ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তারেকের হাতে রিমোট, টেলিফোনে আসছে কর্মসূচী

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

তারেকের হাতে রিমোট, টেলিফোনে আসছে কর্মসূচী

শরীফুল ইসলাম ॥ নানামুখী চাপ সত্ত্বেও চলমান আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত করছে না বিএনপি জোট। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই কঠোর হচ্ছে তারা। আর আন্দোলনের রিমোট কন্ট্রোল লন্ডন প্রবাসী বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে থাকায় কখন কি আন্দোলন আসে তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বিএনপিসহ জোটের অন্য নেতারা। জানা যায়, ৩ জানুয়ারি রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানের পর থেকে তারেক রহমান নিয়মিত তার মা খালেদা জিয়াসহ নিজ দল ও জোটের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। তিনি আন্দোলন কর্মসূচী সফলের জন্য বিভিন্ন সময় নেতাদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। ৫ জানুয়ারি সরকার বিএনপি জোটকে ঢাকায় সমাবেশ করতে দেবে না আঁচ করতে পেরে আগেই তিনি তার মাকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালনের পরামর্শ দিয়ে রাখেন। আর এ কারণেই আন্দোলনের প্রস্তুতি না থাকার পরও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি বিকেলে ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। আর খালেদা জিয়ার মুখ থেকে আন্দোলনের এ ঘোষণা শুনে খোদ বিএনপিরই অনেক সিনিয়র নেতা চমকে উঠেন। এ আন্দোলন সফল করতে তারা রাজপথে না নামায় শনিবার পর্যন্ত টানা ২৭ দিন ধরে রাজপথে অবরোধ কর্মসূচী সফল করতে বিএনপি ও অন্য শরিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাড়া মেলেনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নাশকতামূলক কর্মকা- ঘটিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করে পিকেটাররা। এদিকে শুধু অবরোধে আন্দোলন চাঙ্গা না হওয়ায় তারেক রহমানের নির্দেশনায় মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয়ভাবেই বিবৃতি দিয়ে দেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করছে বিএনপি। এ ছাড়া তারেক রহমান বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশনা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই স্থানীয়ভাবে কিছু জেলায় হরতাল পালনের ব্যবস্থা করছেন। কখনও কখনও ছাত্রদলসহ বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন দিয়েও হরতালের ডাক দেয়াচ্ছেন তিনি। এমনকি সর্বশেষ কেন্দ্রীয়ভাবে টানা ৭২ ঘণ্টা হরতালের সিদ্ধান্তও তার কাছ থেকেই এসেছে বলে জানা গেছে। তবে এসএসসি পরীক্ষার সময় এ হরতাল ঘোষণার পর সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমালোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠেছে। এ পরিস্থিতিতে তারেক রহমান দলের নেতাদের সমালোচনায় কান না দিয়ে কিভাবে আন্দোলনে সফলতা অর্জন করা যায় সেদিকে অধিক নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। বিএনপি জোটের লাগাতার কর্মসূচীকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহল থেকে যখন সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপের ব্যাপারে জোর দাবি ওঠে তখন কোকোর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ছুটে যান বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে। ২৪ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মালয়েশিয়ায় মারা যান। খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে সমবেদনা জানানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। ওইদিন রাতে পুত্র শোকে কাতর খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গেলেও প্রধানমন্ত্রীকে গুলশান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। এমনকি তখন সেখানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারসহ দলের অনেক নেতাকর্মী উপস্থিত থাকলেও তারা এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সাহস দেখাননি। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে যাবার আগেই শোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার কক্ষের দরজা লাগিয়ে সেখানে নিথর নিস্তব্দ হয়ে পড়েন। তাই প্রধানমন্ত্রীর সেখানে আগমনের বিষয়টি নিয়ে গুলশান কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণকারীরা তারেক রহমানের মতামত নেন। তারেক রহমান নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করলে প্রধানমন্ত্রীকে তারা গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। পরে এ বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে কেন বিএনপি এই শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজটি করল? শুধু তাই নয় বিএনপি নেতাকর্মীরাও দলীয় হাইকমান্ডের এ আচরণে হতাশ হন। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়া হয় শোকে কাতর খালেদা জিয়াকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার কারণে প্রধানমন্ত্রীকে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে দেয়া হয়নি। এবারের টানা ৭২ ঘণ্টার হরতালটি নিয়েও বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের কোন কোন নেতার মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কেউই কিছু বলছেন না। কোকোর মৃত্যুর পর মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন খালেদা জিয়া। ২৭ জানুয়ারি মালয়েশিয়া থেকে লাশ এনে গুলশান কার্যালয়ে নেয়ার পর খালেদা জিয়া লাশ দেখে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কোকোকে দাফনের ২ দিন পর ২৯ জানুয়ারি রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ৭ সদস্য খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে সমবেদনা জানান। এ সময় তারা কোন রাজনৈতিক আলোচনা করার সুযোগ পাননি বলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নজরুল ইসলাম খান জানান। সেই সঙ্গে তিনি জানান, ২০ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে এসএসসি পরীক্ষার সময় হরতাল অবরোধ থাকবে কিনা। কিন্তু একদিন পর ২০ দলীয় জোটের কারও মতামত না নিয়েই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক বিবৃতি দিয়ে ৭২ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা দেন। জানা যায়, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়েই এসএসসি পরীক্ষার সময় এ হরতাল পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। এ ধরনের কর্মসূচী প্রণয়নের আগে বিএনপির থিঙ্ক ট্যাংক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নেয়া হলেও এবার তারেক রহমানের নির্দেশনা থাকায় কারও মতামত নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সূত্র মতে, আন্দোলন কর্মসূচীসহ দলের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে সব সময়ই তারেক রহমান মা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। এছাড়া আগে থেকেই তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গেও ইস্যুভিত্তিক কথা বলতেন তিনি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গ্রেফতার হওয়ার আগে আন্দোলন কর্মসূচী নিয়ে নিয়মিত তাকে নির্দেশনা দিতের তারেক রহমান। এরপর যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে তিনি সে নির্দেশনা দেন। তার নির্দেশনা পেয়েই রুহুল কবির রিজভী নিয়মিত বিবৃতি প্রদান করতেন। কিন্তু রিজভী গ্রেফতার হওয়ার পরও তিনি তার অন্য অনুসারীদের মাধ্যমে আন্দোলন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এমন একটি সূত্র জানিয়েছে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর থেকেই লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমান পরবর্তী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার আশাপোষণ করেন। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়াসহ ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারাও তারেক রহমানের নির্দেশনায় আন্দোলনের ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ কৌশলে দলীয় কর্মকা- থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। তাই এবার ৫ জানুয়ারির আগেই তারেক রহমানের পক্ষ থেকে নির্দেশনা আসে সরকারকে আর সময় না দিয়ে আন্দোলন জোরদার করার। আর সরকারের তরফ থেকে মামলা-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় খালেদা জিয়াও কঠোর আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করেন। এ কারণেই তিনি এবার আন্দোলন শুরুর আগেই বাসা ছেড়ে গুলশান কার্যালয়ে এসে অবস্থান নেন। এখানে বসেই তিনি প্রতিদিন ছেলে তারেক রহমানসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলন সফলের কৌশল জোরদার করতে থাকেন। জানা যায়, তারেক রহমান চাচ্ছেন চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে পরবর্তীতে হরতাল কর্মসূচী পালন করতে। সেই সঙ্গে তিনি আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন বলেও তার ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন।
×