ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় গণগ্রন্থাগারে শিশু-কিশোর পাঠকক্ষ

শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝে ১২ হাজার বই, নেয়া যায় বাড়িতেও

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫

শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝে ১২ হাজার বই, নেয়া যায় বাড়িতেও

মোরসালিন মিজান ॥ বাচ্চার যত যা দরকার, যে কোন মূল্যে ব্যবস্থা করেন বাবা-মা। সন্তানের হাতের নাগালে রাখেন সব সুযোগ-সুবিধা। গ্লাসভর্তি দুধ, চকোলেট, আইসক্রিম, কার্টুন, গেমস প্রস্তুত থাকে। শুধু অনুপস্থিত বই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠ্যবইয়ের বাইরে আর কোন বই দেয়া হয় না শিশু-কিশোরের হাতে। এ অবস্থা অনেকদিন ধরেই চলমান। তবে শিক্ষিত বুদ্ধিমান বাবা-মার কথা আলাদা। তারা সন্তানের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার সচেতন প্রয়াস চালান। বলা চলে, এই সচেতন বাবা- মার সন্তানরাই আসছেন সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শিশু- কিশোর পাঠকক্ষে। এখানে ক্ষুদে পাঠক। সংখ্যায় কম। তাতে কী, আপন মনে বই পড়ছে সবাই। জ্ঞানের অফুরন্ত ভা-ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হচ্ছে তাদের। এভাবে পাঠাভ্যাস তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে শিশু-কিশোর পাঠকক্ষ। পাবলিক লাইব্রেরি বা সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে সবার জানা থাকলেও শিশু পাঠকক্ষটি সম্পর্কে অবগত নন অধিকাংশ মানুষ। এর অবস্থানও অনেকে জানেন না। মূল লাইব্রেরিতে প্রবেশের সময় চমৎকার যে সিঁড়িটি ভাঙতে হয়, এর ঠিক বাঁ পাশে শিশু- কিশোর পাঠকক্ষ। নিচতলায়। এখানে প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা বই পড়তে পারে। বয়স নিয়েও খুব কড়াকড়ি নেই। জানা যায়, মূল লাইব্রেরির বাইরে কেবল শিশুদের জন্য বিশেষ সেবাটি ১৯৭৮ সাল থেকে চালু আছে। যথেষ্ট সমৃদ্ধ এ পাঠকক্ষে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ১২ হাজার বই। সবই শিশুতোষ। তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে লেখা। লাইব্রেরি সায়েন্সের নিয়মে সাজানো। আছে জীবনীগ্রন্থ, রূপকথা, সায়েন্স ফিকশন, মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞানবিষয়ক বই। বিখ্যাত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ এখানে-ওখানে গুঁজে রাখা। তারও বেশি ভূতের গল্প। ‘এক ডজন ভুতুড়ে প্রাণীর গল্প’, ‘বোগাস ভূত’ ইত্যাদি শিরোনাম সহজেই আকৃষ্ট করছে ক্ষুদে পাঠককে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র, বেগম রোকেয়া, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, বেগম সুফিয়া কামাল, এসএম সুলতান, ভলতেয়ার, হেলেন কেলারÑ কত বড় বড় মানুষ! ঘটনাবহুল জীবন। তাঁদের সম্পর্কে জানতে আছে জীবনী সিরিজ। ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক যাদের তাদের জন্য ‘রঙ ছবির গল্প’, ‘ছবি আঁকা ও ছবি বোঝা’, ‘অনুশীলনে চারু ও কারুকলা’, ‘শিশু চিত্রকলা’ এ্যালবামসহ হরেক বই। গান যাদের পছন্দ তারা পড়তে পারে ‘ছোটদের সারেগামা ও সঙ্গীত বিদ্যা’, ‘ছোটদের প্রিয় গান ও স্বরলিপি’, ‘আমার হারমোনিয়াম শেখার বই’। অভিনয়ে আগ্রহীদের জন্যও বই আছে। তবে বিশাল জায়গাজুড়ে আছে ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’, ‘বিজ্ঞানের রহস্য’, ‘মানুষ করল আকাশ জয়’ ইত্যাদি বই। গণিতের ভয় কাটাতে পারে ‘মজার গণিত’, ‘গণিত অলিম্পিয়াড’র মতো বইও। ক্রিকেট প্রসঙ্গে জানতে আছে ‘যত ক্রিকেট তত মজা’। বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো হ্যারি পটার, গালিভার্স ট্র্যাভেলস, জুলভার্নের ক্যাপ্টেন গ্রান্টস চিলড্রেন, শার্লক হোমস, আর্থার সি ক্লার্কের রচনা আছে প্রচুর পরিমাণে। পাঁচ খ-ের শিশুদের বিশ্বকোষ, ছোটদের বিজ্ঞান পিডিয়া, ছোটদের অভিধান বইগুলো অল্প সময় ঘাটলেও জানা যাবে হরেক কিছু। বুধবার পাঠকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত নিচু চেয়ারে বসে আপনমনে বই পড়ছে ক্ষুদে পাঠকরা। টু শব্দটি নেই। একজনের নাম অত্রি। এইটুকুন দেখতে মেয়ে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ক্লাস থ্রি। কী বই পড়ছো? জিজ্ঞেস করতেই চশমা পরা চোখ তুলে তাকাল সে। বইয়ের একটি ডানা দেখিয়ে বললÑ সিন্ড্রেলা। কেমন লাগছে? খুব মজার গল্প? জানতে চাইলে মাথা ঝঁকালÑ হ্যাঁ, মজার খুব। আরও একটি বই হাতে টেনে নিয়ে দেখাল সে। বলল, প্রাচীন বাংলার রূপকথা। এটাও ভাল। আরেক পাঠক রিভু। ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার সামনে জোকস। জানাল, গোয়েন্দা গল্প ও জোকস তার খুব প্রিয়। কথার এক পর্যায়ে জানা গেল, একটু আগে কথা বলা অত্রি তার বোন। মা-বাবা দুজনই ডাক্তার। তারা কাজে চলে গেছেন। তার আগে বই পড়ার জন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে গেছেন তাদের। জোর করে দিয়ে যাননি তো? জানতে চাইলে হেসে ফেলে রিভু। বলে, না না। আমাদের ভাললাগে বলেই তো। আগেও এসেছি। এখানে পাঠ করে চাপ কম থাকায় একটু বড়রাও ঢুকে পড়েন। তাদের দলে পড়ে নভ। কলেজের এই শিক্ষার্থী বলল, এখানকার বইগুলো সহজেই পড়ে ফেলা যায়। একটু বেশি সময় দিলে একদিনে একাধিক বই পড়ে শেষ করা যায়। এ জন্য শিশু পাঠকক্ষে চলে আসি। পাঠকক্ষের দায়িত্বে থাকা আসমা আক্তার বলেন, এখানে শিশুরা এসে খুশি হয়। সময় নিয়ে বই পড়তে চায়। কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়, বাবা-মা সময় দিতে পারে না। তখন ওদেরও চলে যেতে হয়। তিনি জানান, কেউ স্কুল শুরুর আগে এখানে পড়তে আসে। কেউ আসে স্কুল ছুটির পর। তবে এখন হরতাল-অবরোধ থাকায় উপস্থিতি সামান্য কম। পাঠ কক্ষটিতে বই পড়ার ব্যবস্থা আছে একসঙ্গে ৫২ জনের। শুক্র ও শনিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তারা এ লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারে। ফটোকপি করার সুযোগ আছে। কেউ চাইলে বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারে। পছন্দের ২টি বই নিজের কাছে রাখতে পারে ১৫ দিন। এ জন্য শিশু পাঠকক্ষের সদস্য হতে হয়। নিয়মটিও দারুণ সহজ। পাঠকক্ষ থেকে একটি ফর্ম সংগ্রহ করতে হবে। সেটি পূরণ করে নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের স্বাক্ষরসহ জমা দিতে হবে। সদস্য ফি ২০০ টাকা। তাও আবার ফেরতযোগ্য। অবশ্য অভিভাবকদের অসচেতনতা, শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই পড়ার চাপ, কোচিং, যানজট ইত্যাদি কারণে ক্ষুদে পাঠকের সংখ্যা খুব একটা বাড়ছে না। এ ছাড়া বিশেষ শিশু-কিশোর কক্ষটি সম্পর্কে আলাদা করে কোন প্রচার নেই কর্তৃপক্ষের। প্রবেশপথটি এত সাধারণ যে, প্রথম দেখায় গাড়ির গ্যারেজ ছাড়া কিছু মনে হয় না। দেয়ালের গায়ে শিশু-কিশোর পাঠকক্ষ লেখা কোন কিছু নেই। কোন নির্দেশনা চোখে পড়ে না। ভেতরেও যারপরনাই পুরনো একটি চেহারা। কোন কোন বইয়ের গায়ে ধুলোর আস্তর জমে আছে। শিশুদের আকর্ষণ করার মতো বাড়তি কোন উপাদান এখানে নেই। এসব কারণেও পাঠক হারাচ্ছে কক্ষটি। গণগ্রন্থাগার অধিদফতরের পরিচালক হাফিজুর রহমান অধিকাংশ সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, মহাপরিচালক হিসেবে বেশিদিন হয়নি আমার। বাজেটেরও ব্যাপার থাকে। তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি। গত বছর নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিতে এনেছি। এমন আরও কিছু পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, শিশু-কিশোরের উপযোগী করে, আকর্ষণীয় করে কক্ষটি সাজানো হবে। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় গণগ্রন্থাগারের জন্য নতুন ভবন নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটি বাস্তবায়ন করা গেলে সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তবে তারও আগে বাবা-মাকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, বাবা-মাকে বুঝতে হবে বই পড়ার গুরুত্ব। তারা সন্তানের হাতে আর যাই তুলে দিক, বই না দিলে অনেক কিছুই বৃথা হয়ে যাবে।
×