ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাধা সত্ত্বেও সব সূচকে অগ্রগতি

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

বাধা সত্ত্বেও সব সূচকে অগ্রগতি

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ নানা বাধা সত্ত্বেও গত ৫ বছরে (২০০৯ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত) অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, রাজস্ব আয়, রফতানি আয়, রেমিটেন্স, রিজার্ভ, বাজেট বরাদ্দ, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, দারিদ্র্যের হার এবং অতি দারিদ্র্যের হারসহ আরও বিভিন্ন সূচকে সাফল্য এসেছে। গত ৫ বছরে অতিদারিদ্রের হার ২৪.২ থেকে কমে ১০.৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের তুলনামূলক এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এসময়কালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝেও অর্জিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি প্রশংসার দাবি রাখে। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে সরকার দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এসব পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা এবং দারিদ্র্যের হার ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ॥ বিশ্বমন্দার মধ্যেও সরকারের বিচক্ষণ নীতি ও দক্ষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ২০০৯ থেকে ২০১৪ মেয়াদকালে গড়ে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ হারে। অপরদিকে তার আগের পাঁচ বছরে সময়কালে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৫ দশমিক ৪০ শতাংশ। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে চলতি মূল্যে জিডিপি ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ছিল চার লাখ ৮২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। সেখান থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। দারিদ্র্য বিমোচন ॥ ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ৪০ শতাংশ, যা ২০১৪ সালে ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়ে অতিদারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশে নেমে এসেছে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্র লোকের সংখ্যা ২০০৫ সালে ৫ কোটি ৭৩ লাখ ও ৩ কোটি ৫৯ লাখ থেকে ২০১৪ সালে হয়েছে যথাক্রমে ৩ কোটি ৮৫ লাখ এবং ১ কোটি ৫৭ লাখ। মাথাপিছু আয় ॥ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে জনগণের মাথাপিছু আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে এক হাজার ১৯০ মার্কিন ডলার। ক্রয় ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৯৮০ মার্কিন ডলার, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৬৮ মার্কিন ডলারে। সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ॥ প্রতিবেদনের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ অংশে বলা হয়েছে জাতীয় সঞ্চয় ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপির ২৭ দশমিক আট শতাং থেকে বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক পাঁচ শতাংশে। অপরদিকে বিনিয়োগ ওই বছরে জিডিপির ২৬ দশমিক ১৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হয়েছে ২৮ দশমিক ৬৯ শতাংশে। রাজস্ব আয় ॥ ২০০৫-০৬ এর তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে মোট রাজস্ব ও কর রাজস্ব তিনগুনের অধিক বেড়েছে। নতুন ভিত্তিবছর অনুযায়ী মোট রাজস্ব আয় জিডিপি আট দশমিক আট শতাংশ (৪২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা) থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশ দশমিক পাঁচ শতাংশে (এক লাখ ৪১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা)। একই সময়ে কর রাজস্ব জিডিপির সাত শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে আট দশমিক ছয় শতাংশে। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় নেয়া বিভিন্ন প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কার, জনবল বৃদ্ধি, অটোমেশন পদ্ধতি প্রবর্তন ইত্যাদি পদক্ষেপের কারণে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেটের আকার ও ব্যবস্থাপনা ॥ এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা। সেখান থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ১৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা, যা চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে হয়েছে দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। গত মেয়াদে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, উন্নয়ন খাতে অর্থায়ন, অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও ঋণ গ্রহণে ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাসহ উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশেষ নজর দেয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থাপনা ॥ মুদ্রানীতি বরাবরই লক্ষ্য ছিল সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকার সফল হয়েছে। সরকারের দক্ষ আর্থিক ও রাজস্ব খাত ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মিত ও কার্যকর তদারকির মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ হলেও মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪ শতাংশের মধে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির অভিঘাতে ২০১০-১১ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। কার্যকর সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে পরবর্তী অর্থবছরগুলোতে তা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সর্ব শেষ তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্টে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ এবং এক ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি ছয় দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ॥ বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা প্রতিকূলতার সত্ত্বেও ২০০৫-০৬ এর তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে আমদানি এবং রফতানি উভয় ক্ষেত্রেই বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ওই সময়ে আমদানি ও রফতানি যথাক্রমে ১৪ দশমিক ৭৪ এবং ১০ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৬১ এবং ৩০ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই সময়ে রফতানি আয়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল দশ দশমিক সাত শতাংশ, যা ২০০৯ থেকে ১৪ সময়কালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ॥ ২০০৫-০৫ এর তুলনায় ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রফতানি ও প্রবাস আয় বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সময়ে তিন দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ছয় গুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৪ বিলিয়ম মার্কিন ডলারে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গড় আয়ু ॥ বয়স্ক শিক্ষার হার ২০০৫ সালের ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১২ সালে হয়েছে ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ। বয়স্ক নারী শিক্ষার হার একই সময়ে ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ। শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ২০০৫ সালে ছিল ৫০ জন, সেখান থেকে কমে ২০১৩ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৩ জনে। মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা একই সময়ে এক লাখ ৩৪৮ জন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৯৪ জনে। মানুষের প্রত্যাশিত আয়ুস্কাল দীর্ঘ হয়েছে। প্রত্যাশিত গড় আয়ু ২০০৫ সালে ছিল ৬৫ দশমিক ৩ বছর যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৩ বছর।
×