ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চারদিকে শুধু রোগীর স্বজনের আহাজারির আওয়াজ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

চারদিকে শুধু রোগীর স্বজনের আহাজারির আওয়াজ

‍শর্মী চক্রবর্তী ॥ শনিবার দুপুর ১২টা। ছেলেকে দেখার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বগুড়া থেকে এসেছেন জাহাঙ্গীরের মা জাহানারা বেগম। আইসিইউর ৪ নম্বর বেডে ভর্তি আছেন ছেলে। মাকে দেখার পর জাহাঙ্গীর খুব কষ্টে কথা বললেন, ‘মা তুমি কেমন আছ? তোমার মুখ এত শুকনা লাগতাছে কেন? আমার কথা চিন্তা কইরনা। তুমি আমার ছইল-পইলরে দেখি রেখ। তাদের যেন কিছু না হয়। আমার জন্য সবাইকে দোয়া করতে বইলো।’ ছেলের এসব কথা শুনে সহ্য করতে না পেরে আইসিইউ থেকে বের হয়ে হাউমাউ করে কান্না শরু করেন তিনি। বিলাপ করে বলতে লাগলেন, ‘আমার ছেলেকে কেন এমন করল। আমার ছেলের মুখ তো আমি চিনতে পারছি না। ও আল্লা তুমি আমার বাপধনরে কেন এমন করলা। আমার একটাই বুকের মানিক। তার জীবনটা তুমি আমারে ভিক্ষা দাও আল্লা।’ ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে আইসিইউর সামনে এমনভাবে আর্তনাত করছিলেন জাহাঙ্গীরের মা জাহানারা বেগম। তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী আক্তার, ছেলে হাসান ও মেয়ে জুঁই। জাহানারার এই আর্তনাত শুনে তারাও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তাদের চিৎকার ও কান্নায় বার্ন ইউনিটের পরিবেশ ভারি করে তুলছে। চারদিকে রোগীর স্বজনের আহাজারির শব্দ। আপনজনের যন্ত্রণায় চিৎকার শুনে তারা নিজেদের ধরে রাখতে পারেন না। ব্যান্ডেজে মোড়া কারও পুরো শরীর, কারও বা অর্ধেক। কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুছছেন স্বজনরা। প্রবেশমুখ থেকে শুরু করে কেবিন, করিডরসহ পুরো ওয়ার্ডের মেঝেতে রোগী। যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এসব দগ্ধ রোগী কেউ দিনমজুর, কেউ ট্রাক বা বাসের চালক-হেলপার, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ নিতান্তই সাধারণ মানুষ। তারা কোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। অথচ জীবন-জীবিকা নির্বাহের তাগিদে রাস্তায় বের হয়ে এখন তাদের স্থান হয়েছে বার্ন ইউনিটে। জীবন সংগ্রামে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তারা। দগ্ধ এসব মানুষকে সারিয়ে তুলতে দিনরাত চিকিৎসকদের সঙ্গে অবিরত পরিশ্রম করছেন স্বজনরা। চোখের সামনে আপনজনকে ছটফট করতে দেখে তাদের মনের ভেতরটা হু হু করে উঠছে। নিত্যসঙ্গী কান্নায় আর চোখের পানি বের হচ্ছে না তাদের। শুধু ভেতরটা জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। স্বজনদের বীভৎস চেহারা দেখে তারা সহ্য করতে পারছেন না। কখন ভাল হবে তার স্বজন আর কখন বাড়ি ফিরবে তারা এ অপেক্ষায় প্রত্যেকেই। ২৩ জানুয়ারি বগুড়ার চারমাথায় পেট্রোলবোমার আগুনে দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটের হাইডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) ভর্তি হন জাহাঙ্গীর (৩৫)। পেশায় ট্রাকের হেলপার। আগুনে তার শ্বাসনালীসহ ৪৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। যন্ত্রণায় এখনও কাতরাচ্ছেন তিনি। শরীরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে নেয়া হয়েছে আইসিইউতে। আগুনে শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। হাঁ করে মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। হাঁপানি রোগীর মতো হাঁপাচ্ছেন। ঘটনার দিন থেকে স্বামীর পাশে থেকে তাকে সারিয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন স্ত্রী বিউটি। নাওয়া খাওয়া ঘুম সব বাদ দিয়ে দিনরাত স্বামীর পাশে বসে থাকেন। বার বার ডাক্তারদের কাছে জানতে চান এখন তার কী অবস্থা। তিনি সুস্থ হবেন তো? আমার যে উনি ছাড়া আর কেউ নেই। তাদের এই আর্তনাদ দেখে পাশে থাকা মানুষগুলো অঝরে চোখের পানি ফেলেন। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বলেন, হরতাল-অবরোধের সময় অনেক দিন তিনি ভয়ে বের হননি। কিন্তু এভাবে বসে থাকলে ছইল-পইলদের না খাইয়া থাকতে হবে। এছাড়া দেনা আছে, ওইগুলোর কিস্তিও দিতে হয় প্রতি সপ্তাহে। তাই সেদিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। ঠিক সেদিনই পেট্রোলবোমার আগুনে তার শরীর পুড়ে যায়। জাহাঙ্গীরের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আর কত মায়ের বুক খালি করলে ওদের বুকে শান্তি আসবে আপনারা আমারে একটু বলেন। আমার একটা মাত্র ছাওয়াল। তারে আমার বুকে ফিরাই দেন। আমি শুধু আমার ছাওয়ালের মুখে মা ডাক শুনতে চাই। তার কিছু হলে আমারে মা কইয়া ডাকার মতো আর কেউ থাকব না। জাহাঙ্গীরের স্বজনদের মতো আরও পাঁচজনের স্বজনরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন বার্ন ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সামনে। কখন সুস্থ হবেন প্রিয় মানুষটি। আইসিইউর বাইরে বসে আছেন স্বজনরা।
×