ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সরদার সিরাজুল ইসলাম

তারপরও তিনি বললেন ‘হরতাল, অবরোধ’ চলবে

প্রকাশিত: ০৩:১৮, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তারপরও তিনি বললেন  ‘হরতাল, অবরোধ’ চলবে

রোম যখন পোড়ে, নিরো তখন বাঁশি বাজায়। এটি ইতিহাসের নিষ্ঠুরতার বড় উদাহরণ। তবে নিরোর ছেলে মারা গেলে তিনি বাঁশি বাজাতেন কি না সে কথা জানা নেই। নিষ্ঠুরতার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে যে ব্যক্তিটি এই দেশে এখন সর্বশীর্ষে তার নাম খালেদা। ভক্তরা বলেন ম্যাডাম, তাঁর খেতাব আপোসহীন দেশনেত্রী। আরও অনেক কিছু। এই জানুয়ারি মাসে তিনি যা করেছেন তার খবর দেশবাসী জানেন। তাঁর নাম শুনলে এখন মানুষ দেখে মানুষ পুড়িয়ে মারা, বাসে আগুন, রেল লাইন উপড়ে ফেলা, মানুষ হত্যা। এর পরিমাণ কত জীবনহানি, সম্পদহানি নজিরবিহীন। এবার তিনি শুরু করেছেন ৪ জানুয়ারি। দিনটি ছিল মহানবী (সা.)-এর জন্ম এবং মৃত্যু দিবস ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী। তিনি তাঁর বাসা ছেড়ে যথারীতি রানীর সাজে এসে অবস্থান নিলেন তাঁর দফতরে। এবার তাঁর প্রতিপক্ষ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে টেনে-হিঁচড়ে না নামিয়ে বাসায় ফিরবেন না। সন্ধ্যার আগে অফিসের সামনে নিজের গাড়িতে উঠলেন, কোথায় যাবেন কেউ জানে না। কেননা কোন জনসভারই আয়োজন বা অনুমতি তাঁর ২০ দলীয় জামায়াত-বিএনপি জোটের পক্ষে ছিল না। পুলিশ বলল, আপনি কোথায় যাবেন? তিনি বললেন, আমি আমার পল্টন অফিসে যাব। পুলিশ জানাল সেখানে আপনার অপেক্ষায় কেউ নেই। আপনি বাসায় যেতে পারেন। তিনি বললেন, না আমি এখানেই থাকব, আমার এখানে অনেক কাজ। কতক্ষণ হা-হুতাশ করে কোন নেতা-নেত্রীকে পাশে না পেয়ে দেখা গেল তিনি একটি কাশি দিলেন এবং বললেন, অবরোধ। তারপর সেই যে অফিসের দোতলায় (যা তাঁর বাসস্থানের মতোই, সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এবং কাজের মেয়ে কুলসুম ছাড়াও তাঁর এক সুদর্শন বিশেষ সহকারী সার্বক্ষণিক দায়িত্বরত) ওঠার পর আর তাঁকে কখনও টিভি ক্যামেরায় দেখা যায়নি। কিন্তু অবরোধের সঙ্গে যোগ হচ্ছে হরতাল। এ যেন চলছে। মাঝে মাঝে এ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পলাতক রুহুল কবির রিজভী গায়েবি আওয়াজে মিডিয়ার সৌজন্যে জাতিকে জিম্মি করার সেই বয়ান শোনান। অবরোধ চলছে, চলবে। হরতাল চলছে, চলবে। এর মধ্যে মুসলমানদের একটি বড় এজতেমা ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে ২ দফায় ৬ দিন অনুষ্ঠানের জন্য মহারানীর দরবারে হাজিরা দিয়ে ম্যাডামের সাক্ষাত চেয়েছিলেন এজতেমা সংগঠকরা। কিন্তু ম্যাডামের সাক্ষাত পাওয়া কি এত সহজ। তাঁর বিশেষ চাকর-বাকরা বলে দিল ম্যাডাম দেখা দেবেন না। হরতাল, অবরোধ চলবে। কিন্তু এজতেমা যথারীতি অন্যান্যবারের মতো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে, অবরোধ-হরতাল উপেক্ষা করে। গত ২৪ জানুয়ারি সৌদি বাদশাহর মৃত্যুতে বাংলাদেশে ছিল জাতীয় শোক দিবস। শোক দিবসে হরতাল, অবরোধ, খুনাখুনি এগুলো বন্ধ রাখায়ই স্বাভাবিক, বিশেষ করে ম্যাডামের সেকেন্ড হোম সৌদি আরবের বাদশাহর মৃত্যুতে তিনি শোক তো পালন করলেনই না, বরং হরতাল-অবরোধ তিনি ঘরে বসেই পালন করতে থাকেন। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সৌদি পরিবারকে সমবেদনা জানাতে সৌদি আরব গেছেন এবং দেশে চলছে সরকারীভাবে জাতীয় শোক দিবস। সেদিন দুপুরেই ম্যাডামের ছোট পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু খবর পেলেন। কিন্তু অবরোধ, হরতাল স্থগিত হলো না বরং সে রাতেই তাঁর সৈনিকরা যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দিয়ে হত্যা করল শিশু, নারীসহ অনেককে। অগ্নিদগ্ধদের ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে করুণ দৃশ্য। ম্যাডাম ওসব দেখেন না। তাঁর ছেলে মারা গেছে এতে যেন তিনি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে