ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্লিনিক্যাল বর্জ্য থেকে এরা আক্রান্ত হতে পারে যক্ষ্মা হেপাটাইটিস ‘বি’ ‘সি’ ডিপথেরিয়া এমনকি ভয়ঙ্কর এইডসেও

ডাস্টবিনের আবর্জনায় জীবিকা ॥ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পৌনে ২ লাখ টোকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

ডাস্টবিনের আবর্জনায় জীবিকা ॥ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পৌনে ২ লাখ টোকা

শাহীন রহমান ॥ রাজধানী ঢাকা ও সিলেটসহ দেশের প্রধান নগরগুলোতে আবর্জনা টোকানোর সঙ্গে জড়িত শিশুরা উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। এসব পথশিশুর অধিকাংশই ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলোতে অস্বাস্থ্যকর, নোংরা পরিবেশে থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত। সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পরও তারা সামান্য আয় রোজগার করে থকে। ফলে তারা একদিকে যেমন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যদিকে মানবেতর জীবনযাপন করতেও বাধ্য হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আবর্জনার মধ্যে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য থাকায় তারা অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। আবার কখনও কখনও এসব আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলা হয়। ফলে আবর্জনা পোড়ার বিষাক্ত ধোঁয়ার গ্যাসক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। আবর্জনা টোকানোর সঙ্গে জড়িত শিশুদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৪ বছরের নিচে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হিসেব মতে, প্রতিদিন ১ লাখ ৭০ হাজার পথশিশু বা টোকাই ৭ থেকে ৮শ’ টন পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন ডাস্টবিন থেকে। অথচ এসব বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে আছে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য। ফলে তারা সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, হাসপাতাল- ক্লিনিকগুলোতে সৃষ্ট চিকিৎসা বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলা হচ্ছে। নিক্ষিপ্ত এসব বর্জ্যের তালিকায় রয়েছে ব্যবহৃত সুচ, সিরিঞ্জ, রক্ত ও পুঁজযুক্ত তুলা, গজ, ব্যান্ডেজ, মানব-প্রত্যঙ্গ, ওষুধের শিশি, ব্যবহৃত স্যালাইন, রক্তের ব্যাগ এবং রাসায়নিক দ্রব্যসহ সব ধরনের চিকিৎসাজাত আবর্জনা। এসব বর্জ্য যথাযথভাবে প্রক্রিয়াকরণ না করায় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া ও এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, ত্রিশটি কঠিন রোগের অন্যতম কারণ দূষণ। অথচ এ ধরনের দূষিত আবর্জনার সংস্পর্শে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করছে টোকাইরা। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা মতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ডাম্পিং হয় ৩ হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন। বেসরকারী জরিপ মতে প্রতিদিন গৃহস্থালি বর্জ্য উৎপাদিত হয় ৫ হাজার ৯শ’ ৫০ মেট্রিক টন। এছাড়া মেডিক্যালসহ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে ১ হাজার ৫০ মেট্রিক টন। রাস্তাঘাট থেকে উৎপাদিত হয় ৪শ’ মেট্রিক টন। অথচ এসব দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষের ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া এমন সব দ্রব্য যা রিসাইকল প্রক্রিয়ায় পুনরায় ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে প্লাস্টিক বর্জ্য, কাগজের বর্জ্য ও কাঁচ জাতীয় বর্জ্য রিসাইকল করে পুনরায় ব্যবহার করা হচ্ছে। আর পুনর্ব্যবহারযোগ্য এসব দ্রব্য সংগ্রহ করে বিক্রি করাই তাদের আয়ের একমাত্র পথ; যার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ পথশিশু। বেসকারী সংস্থার জরিপ মতে প্লাস্টিক, কাঁচ ও কাগজ জাতীয় বর্জ্য শিশু ও টোকাইদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের মতে, ঢাকা শহরে বর্তমানে উৎপাদিত ১২৮ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্যরে ৮৩ ভাগ রিসাইকল হয়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয় তার মধ্যে কাগজ বর্জ্যরে ৬৫ ভাগ রিসাইকল