ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরেজমিন গাজীপুর

শিবিরের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

শিবিরের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া

রাজন ভট্টাচার্য/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু ॥ রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে গাজীপুরে একের পর এক সহিংস তা-ব চালাচ্ছে শিবিরের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। নাশকতার জন্য নিরাপদ হিসেবে এই জেলাকে বেছে নিয়েছে তারা। স্থানীয় বিএনপির ছত্রছায়ায় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া কর্মকা- চালাচ্ছে অনেকটাই নির্বিঘ্নে। জীবন্ত মানুষসহ গাড়িতে আগুন দিচ্ছে। জেলার অন্তত ২১টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চোরাগোপ্তা হামলা, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, জ্বালাও, পোড়াও এবং ভাংচুর চলছে। নাশকতা থেকে বাদ যাচ্ছে না বিজিবির টহল গাড়ি ও গ্যারেজে রাখা পরিবহনও। এ পর্যন্ত এক চালক নিহতসহ আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করা হয়েছে দেড় শতাধিক পরিবহন। একের পর এক নাশকতা চললেও সন্ত্রাসীদের আস্তানার সন্ধান মিলছে না। দেড় সহস্রাধিক আসামির বিরুদ্ধে মামলা হলেও গ্রেফতারের চিত্র হতাশাজনক। দৃশ্যমান নেই সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির কার্যক্রম। নাশকতা চলছে যেখানে ॥ অবরোধ-হরতালে মাঠে নেই বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এদের অনেকেই আত্মগোপনে। তবে ছাত্রদলের কর্মীদের কার্যক্রম দৃশ্যমান আছে। বিএনপির নেতারা মাঠে না থাকলেও নাশকতার জন্য শিবিরের সন্ত্রাসীদের নির্দেশনা দিচ্ছে তারাই। টেলিফোন নির্দেশনায় চলছে সহিংসতা। নীবর এলাকা বেছে বেছে বেশিরভাগ অপারেশন চালাচ্ছে শিবির। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, দেশের রাজধানী বা দক্ষিণ এবং পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সড়কপথে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে গাজীপুর। আর ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা বাইপাস (গাজীপুর-ভুলতা সড়ক), ঢাকা-কিশোরগঞ্জ ও ঢাকা-গাজীপুর সড়ক মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা, ভোগড়া বাইপাস মোড়, পূবাইল, মালেকের বাড়ি, বোর্ডবাজার, শিববাড়ি, বারি ও ব্রি গেট, নলজানী, তেলিপাড়া, সালনা, মাওনা, চন্দ্রা, কালিয়াকৈর, টঙ্গী, চেরাগআলী, কালিগঞ্জ ও কাপাসিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধের সমর্থনে চলছে একের পর এক নাশকতা। সুযোগ বুঝে বিভিন্ন পরিবহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ, যানবাহন ভাংচুরের ঘটনা ঘটাচ্ছে অবরোধ ও হরতাল সমর্থিতরা। হামলাকারীরা বহিরাগত ॥ গাজীপুর শিল্পাঞ্চল জেলা হওয়ার কারণে অন্য জেলাগুলো হতে বিপুলসংখ্যক লোকজন এ জেলায় এসে বসবাস করছে। যাদের অধিকাংশই স্থানীয়দের অচেনা। আর এ সুযোগে অন্য জেলার সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররাও গাজীপুরে আস্তানা করেছে। এসব সন্ত্রাসী এখন অবরোধ ও হরতালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের পক্ষে ব্যবহৃত হয়ে নানা নাশকতা কার্যক্রম করছে। ফলে অপরাধ ঘটনোর পর পুলিশের অভিযানকালে দু’চার জন ধরা পড়লেও তাদের অধিকাংশই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। গত ৯ জানুয়ারি বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্বের প্রথম দিন গাজীপুর মহানগরের নলজানীস্থ গ্রেট ওয়াল সিটি আবাসিক প্রকল্পের এক বাড়ি হতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ নাশকতার জন্য গোপন বৈঠকের সময় ককটেল ্এবং বিপুলসংখ্যক জিহাদী বই ও সরকারবিরোধী প্রচারপত্রসহ জামায়াত-শিবিরের ১২ নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের সবার বাড়ি অন্য জেলায়। তারা বেশ কিছুদিন ধরে ওই বাড়িতে আস্তানা গেড়েছিল। পুলিশ জানায়, গত ১৫ জানুয়ারি ভোরে ২০ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধ সমর্থিত বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা কালিয়াকৈর উপজেলার মহিষবাথান বটতলা এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে পার্কিং করে রাখা একটি বাসে অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার তোফাজ্জল দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। এ ঘটনায় থানায় দায়ের করা মামলায় কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সভাপতি হুমাইয়ুন