আসলে ‘টোটাল পলিটিক্সের’ মতো একটা ‘টোটাল ওয়ার’ চালু করতে চাচ্ছে বিএনপি জোট। সমস্ত দেশের শান্তি নষ্ট করছে তাদের এই একতরফার সহিংসতার বোমাগুলো। বার্ন ইউনিটে দগ্ধ হয়ে যারা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, আসন্ন মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে, তারা জানতেও পারছে না কী তাদের অপরাধ। রাজনীতিকরা কেন তাদের জীবন হরণ করছেন। এই নিরীহ দরিদ্রজনরা তো চেয়ে আসছে দু’মুঠো ভাত, যা যোগাড় করতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত; তারা চায় না ক্ষমতার মসনদ। কোন রাজনীতি বা দলের প্রতি যাদের নেই কোন আগ্রহ বা আকর্ষণ, তারা পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে কঠিন নির্মম নৃশংস করুণ মৃত্যুকে বরণ করছে। কিন্তু কেনÑ তার জবাব তারা জানে না। জানে না তাদের স্বজনরাও। তারা গুলশানে অভিজাত বাসভবন চায়নি। বিদেশী ব্যাংকে টাকা পাচার ও প্রবাসে বিলাসবহুল জীবনযাপনের কথা ভাবনায়ও আসে না। তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে ‘শ্রেণীশত্রু’ দরিদ্র নিধনই হচ্ছে। এরা স্রেফ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের ঘাড়ের ওপর পা রেখে বিলাসিতায় ও আরাম আয়েশে কাটাচ্ছেন যে রাজনীতিকরা, তারা সাময়িক লাভবান হতে পারেন; কিন্তু বেশিদূর পথ পাড়ি দিতে পারবেনÑ ইতিহাস এমনটা বলে না। রাজনীতি একদা ছিল মানুষের কল্যাণের, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির। এ কোন্্ কল্যাণ হচ্ছে গত এক মাস ধরে? এ রাজনীতি যেন ক্ষমতা দখল করে লুটপাট, দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার করার মতো গণঅকল্যাণে পরিণত হয়েছে। বার্ন ইউনিটের দগ্ধ মানুষদের দেখলে স্পষ্ট হবে সভ্যতা এখন অধোনমিত। এই পৈশাচিকতা দেখে দেখে রাজনীতিকরা সহ্য করছেন কিভাবেÑ এমন মনে হলেও বাস্তবে তারা তা পারছেন। রাজনীতিকরা ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে এমনই মত্ত যে, জনগণের স্বার্থ তাদের কাছে গুরুত্বহীনতায় পরিণত হয়েছে। তাই দেখা যায়, আইনের শাসন, সুশাসনের কথা বলে যারা গলা ফাটান, তারাও দগ্ধ মানুষদের বিষয়টাতে নির্বিকার এবং নিশ্চুপ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি সব সময় বলে আসছেন, সেই আইনজীবী ও রাজনীতিক ড. কামাল হোসেনও মানুষ হত্যার এই আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন। তিনি যখন বিএনপি চেয়ারপার্সনের সঙ্গে সাক্ষাত করতে তার গুলশানের ‘অফিস কাম রেসিডেন্সে’ যান, তখন আশা জেগেছিল যে, তিনি মানুষ হত্যা বন্ধ করার আবেদন রাখবেন। এসএসসি পরীক্ষা যাতে নির্বিঘেœ হয় সে বিষয়টিও উত্থাপন করবেন। সাক্ষাত শেষে সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি সমস্যার সমাধানে।’ এরপরই তিনি বললেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গে কোন কথা হয়নি’। তাহলে তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন? আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত টাকা পাচারকারী হিসেবে সাজাপ্রাপ্ত কোকোর শোক বইতে তিনি সই করেছেন, টিভির কল্যাণে তা মানুষ দেখেছে। কিন্তু তিনি তো বেগম জিয়াকে পরামর্শ দিতে পারতেন। রাজনৈতিক কর্মসূচীর বাইরে রাখা হোক পরীক্ষা। তা করেননি। তাহলে জাতি কার ওপর নির্ভর করবে। রাজনৈতিকভাবে যারা এতিম হয়ে পড়েছে সেই তাদের নেতা হিসেবে তিনিই তো পারতেন বিএনপিকে দেশ ধ্বংসের কর্মসূচী পরিহার করে রাজনৈতিক কর্মসূচী চালু করার। তিনিও সে পথে যাননি। সুশিক্ষিত সুশীল নেতারা তো বলেন, দুই দলের বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু কিভাবেÑ তার কোন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মেলে না। ড. কামাল হোসেনের মুখে এক অন্তরে আরেক রূপ দেশবাসীকে হতাশ করে। আইনজীবী ও রাজনীতিক হিসেবে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে তিনি নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু কোন কিছুই দেশ ও জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ করেনি। বরং সব বক্তব্যই আপ্তবাক্যে পরিণত হয়েছে। তিনি সব সময় বলে আসছেন, জনগণকে সচেতন হতে হবে এবং প্রতিরোধ গড়তে হবে। অথচ এই সচেতন করে তোলার কাজটি কে করবে- সে বিষয়ে কোন ভাষ্য নেই। তিনি নিজেও জনগণকে সচেতন করার কাজে এগিয়ে এসেছেন, এমনটা নয়। কোমলমতি কিশোরদের পরীক্ষায় কোন বাধা আসুক তা জাতি দেখতে চায় না। সরকার সব নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলছেন, তাতে নিরাপত্তার কোন রূপ দেখা যায় না। বিবেকবান মানুষরা জেগে না উঠলে সরকারের পক্ষে যে সহজ হবে তা নয়। বিবেক প্রতিবন্ধী মানুষ আর যাই হোক জাতির দুঃসময়ে প্রতারকে পরিণত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর নন্দিত-নিন্দিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের শেষে মহাপুরুষের কণ্ঠে বলেছেন, ‘কাতর হইও না। তুমি বুদ্ধির ভ্রমক্রমে দস্যুবৃত্তির দ্বারা ধন সংগ্রহ করিয়া রণজয় করিয়াছ। পাপের ফল কখনও পবিত্র হয় না। অতএব তোমরা দেশের উদ্ধার করিতে পারিবে না।’ বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়ে পরীক্ষা বন্ধ করে আর যাই হোক দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না। দেশের মানুষের জীবন বিপন্ন করে যারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা আর দুর্নীতিবাজদের রেহাই দিতে চান, তারা পাপের পথে হাঁটছেন। এই পথ মসৃণ নয়, বন্ধুর। তাই পতন অনিবার্য। বিএনপি জোটের উচিত সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে স্বাভাবিক রাজনীতির পথে আসা এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে নামা। রণজয় সহজ নয়। দুর্বল নেতৃত্ব গোলমালই পাকায়। এইসব হতে পরিত্রাণের জন্য সকল বিবেকবানকে জাগ্রত হতেই হবে।
×