ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চার হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

চার হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) কার্যালয়ে ১১টি ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয় বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)। সংস্থাটি স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এছাড়া সিএজি কার্যালয়ে ১টি পদে নিয়োগের জন্য এমনও উদাহরণ রয়েছে যে, ৬ মন্ত্রী, ২ প্রতিমন্ত্রী, ১ জন সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সরকারী দলের কেন্দ্রীয় নেতা চাপ প্রয়োগ করেছেন। এতে বলা হয়েছে, সিএজি কার্যালয়ের বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মন্ত্রী-সাংসদসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তদ্বিরে নিয়োগ দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ধানমন্ডি কার্যালয়ে ‘মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দুর্নীতি কমিয়ে আনতে ২০টি সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সিএজি কার্যালয়ে যেসব ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়, তার তালিকা প্রকাশ করে টিআইবি বলছে, এই কার্যালয়ে কাজ করানোর জন্য ৪ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। বিভিন্ন অডিট, নিয়োগ, পদায়ন ও বদলিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে বলেও দুর্নীতিবিরোধী জার্মানিভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ শাখার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। সিজিএ কার্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা রয়েছে বলে টিআইবি মনে করছে। এর মধ্যে রয়েছে- প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনবলের অভাব, হিসাবের প্রতিবেদন সময়মত সম্পন্ন না করা, হিসাবরক্ষণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নিয়োগ, পদোন্নতি ও অর্গানোগ্রামে সমস্যা, অডিট ও হিসাবের পৃথকীকরণ এবং সিএজি, সিএজি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সমস্যা। মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গ্রেডিংয়ে সমস্যা, জবাবদিহিতা ও তদারকিতে সমস্যা, অফিস স্থাপনা ও অন্যান্য লজিস্টিকের সাপোর্টের অভাব এবং প্রশিক্ষণের সমস্যাও চিহ্নিত করেছে টিআইবি। এইসব সমস্যা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে, আর্থিক বিবরণে সঠিক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে পরবর্তী বাজেটে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু সুপারিশে সিএজি অফিসকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দিতে বলেছে টিআইবি। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সিএজি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া স্বত্বেও এখানে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে। চলমান একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একটি মাঝারি পদের জন্য ৬ জন মন্ত্রী চাপ দিয়েছেন। চাপ প্রয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আবেদনকারীর দরখাস্তে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং এমপির লিখিত সুপারিশ ছিল। এরপর তার নিয়োগের জন্য ফোন করেও চাপ দেয়া হয়। তবে নীতিমালা অনুযায়ী সুপারিশকারী ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেনি টিআইবি। তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এমন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে দাবি টিআইবির। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের আওতায় আর্থিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা থাকলেও প্রায়োগিক কাজে সেটি ব্যাহত হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির চিত্র দেখা যায়। ৬ বছর ধরে নিরীক্ষা আইন খসড়া হয়ে আছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তা অনুমোদিত হচ্ছে না। যা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ কামনা করছি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিএজি কার্যালয়ে বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক তদ্বির রয়েছে। নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক এবং এমএলএসএস নিয়োগেও মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা তদ্বির করে থাকেন। ২০১৪ সালে সিজিডিএফ’র বিভিন্ন পদে মোট ৪১৩ জন নিয়োগ দেয়া হয়। যাতে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে। নিরীক্ষক ও অধস্তন নিরীক্ষককে নিয়োগ পেতে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়েছে। এছাড়া ২০১২ সালে সিএজির নিয়ন্ত্রণাধীন এ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল (ফিন্যান্স) রেলওয়েতে প্রায় ৫০০ জন নিরীক্ষক ও অধস্তন নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এ সময় প্রায় অর্ধেককেই প্রতিটি পদের জন্য ৩-৪ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সিএজি কার্যালয়ের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে নিরীক্ষা আইন না থাকা ও সংশ্লিষ্ট সরকারী আইনগুলো হালনাগাদ না করা, মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রয়োজনীয় জনবল, সুযোগ সুবিধা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরিবীক্ষণে সমস্যা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জবাব না দেয়া ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়া এবং পাবলিক এ্যাকাউন্টস কমিটি (পিএসি) কর্তৃক সব প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা না করাসহ মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে বিরাজমান সুশাসনের ঘাটতিজনিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে ২০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে টিআইবি। প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণে বিশেষ সুযোগ প্রাপ্তিতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, নিরীক্ষক, অধস্তন নিরীক্ষক ও গাড়িচালক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণে উর্ধতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্প অডিটের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র প্রতিবেদনে উঠে আসে। সিএজি কার্যালয়ের নিরীক্ষা দলের বিরুদ্ধে অডিট ইউনিটের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে, যার পরিমাণ কমপক্ষে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। ঘুষের পরিমাণ নির্ভর করে অডিট ইউনিটের বাজেটের পরিমাণের ওপর। এছাড়া তিন বছর পর বদলি করার নিয়ম থাকলেও ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাবে একই কার্যালয়ে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকা, অতিরিক্ত অর্থ আয়ের সুযোগ সম্পন্ন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠা যেমন-বন্ডেড ওয়্যার হাউজ, ডিফেন্স অডিটের পূর্ত সংক্রান্ত, এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল নিরীক্ষা করার জন্য ঘুষ আদায়ের অভিযোগ ইত্যাদি। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। যেমন-সিএজি কর্তৃক বার্ষিক পরিকল্পনা না করা, মহাপরিচালক পর্যায়ে জবাবদিহিতা না থাকা, উপ-পরিচালক পর্যায়ে মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষা আপত্তি যাচাই-বাছাই না করা, কখনও কখনও অন্যায়ভাবে আপত্তি নিষ্পত্তি করা, মাঠ পর্যায়ে নিরীক্ষার কাজ উর্ধতন কর্মকর্তা কর্তৃক পরিবীক্ষণ না করা, মাঠ পর্যায়ের নিরীক্ষাকালীন দুর্নীতি ধরা পড়লেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেয়া, কর্তৃপক্ষের স্বাক্ষর ও তারিখ এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি ঠিক নেই বলে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, বাংলাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের সমস্যা বিরাজমান। আমাদের সংবিধান, শাসন কোন না কোনভাবে এক কেন্দ্রিকতার মধ্যে থাকছে। নিরীক্ষণের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে তার সাংবিধানিক ক্ষমতার প্রয়োগ নেই। নিয়োগের ক্ষেত্রে তদ্বিরের সংস্কৃতি মহামারির মতো হয়ে গেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহী না করার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তা থেকে বের হয়ে আসা প্রয়োজন। মহাহিসাব-নিরীক্ষকের কার্যালয়ের সুশাসনের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে, তা থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী ২০ দফা সুপারিশ উত্থাপন করে। স্বল্পমেয়াদী সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অনিয়ম দুর্নীতি রোধকল্পে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্গানোগ্রাম ও নিয়োগের বিধিমালার অনুমোদন দেয়া, সিএজিকে বাজেট, নিয়োগসহ সব বিষয়ে সাংবিধানিক স্বাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার দিপু রায়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
×