হচ্ছে। কাঁচ জাতীয় পদার্থের প্রায় ৪৬ মেট্রিক টন ব্যবহার শেষে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। রিসাইকল হয়ে এগুলোর ৫২ ভাগ পুনরায় সংগ্রহ করা হয়। ধাতব বর্জ্য উৎপাদিত হয় ২৭ মেট্রিক টন এবং রিসাইকল হয় ৫০ ভাগ। রিসাইকেলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ঢাকা শহরের এক লাখ ৭০ হাজার পথশিশু। আবার মেডিক্যাল বর্জ্যও আলাদা না করার কারণে এর সংস্পর্শে আসছে শিশুরা। গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনজীবিকার তাগিদেই মূলত এসব শিশু অপরিণত বয়সে আবর্জনা টোকানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিচ্ছে। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবার তাদের শিশুদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে কখনই সক্ষম হয় না বিধায় সহজেই এ পেশায় নেমে পড়ছে। ঢাকা-সিলেটসহ দেশের অন্য বড় শহরের সাধারণ চিত্রের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে এই টোকাইরা। যাদের অধিকাংশের বয়স ১৪ বছরের নিচে। অধিকাংশ টোকাই নিরক্ষর। অনেকের পিতা অথবা মাতা নেই। আবার বড় পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এরা এজাতীয় পেশা বেছে নিচ্ছে। জনসমাগমপূর্ণ স্থানে প্রধানত বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল, বিপণিকেন্দ্র, রাজপথ, আবাসিক এলাকা, ডাস্টবিনের কাছাকাছি টোকাইরা তাদের রোজগারের সন্ধানে বেশি ব্যস্ত থাকে। বেঁচে থাকার জন্য এরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কম পারিশ্রমিকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে থাকে। দিনরাত খেটে এরা দৈনিক গড়ে ৫০ থেকে ১শ’ টাকার মতো আয় করে। দু’পয়সা আয়ের জন্য এরা ডাস্টবিন, ফুটপাথ, রাস্তাঘাট, নর্দমা, আবর্জনা নিক্ষেপের স্থান অথবা অন্যান্য জায়গা থেকে ভাঙ্গা কাঁচের টুকরা, বাতিল কাগজ, শিশি-বোতল, লোহা, প্লাস্টিক দ্রব্য প্রভৃতি পুনরায় ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করে থাকে। সারাদিন পরিশ্রম শেষে রিসাইকল কারখানায় এগুলো বিক্রি করে থাকে। এ সকল বাতিল জিনিসের কোন নির্ধারিত মূল্য না থাকায় যথাযথ পারিশ্রমিক থেকেও এরা বঞ্চিত হচ্ছে। গ্লোবাল এ্যালায়েন্স অব ওয়েস্ট পিকার্সের তথ্য মতে, আবর্জনা থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য প্রক্রিয়াজাত করার জন্য বাংলাদেশে প্রায় ২শ’ রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত রিসাইকেলকৃত দ্রব্য থাইল্যান্ড, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। এ সংস্থার তথ্যে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ টোকাই লেখাপড়া জানে না। সারাদিন পরিশ্রমের পরে তারা সামান্য অর্থ আয় করে থাকে। কেবল ঢাকাতে এক লাখের ওপর টোকাই রয়েছে যারা আবর্জনা বাছাই করে জীবীকা নির্বাহ করে থাকে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত শিশুর সবাই অপুষ্টির শিকার। বয়স অনুযায়ী এদের দেহের ওজনও অনেক কম। এর সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ শিশুর বয়স ১৪ বছরের নিচে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পয়সার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের নেতারা টোকাইদের মিছিল, হরতালে পিকেটিংসহ বিভিন্ন কর্মসূচীতে ব্যবহার করে থাকে। দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং কিশোর বয়সের হওয়ায় টোকাইরা প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধমূলক এবং অনৈতিক কর্মকা-ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কখনও কখনও মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক বিক্রিতে টোকাইদের কাজে লাগিয়ে থাকে। তবে জানা গেছে, টোকাইদের ভাগ্য উন্নয়নে দেশে বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সরকারী সাহায্যপুষ্ট সংস্থা ইউসেপ ১৯৭৩ সাল থেকে ঢাকা শহরে এসব ছিন্নমূল শিশু-কিশোরকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইউসেপ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও কিশোরদের ৪ বছর সময়কাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি তাদের কারিগরি শিক্ষা প্রদানও করে থাকে। পরবর্তীতে ঢাকা শহরের বাইরেও ইউসেপ-এর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে।
×