ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মৃত্যুঝুঁকি, অজানা গন্তব্য ॥ তবু চলছে ভয়ঙ্কর যাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ জানুয়ারি ২০১৫

মৃত্যুঝুঁকি, অজানা গন্তব্য ॥ তবু চলছে ভয়ঙ্কর যাত্রা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মৃত্যু ঝুঁকিপূর্ণ সাগরপথে মালয়েশিয়ায় আদম পাচার থেমে নেই। গডফাদাররাও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝেমধ্যে হাতেগোনা কিছু মাঠ পর্যায়ের দালাল ধরা পড়ে। কিন্তু আইনের ফাঁকফোকরে এরাও বেরিয়ে আসে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই ভয়াবহ এ যাত্রা অব্যাহত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দালালদের মাধ্যমে অসহায়, হতদরিদ্রদের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে এনে ইঞ্জিনচালিত বোট বা ট্রলারে স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় যাত্রার জন্য এদের জড়ো করা হয়। যাত্রাপথে এরা কেউ গন্তব্যে পৌঁছে, কেউ থাইল্যান্ডের বন্দী শিবিরের বাসিন্দা হয়। আবার কেউ কেউ সাগরেই ডুবে চিরতরে হারিয়ে যায়। সরকার দফায় দফায় এ ভয়ঙ্কর যাত্রাপথ বন্ধ করতে বিভিন্নভাবে আদেশ, নির্দেশ ও প্রচারণা চালিয়ে আসছে। কিন্তু কোন কিছুই যেন রোধ করতে পারছে না। যারা যাচ্ছে এরা মূলত একেবারে নিরক্ষর ও দরিদ্রশ্রেণীর লোকজন। দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এরা আসছে আর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরপথে যাত্রী হচ্ছে অজানার উদ্দেশ্যে। এভাবেই মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর অহর্নিশ প্রয়াস দেশের একশ্রেণীর মানুষের মাঝে এত বেশি গেঁড়ে বসেছে যে, যা কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। মালয়েশিয়ায় দেশের চেয়ে অধিক উপার্জনের প্রলোভন দেখিয়ে গডফাদার ও দালাল চক্রের প্রচারণা এত বেশি যে যা হতদরিদ্র লোকজনকে মাদকের নেশার মতো টানছে। এদিকে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকা বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া আদম পাচার নেটওয়ার্ক। দেশের কিছু উপজেলা শহরে তাদের জাল প্রসারিত করে মানবপাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ছোট-বড় অন্তত দুই সহস্রাধিক দালাল। আর ঐসব দালাল নিয়ন্ত্রণ করছে এক ডজনেরও বেশি গডফাদার। গডফাদারদের মধ্যে কক্সবাজার এলাকার এক সংসদ সদস্যের নামও রয়েছে, যিনি ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে বিভিন্নভাবে রিপোর্ট রয়েছে। সূত্র জানায়, গডফাদারদের নির্দেশে তাদের নিয়োজিত দালালরা সেন্টমার্টিনের পূর্ব-দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমায় প্রায় সময় নোঙ্গর করে থাকা একাধিক জাহাজে লোক জমায়েত করে থাকে। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, উখিয়া ও টেকনাফ উপকূলীয় এলাকার চিহ্নিত কয়েকটি ঘাট ছাড়াও চট্টগ্রাম হয়ে ছোট ফিশিং বোটে লোকজন নিয়ে আসা হয় সেন্টমার্টিনের অদূরে সাগরে অপেক্ষমাণ সেসব জাহাজে। গডফাদারের অনেকে ক্ষমতাসীনদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে বলেই তাদের নিয়োজিত দালালরা কোন কিছুতেই ভয় না করে হরদম আদম পাচরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দালালদের সিংহভাগের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন থানায় ডজনখানেক মামলা ঠুকে দেয়া হলেও গডফাদারদের নামে মামলা হয়েছে হাতেগোনা দু’একটি। তাও আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের সঙ্গে আঁতাত করে মোটা অঙ্কের অর্থে চার্জশীট থেকে বাদ পড়ে যায় ঐসব গডফাদার। অনুসন্ধানে জানা যায়, কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছে প্রশাসনের