কবির খান ও সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র মজিবুর রহমানসহ বিএনপি-জামায়াতের ৩৪ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১০/১৫ জনকে আসামি করা হলেও পুলিশ এ পর্যন্ত এজাহারনামীয় ৩জনকে গ্রেফতার করছে। ৪ জানুয়ারি গাজীপুর শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ি এলাকায় হরতাল-অবরোধ সমর্থিতরা চলচ্চিত্র অভিনেতা ড. ইনামুল হকের গাড়ি ভাংচুর করে। এসময় অভিনেতা ড. ইনামুল হক আহত হন। একইদিন পৃথক ঘটনায় শহরের শিববাড়ি এলাকায় হরতাল-অবরোধ সমর্থিতরা তা-ব চালিয়ে ৪টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে জামায়াত- শিবিরের ৯ জনকে আটক করা হয়। ১৫ জানুয়ারি সকালে গাজীপুর মহানগরের মালেকের বাড়ি এলাকায় গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগকালে আটক করা হয় শিবিরের ক্যাডার আলী আজগরকে (২২)। পরে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করা হলে আদালত আলী আজগরকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ-াদেশ প্রদান করে। দ-প্রাপ্ত শিবির ক্যাডার আলী আজগর সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বাসিন্দা। সে প্রায় মাস খানেক আগে সাতক্ষীরা থেকে নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে গাজীপুর আসে। একইদিন এরশাদনগর এলাকায় ছাত্রদলের পিকেটাররা বিজিবির গাড়িতে ইটপাটকেল ছুড়ে ভাংচুর করে। বাদ যাচ্ছে না গ্যারেজে পার্কিং করে রাখা গাড়িও। গাজীপুর সদরের পূবাইল এলাকার একটি গ্যারেজে পার্কিং করে রাখা একটি বাসে অগ্নি সংযোগ করে অবরোধকারীরা। গত ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বাইপাস সড়কে গাজীপুর মহানগরের মোগরখাল এলাকায় পিকেটিং ও নাশকতা সংঘটনের সময় শিবির কর্মী ফারুক আহমেদকে হাতেনাতে আটক করা হয়। পরে তাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদ-াদেশ প্রদান করে। দ-প্রাপ্ত ফারুক আহমেদ (৩২) ময়মনসিংহের গফরগাঁও থানার রৌহা এলাকার আব্দুল মজিদের ছেলে। এছাড়াও গত শুক্রবার র‌্যাব-১’র সদস্যরা গাজীপুর মহানগরের বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামনে অভিযান চালিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের মনির হোসেন ও সাগর হোসেনকে ১৩টি পেট্রোলবোমাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। তারা নাশকতা কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য ওই এলাকায় অবস্থান করছিল। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ জানান, গাজীপুর শহরের ভুরুলিয়া রেললাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে গোপন বৈঠককালে গত মঙ্গলবার রাতে গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির আবুল হাসেম খান ও গাজীপুর মহানগর জামায়াতের অর্থসম্পাদক মোঃ নাসরুল্লাহকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১০টি পেট্রোলবোমা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা এবং নাশকতা সৃষ্টি ও পরিকল্পনার অভিযোগ রয়েছে। নাশকতায় আসামি দেড় সহস্রাধিক ॥ পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি অবরোধ ও হরতালকালে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় এ পর্যন্ত গাজীপুরে ১১ টি পৃথক নিয়মিত মামলা হয়েছে। এরমধ্যে জয়দেবপুর থানায় মামলা হয়েছে ৬টি, কালিয়াকৈর থানায় ২টি এবং টঙ্গী, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ থানায় ১টি করে মামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত একজন নিহত ্এবং দুইজন আহত হয়েছে। মামলায় দেড় সহস্রাধিককে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও জয়দেবপুর থানা এলাকায় নাশকতা সৃষ্টি ও পরিকল্পনা করার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত এ পর্যন্ত ১০জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেছে। তবে জয়দেবপুর থানার ওসি জানান, জয়দেবপুর থানা এলাকায় অবরোধ ও হরতালকালে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১২ টি পৃথক নিয়মিত মামলা হয়েছে। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান অবরোধ ও হরতালকালে বিশৃঙ্খলা ও নাশকতার ব্যপারে বলেন, নাশকতা ও বিশৃঙ্খলারোধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের উদ্যোগে উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গঠন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এসব কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে শীঘ্রই জেলা কমিটি গঠন করা হবে।
×