হয়ত ভাবছেন আমার ছেলেই যখন মারা গেছে তখন আর এদেশে কারও ছেলে বাঁচতে পারবে না, জ্বালাও, পোড়াও। তাঁর ছেলের লাশ দেখতে বড় ছেলে পলাতক ও ফেরারি খুনের মামলার আসামি তারেক লন্ডন থেকে মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি। তাহলে আর এদেশে কাউকে রাখা হবে না। সেই ’৭১-এর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মতো ম্যাডাম এদেশে কোন মানুষ চান না, জামায়াত আর মাটি ছাড়া। কত নিষ্ঠুর এই মহিলা। যে কোন কিছুর বিনিময় তিনি আবারও এদেশের প্রধানমন্ত্রী চাই কি রাষ্ট্রপতি (ছেলে তারেক প্রধানমন্ত্রী) হওয়ারও খায়েশ তাঁর মাথায় এমনভাবে চেপেছে তিনি আর তা এক সেকেন্ডের জন্য ভুলতে পারছেন না। হায়রে আকুতি, হায়রে স্বপ্ন। ম্যাডাম খালেদাকে এত উঁচুতে উঠিয়েছেন কারা? আমরা একটু স্মরণ করতে চাই ১৯৭২ সালের ঘটনা। ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের লেবাস লাগিয়ে ২৫ মার্চ শেষ রাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা বলে সে রাতেই শহর ছেড়ে পালিয়ে প্রথমে চট্টগ্রাম শহরের ২৫ মাইল দূরে করলডাঙ্গায় (বোয়ালখালী) আশ্রয় এবং ৩০ তারিখে ভারতে অবস্থান নিলেও ম্যাডাম খালেদাকে ভারতে নিতে পারেননি। কারণ ম্যাডামকে হেফাজতকরণ এবং সুখ-শান্তিতে রেখেছিলেন পাকিস্তানী বন্ধুরা ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়া দেশে এসে খালেদার বিরুদ্ধে নানা কথা শুনে তিনি তাঁকে গ্রহণ করেননি। অসহায় খালেদা তাঁর পুত্রকে নিয়ে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ভবনে এবং বেগম মুজিব ও হাসিনার আদর-যতেœ সহযোগিতায় জিয়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁদের গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, জোর করে খালেদাকে জিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কারণে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার এটিও একটি কারণ। অথচ সেই অকৃতজ্ঞ মহিলা ম্যাডাম খালেদা, তারেক শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ঘাতক নামিয়েছিল ২১ আগস্ট ২০০৪ তারিখে। স্মরণ থাকতে পারে খালেদা জিয়া যখন প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন (৯১-৯৬) সেই সময় তারেকের প্রথম সন্তান জন্মের পরে শেখ হাসিনার বাসায় সুধাসদনে তারেক মিষ্টি নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কাটিয়েছিলেন প্রায় ২ ঘণ্টার বেশি সময়। তারেক হয়ত শিশুকালের অসহায়ত্ব এবং শেখ হাসিনার আদরযতœ ভুলতে না পেরে এ কাজটি করেছিলেন। আরও স্মরণ করা যেতে পারে, একই সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদার সঙ্গে সেনাকুঞ্জের এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার দেখা হলে ম্যাডাম খালেদাকে আপা বলে সম্বোধন করেছিলেন। এসব ঘটনা সবাই জানে। কিন্তু মনে রাখে না। আলোচনায় আনে না। কারণ খালেদার কাছে মধুর খনি আছে। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত পরবর্তীতে অনেক নামীদামী ব্যক্তি, সুশীল, সাংবাদিক যাঁরা এক সময় বঙ্গবন্ধুর ভক্তে গদগদ ছিলেন তাঁদের অনেকেই জিয়ার পেছনে লাইন লাগিয়েছিলেন। চীনপন্থীরা জিয়ার পেছনে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী) যাঁরা বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনে উৎসাহ দিয়েছিলেন, যোগ দিয়েছিলেন সরকারে, তারাও জিয়ার পা চেটেছেন, খাল কাটা রাজনীতির পেছনে ঘুরেছেন। আজকের প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানরাও ছিলেন। মাঝখানে কমিউনিস্ট পার্টিরা শেখ হাসিনার সঙ্গে জোট করে ৯১ নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে পরাজয়ের ষড়যন্ত্রে সফল হয়ে এখন নেপথ্যে ২ নেত্রী দ্বারা কিছু হবে না বলে বস্তুত খালেদার সহযোগিতায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এখন বরং এগিয়ে আছেন। সে যাই হোক, খালেদাকে আপোসহীন বানিয়েছিল কারা? স্মরণ করা