তালিকাভুক্ত মানবপাচারকারী মধ্যম কুতুবদিয়াপাড়ার নুরুল হকের পুত্র গডফাদার একরাম। কৃষকলীগের পরিচয়ে মানবপাচারের গডফাদার একরাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখনও। মানবপাচারের মতো বেআইনী কাজে জড়িত থেকে অনেকে গড়ে তুলেছেন বিত্তের পাহাড়। কক্সবাজার শহরকেন্দ্রিক মানবপাচারের আরেকটি সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে মধ্যম নুনিয়াছড়ার শামসু মাঝির পুত্র ছৈয়দ করিম নামের এক গডফাদার। সাগরপথে ট্রলারে মানবপাচার করে ছৈয়দ করিম এখন কোটিপতি। মানব পাচারে লিস্টেট গডফাদাররা ॥ উখিয়া সোনাইছড়ির ইসলাম মিয়ার পুত্র শামসুল আলম, শাহপরীদ্বীপের শরিফ হোসেন প্রকাশ সরহোছন, সোনারপাড়ার নুরুল কবির, তার স্ত্রী রেজিয়া আক্তার ওরফে রেবি ম্যাডাম (বর্তমানে জেলে), ফয়েজুর রহমান সিকদার, লিংক রোডের মোহাম্মদ আলী পাঁকি, তার সহোদর শওকত, একই এলাকায় বসবাসকারী মিয়ানমারের জাফর মাঝি, গোরকঘাটার মৌলভী জাকারিয়ার পুত্র সালাহ উদ্দিন, ফদনার ডেইলের বর্মাইয়া রশিদ মাঝি, কুতুবদিয়াপাড়ার একরাম, নুনিয়াছড়ার ছৈয়দ করিম, আবদুল্লাহ আল মাসুদ আজাদ, চৌফলদ-ীর একরাম মেম্বার, খুরুশকুল কাউয়ারপাড়ার জাহাঙ্গীর, রাস্তরপাড়ার সোনা মিয়া, পেঁচারঘোনার যুবদল নেতা মোহাম্মদ আলী, তেতৈয়ার কামাল, রাশেদ, মহেশখালী কুতুবজোমের আমান উল্লাহ মাঝি ও টেকপাড়ার মিজান। দালাল হিসেবে লিস্টেট যারা ॥ ছোট মহেশখালী দক্ষিণকুলের জাফর আলমের পুত্র মোঃ এনামুল কবির, শাপলাপুর বারিয়াপাড়ার মৌলভী নুরুল হকের পুত্র সাবেক শিবির ক্যাডার মোঃ কলিম উল্লাহ, সিন্ডিকেটে রয়েছে তার ভাই মোঃ করিম প্রকাশ মোহাম্মদ, মধ্যম নুনিয়াছড়া ছাত্রদল নেতা ইসমাইল হোসেন আব্বুইয়া, হাসিম মাঝির পুত্র আজিজ, ছৈয়দ হোসেনের পুত্র মাসুদ, মৃত জুলু মিয়ার পুত্র আজিজ, গুরা মিয়া মাস্টারের পুত্র আবু বকর ছিদ্দিক ও আবু ছৈয়দ, মৃত খলিল মাস্টারের পুত্র মোঃ হানিফ, সাবেক ঝিলংজা ইউপি মেম্বার ওমর ফারুক, একই এলাকার মাহমুদুল হক, নুতন ফিশারিপাড়ার আনোয়ার, হোছন আলীর পুত্র মোঃ রুবেল, খুরুশকুলের কাউয়ারপাড়ার আজিজুল হক, রাস্তারপাড়ার আনোয়ার, কামাল, সোহেল, নতুন বাহারছড়ার জানে আলম পুতু, বিএনপি নেতা জাফর আলম শিপন। লিংকরোড মুহুরীপাড়ার নুর মোহাম্মদের পুত্র নাছির, মোহাজেরপাড়ার নুরুল ইসলামের পুত্র ছৈয়দ হোছন মনির, মৌলভী মুহিবুল্লাহ, শাহপরীরদ্বীপ ডাঙ্গরপাড়ার আবু তাহেরের পুত্র মোঃ হাশিম প্রকাশ পুয়া মাঝি, উখিয়ার জালিয়াপালং চেপটাখালী গ্রামের জাফর আলমের পুত্র মোজাম্মেল, সোলতানের পুত্র জিয়াউল হক, মকতুল হোনের পুত্র মুসলেম উদ্দিন ও মিয়া হোছন মাস্টারের পুত্র ছৈয়দ হোছন মিলে গঠিত শক্তিশালী মানবপাচার সিন্ডিকেট প্রতিদিন কৌশলে বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে নতুবা অপহরণ করে মালয়েশিয়ায় নিরীহ লোকজনকে পাঠিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। আর এ সিন্ডিকেটের মূল হোতা হচ্ছে শাহপরীদ্বীপের গডফাদার সরহোছন, কুতুবদিয়াপাড়ার নুরুল হকের পুত্র একরাম ও সোনারপাড়ার মুস্তাফিজুর রহমান সিকদারের পুত্র ফয়েজুর রহমান সিকদার। এদের দাপটে মানবপাচার থামছে না বলে প্রতীয়মান। কক্সবাজারের বিভিন্ন সূত্রে জাননো হয়, মূলত মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের রুটটি শুরু হয় ২০০০ সালে। ইঞ্জিনচালিত বোটের চৌকস চালকদের মাধ্যমেই রুটটি খুলে যায়। মূলত বেশকিছু ট্রলার ও ফিশিং বোট চোরাচালানের পাশাপাশি মাদক ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে। মানব পাচার রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে এসব সুপারিশ বাস্তবে অকার্যকর থাকায় অবৈধ এ পাচার না থামার অন্যতম একটি প্রধান কারণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
×