যেতে পারে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার ১৩ দিনের মাথায় জিয়া তার সহকর্মীদের হাতেই নিহত হন। তাই শেখ হাসিনা দেশে আসার পরে তাঁর বিরুদ্ধে কোনরূপ আন্দোলন করার সুযোগই পেলেন না। জিয়া যদিও খালি মাঠেই গোল দিয়ে গেছেন, কিন্তু প্রতি রাতেই মানুষ এবং তাঁর সৈনিক হত্যা করেই তাঁকে কাটাতে হয়েছিল। জিয়া যদি ঐ সময় মারা না যেতেন তাহলে ২/১ বছরের মধ্যে শেখ হাসিনার আন্দোলনে তাঁকে পালাতে হতো। বঙ্গবন্ধু হত্যার খুনী হিসেবে তাঁর বিচার হতো। কিন্তু যে অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে সেই অপশক্তি জিয়াকে হত্যা করে তাঁকে একটি অমরত্বদানের ব্যর্থ চেষ্টা করে সংসদ প্লাজায় কবর দিয়ে জিয়া অনুসৃত ধারাকে প্রলম্বিত করতে এরশাদকে ক্ষমতায় বসান। তবে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ্য করে এরশাদের পরে যেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় না আসতে পারে সেজন্য এরশাদ তাঁর পেয়ারে পুতুল ভাবীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজপথে নামান। উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তীতে হাসিনা ঠেকাও। ১৯৮৬ সালে খালেদার বিএনপিতে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো লোক ছিল না। এমনকি জামায়াতসহও নয়। আর বিএনপি ৩০০ আসনে নির্বাচন করলে এরশাদের বিপদ হতো। বিএনপির ভোটেই এরশাদ শেষ পর্যন্ত কোনরকম টিকে গেলেন। অথচ খালেদা নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে ২ দিন নিখোঁজ ছিলেন। বললেন, নির্বাচন করব না। আর আঁতেল সাংবাদিকরা বললেন আপোসহীন নেত্রী। ১৯৯১ সালে খালেদা ১৪০টি আসন পেলেও আওয়ামী লীগ ঠেকাতে জামানত হারিয়েছিলেন ৬৪টি আসনের। এটি ছিল একটি সূক্ষ্ম সমঝোতায় জামায়াত, জাতীয় পার্টি। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রেও মুজাহিদুল ইসলামরা হাসিনার নৌকার জোটে থেকেও ৫০টি স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে আওয়ামী লীগ ঠেকিয়েছে। একই কাজ করেছে আঃ রাজ্জাকের বাকশালও। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজ্জাকের সে কথা ভুলে ৯৬ মন্ত্রিসভায় জায়গা দিয়েছিলেন। কিন্তু ড. কামাল হোসেন সেই ৯১ সালে নিজেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এখন তিনি ম্যাডাম খালেদার হিতৈষী। এসব কথা থাক। এখনও দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ভিসি, আইনজীবী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, এমনকি এই সরকারের সময় ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত সম্পাদকও ম্যাডাম খালেদার গোঁয়ার্তুমির পক্ষে কাজ করে চলছেন। এরা কি দেশের ভাল করছেন? গত নির্বাচনে ম্যাডাম খালেদা নির্বাচন বর্জন করে যে ভুল করেছেন তা বস্তুত তাঁকে এখন এতই চাপে ফেলেছে যে তিনি আর সামলে ওঠার শক্তি পাচ্ছেন না। আর ২০১৯ সালের নির্বাচন সে সময় তাঁর বয়স কত হবে? বয়স তো আর কম হলো না। তবে তাঁর সবচাইতে বড় আশঙ্কা হচ্ছে শেখ হাসিনার কর্মক্ষমতা ব্যাপক উন্নয়ন, দেশের প্রবৃদ্ধি, বিশ্বে তাঁর তুলনায় খালেদা নিজেকে একেবারেই নগণ্য বেমানান সে কথা যে জনগণ টের পেয়েছে তা ম্যাডাম খালেদা হয়ত বুঝতে পেরেছেন। এর সঙ্গে যদি আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই মাত্রার পার্থক্য আরও ব্যাপক হয় এখন এটিই তার সবচাইতে আতঙ্কের বিষয়। এ দেশে অনির্বাচিত কাউকে দিয়ে সরকার গঠন করে নির্বাচন করা যে যাবে না এটা সুপ্রীমকোর্টের আদেশ। এই আদেশ কেউ লঙ্ঘন করতে পারবে না। এর পরে খালেদা যদি নিজেও ক্ষমতায় আসেন তবুও সেই ৫ম সংশোধনীতে ফিরে যাওয়া যাবে না। অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়কও আর হবে না এগুলো কি ম্যাডামের সুহৃদরা কখনও বুঝিয়েছেন? আসিফ নজরুল তো আইনের প-িত, বোঝাননি, তাঁর সামনে কেউ কথা বলেন না, যা দেশের এই দুর্বিষহ কর্মসূচীর জন্য দায়ী। হাসি পায় ব. দ. চৌধুরীর তামাশা দেখে।
×